
দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ও দ্রুত সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রথমবারের মতো সরাসরি পাইপলাইনে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত জ্বালানি তেল পরিবহন শুরু হয়েছে। গতকাল সকাল ১১টায় পতেঙ্গা এমআই প্রান্তে পাইপলাইনটির উদ্বোধন করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। উপস্থিত ছিলেন- জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার ইন চিফ মেজর জেনারেল মু. হাসান-উজ-জামান।
উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, রাষ্ট্রের এ প্রকল্প প্রযুক্তিগত উন্নতির সঙ্গে সম্পর্কিত। আধুনিক বিশ্বের ভিত্তি টেকনোলজিক্যাল প্রগ্রেস। আমাদের খুব বেশি সম্পদ নেই। কিছু প্রাকৃতিক গ্যাস ছিল সেটাও ফুরিয়ে আসছে। মানবসম্পদ ছাড়া উল্লেখযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ আর নেই। তাই প্রযুক্তিগত উন্নতি দিয়েই আমাদের এগোতে হবে। তিনি বলেন, আগে পেট্রোলিয়াম প্রডাক্ট আমদানি খাতে ৪-৫ জন বিড করতে পারতো। এখন ১০-১২টি প্রতিষ্ঠান বিড করছে। এতে বছরে ১৪০০-১৫০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। তিনটি মন্ত্রণালয়ে আমরা ৪৫ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করতে সক্ষম হয়েছি। এজন্য সীমিত সম্পদকে মাথায় রেখে অপচয় ও দুর্নীতি কমানো জরুরি।
প্রকল্প ব্যয় বেশি হওয়ার সমালোচনা করে তিনি বলেন, সড়ক নির্মাণ ব্যয় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে বেশি। শুধু ব্যয়ই নয়, বাস্তবায়নেও সময় লাগে বেশি। পাইপলাইন প্রকল্পটিও ২০১৮ সালে শুরু হয়ে ২০২০ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও দেরি হয়েছে। করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে ব্যয় বেড়েছে। বাস্তবায়নে দেরি হলে ব্যয়ও বাড়ে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে অভিনন্দন জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, দুরূহ এ প্রকল্পটি তারা সমাপ্ত করেছে। আমি আশা করবো, ভবিষ্যতে তারা ব্যয় সাশ্রয়ী এবং দ্রুত সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে।
জানা যায়, প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার এ প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা পর্যন্ত ২৪৯ দশমিক ৪২ কিলোমিটার পাইপলাইন তৈরি করা হয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে গোদনাইল পর্যন্ত পাইপের ব্যাস ১৬ ইঞ্চি, গোদনাইল থেকে ফতুল্লা পর্যন্ত ১০ ইঞ্চি। এর মধ্যে ৯ কিলোমিটার পাইপলাইন গেছে নদীর ১৮ মিটার নিচ দিয়ে। প্রতি ঘণ্টায় ডিজেল পরিবহন হবে ৪ লাখ লিটার। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) জানিয়েছে, পতেঙ্গা ডেসপাস টার্মিনাল থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ২৪২ কিলোমিটার দীর্ঘ এ পাইপলাইনের মাধ্যমে এখন থেকে নিয়মিত তেল সরবরাহ করা হবে। আগে নদীপথে ডিজেল পরিবহনে সময় লাগতো প্রায় ৪৮ ঘণ্টা। পাইপলাইনে সময় লাগবে মাত্র ১২ ঘণ্টা। এতে বছরে সাশ্রয় হবে অন্তত ২২৬ কোটি টাকা।
২০১৮ সালের অক্টোবরে বিপিসি’র অর্থায়নে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় এবং চলতি বছরের মার্চে নির্মাণ শেষ হয়। পতেঙ্গা থেকে সিদ্ধিরগঞ্জ পর্যন্ত ১৬ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের ২৪২ কিলোমিটার পাইপলাইন ও সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে ফতুল্লা পর্যন্ত আরও ৮ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে। কুমিল্লায় নতুন পেট্রোলিয়াম ডিপো তৈরি হয়েছে। সিদ্ধিরগঞ্জে পদ্মা অয়েল ও মেঘনা পেট্রোলিয়ামের এবং ফতুল্লায় যমুনা অয়েল ও মেঘনা পেট্রোলিয়ামের রিজার্ভার বসানো হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল পরিবহনে সময় ও ব্যয় দুটোই কমবে। সড়ক ও নদীপথে ট্যাংকার ব্যবহারের ঝুঁকি হ্রাস পাবে। দেশের জ্বালানি বিতরণ ব্যবস্থায় এটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে।
প্রকল্পটির পরিচালক প্রকৌশলী আমিনুল হক বলেন, পাইপলাইনের মাধ্যমে সরাসরি তেল পরিবহন পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় ও নিরাপদ। নারায়ণগঞ্জ ও ফতুল্লার ডিপো থেকে দেশের অন্যান্য ডিপোতে সরবরাহ করা যাবে। বিপিসি চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান জানান, পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল পরিবহন নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। গত জুনে পরীক্ষামূলকভাবে ৩২ হাজার টন ডিজেল চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জে সফলভাবে সরবরাহ করা হয়েছে।