Image description

বৃষ্টি হলেই মশার উপদ্রব বেড়ে যায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায়। মশার উৎপাততে অতিষ্ঠ হয়ে শুধু রাতে নয়, দিনের বেলাতেও মশারি টানিয়ে রাখছেন নগরীর বাসিন্দারা। তাদের অভিযোগ, আগে মশক নিধনে নিয়মিত ওষুধ দেওয়া হলেও, এখন আর দিতে দেখা যায় না। তাছাড়া যে ঔষধ ব্যবহার করা হয় তাতে মশা মরে না। এদিকে, ডিএসসিসি এলাকায় বেড়েই চলেছে মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ১০৪ জনের। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৫ হাজার ৩২৪ জন ডেঙ্গু রোগী।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় মশার উপদ্রব না কমলেও প্রতিবছর বেড়েই চলেছে মশক নিধনের বাজেট। ক্ষুব্ধ নগরবাসীরা বলছেন, মশক নিধনের নামে হরিলুট চলছে সিটি করপোরেশনে। প্রতিবছর মশক নিধনে কোটি কোটি টাকা খরচ করলেও আদতে মশা কমছে না।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ১০ অর্থবছরে শুধু মশক নিধনের জন্য ২৬৫ কোটি ২২ লাখ টাকা বাজেট বরাদ্দ করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)।

এরমধ্যে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মশক নিধনের জন্য বাজেট ধরা হয় ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কিছুটা কমিয়ে বাজেট ধরা হয় ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ খাতে দক্ষিণ সিটিতে বরাদ্দ হয় ২৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মশক নিধন খাতে ২৬ কোটি টাকা এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে খরচ হয়েছে ৩২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।

২০২০-২১ অর্থবছরে ২০ কোটি ২ লাখ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩১ কোটি ২ লাখ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৭ কোটি টাকা, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩৮ কোটি ৮৩ লাখ ও ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪০ কোটি টাকা বাজেট ধরা হয়।

মশার উপদ্রব কমাতে এবছর অর্থাৎ ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৪৫ কোটি টাকা বাজেট ঘোষণা করেছে ডিএসসিসি। সিটি করপোরেশন বলছে, বিশেষ অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে এবার মশক নিধন এবং বিশেষজ্ঞ টিমের নির্দেশনায় মশার ঔষধ কেনা হবে।

সরেজমিনে ঢাকা  দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২৬, ২৯, ৩৭, ৪২, ৪৩, ৪৪, ৫২, ৫৩, ৬১ ও ৭০ নম্বর ওয়ার্ডে মশার উপদ্রব ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ঢাকা দক্ষিণ

সিটি করপোরেশন এলাকার ৪২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন রিন্টু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সিটি করপোরেশন আগে নিয়মিত মশক নিধনে ওষুধ ব্যবহার করতো। কিন্তু এখন আর নিয়মিত মশার ওষুধ দেয় না। তাছাড়া যে ওষুধ ব্যবহার করে তাতে তেমন মশাও মরে না। যে কারণে এখন আগের থেকে মশা অনেক বেড়েছে।

রিন্টু আরও বলেন, সমস্যা হচ্ছে আগে যদি মাঝেমধ্যে মশার ওষুধ দেওয়ায় গ্যাপ হতো তাহলে আমরা সরাসরি কাউন্সিলরকে জানাতাম। কিন্তু এখন আর সেই সুযোগ নেই। অলিগলি ঠিকভাবে পরিষ্কার হয় না। মশার ওষুধ দেওয়া হয় না। রাস্তার উপরে খোলা ডাস্টবিন। মশার উপদ্রব তো বাড়বেই।

পুরান ঢাকার বংশাল এলাকার বাসিন্দা মাহাতাব হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বৃষ্টি হলেই মশার উপদ্রব বেড়ে যায়। ঘুমানোর আগে আমরা নিয়মিত মশারি টানাই। কিন্তু এখন দিনের বেলাতেও মশারি টানিয়ে রাখতে হয়। আশপাশে ময়লা-আবর্জনা না দেখলেও কোথা থেকে যেন মশা আসে আল্লাহ ভালো জানেন। মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ।

এই বাসিন্দা আরও বলেন, বাচ্চারা টেবিলে পড়তে বসলে ছোট ছোট মশা এসে ওদের কামড়াতে থাকে। এখন ওদের টেবিল থেকে উঠে মশারির নিচে পড়তে বলি। এছাড়া তো মশার হাত থেকে রক্ষার কোন উপায় নেই।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে এই বাসিন্দা বলেন, এখন মাঝেমধ্যে বৃষ্টি হয়। বর্ষা মৌসুম পুরোপুরি নেই। আগেভাগেই মশা তাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এমনিতেই প্রতিনিয়ত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। মশা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে অবস্থা আরও বেগতিক হবে।

ডিএসসিসির কালুনগর খালপাড়ের বাসিন্দা রেবেকা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মশা মারতে মাঝেমধ্যে ওষুধ দিলেও যেখানে মশার উৎপত্তি সেটা ঠিকভাবে পরিষ্কার করা হচ্ছে না। খালে ময়লা-আবর্জনায় ভরপুর। নোংরা পানির দুর্গন্ধ টেকা দায়। খাল যদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না থাকে, তাহলে মশার উপদ্রব কমবে কীভাবে? সিটি করপোরেশন উচিত নিয়মিত মশক নিধনের ওষুধ দেওয়ার পাশাপাশি খালের বর্জ্য অপসারণ করা।

এদিকে ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় বেড়েই চলেছে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ১০৪ জনের এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৫ হাজার ৩২৪ জন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন বেশ কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে যেসব ডেঙ্গু রোগী দেখা গেছে, তাদের বেশির ভাগই গত সপ্তাহে আক্রান্ত।

পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, জ্বর, মাথাব্যথা ও শরীর ব্যথা নিয়ে হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন অনেকে। তাদের একজন কবি নজরুল কলেজের আবাসিক শিক্ষার্থী বিপ্লব শেখ। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, চার দিন আগে ১০৩ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। ডাক্তার কিছু টেস্ট দিয়েছিলেন। পরে জানতে পারি ডেঙ্গু পজিটিভ।

এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, আমিসহ হলের আরও ১৫-২০ জনের এই অবস্থা। সবার জ্বর আর শরীর ব্যথা। কেউ ন্যাশনাল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আবার কেউ ঢামেকে গিয়েছে। আবার কেউবা বাড়ি চলে গেছে। হলের আঙ্গিনা অপরিষ্কার থাকায় মশার উপদ্রব বেড়েছে বলেও জানান এই শিক্ষার্থী।

আগে আশপাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত ওষুধ দেওয়া হতো। কিন্তু সেটা এখন আর চলমান নেই। সিটি করপোরেশনের লোকদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলে মশা তো এখন তেমন নাই। তাই কম দেওয়া হয়।

এদিকে অনেকে বলছেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২০২৫-২৬ অর্থবছরের অনুমোদিত বাজেটের চেয়ে তিনগুণেরও কম ডিএসসিসির মশক নিধনের বাজেট। সে তুলনায় এই বাজেট কিছুই না। মশক নিধনের জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জন্য বাজেট আরও বাড়ানো প্রয়োজন।

মশক নিধন ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ শাহজাহান মিয়া বলেন, মশক নিধন এবং ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে ইতোমধ্যে এডাল্টিসাইডিংয়ে ব্যবহৃত কীটনাশকের দৈনিক পরিমাণ মেশিন প্রতি ৩০ লিটার থেকে বাড়িয়ে ৬০ লিটারে উন্নীত করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, অঞ্চল ভিত্তিক বিশেষ পরিচ্ছন্নতা অভিযান, জনসচেতনামূলক কার্যক্রম ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা জোরদার করা হয়েছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা ও অঞ্চলভিত্তিক তদারকি টিম গঠন করা হয়েছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে বর্ষা মৌসুমের পূর্বে খাল, জলাশয় ও নর্দমা পরিষ্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং জলাবদ্ধতার হটস্পট চিহ্নিতপূর্বক তা নিরসনে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

যেই ওষুধে মশা মরে না সেই ওষুধ কেন কেনা হয় এমন প্রশ্নের প্রেক্ষিতে এই প্রশাসক বলেন, মশার ওষুধ কোনটা ব্যবহার করা হবে এটা আসলে আমাদের গবেষণা টিম দেখেন। এই টিমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আছেন। তারা যেই ওষুধ কেনার কথা বলেন আমরা তাই করি।