Image description
মেধাবী কর্মকর্তারা সচিব পদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন,জুলাই আন্দোলনের কর্মকর্তাদের অপরাধ কি!

প্রশাসনে উপদেষ্টা কমিটি ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের টানাটানিতে থমকে গেছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে নিয়োগ। তাদের টানাটানিতে বঞ্চিত-মেধাবী এবং দক্ষ কর্মকর্তারা সচিব পদে নিয়োগ পাচ্ছেন না। আবার কোনো কর্মকর্তাদের জন্য প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে থেকে সচিব পদে নিয়োগ দিয়ে সার-সংক্ষেপ অনুমোদন করলেও সেই কর্মকর্তার ফাইল আটকে অবসর দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে সচিব পদে বদলি করা হলেও যোগদান করতে দিচ্ছেন না উপদেষ্টারা। বিএনপিপন্থী কর্মকর্তারা চান সচিবপদে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার এপিএস শামসুল আলমের নিয়োগ। গত ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর প্রফেসর ড. ইউনূসের পরামর্শে প্রেসিডেন্টের আদেশে তাকে চাকরিতে পূনর্বহাল করা হয়। গত ২০২২ সাল থেকে তাকে সিনিয়র সচিব পদে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়া হয়। ৩৬ জুলাই থিমটিরও প্রবক্তা এবং জুলাই আন্দোলনে অন্যতম সংগঠক হিসেবে ছাত্র সমাজের কাছে সুপরিচিত তিনি। একজন মেধাবী ও বঞ্চিত কর্তকর্তা গত এক বছর ধরে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে শুরু করে উপদেষ্টা পরিষদ এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। কিন্তু কি কারণে সময় থাকতে পদোন্নতির আদেশ কার্যকর করা হয়নি, তার জবাব কেউ দিচ্ছেন না। শুধু শামসুল আলম নন, আরো শতাধিক কর্মকর্তাদের সচিব হওয়ার সকল যোগ্যতা থাকলেও তাদের আমলে নেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ বঞ্চিতদের। তাদের অভিযোগ, তারা নিয়োগ না পেলেও, নিয়োগ পাচ্ছেন ফ্যাসিস্ট সরকারের কর্মকর্তারা। গত ৩১ জুলাই তিন মন্ত্রণালয়ে সচিব পদে নিয়োগ হয়েছে। এর মধ্যে দুই ফ্যাসিস্ট আমলা যোগদান করতে পারলেও একজন করতে পারেননি। কি কারণে যোগদান করতে পারেননি সে বিষয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি বলে জানা গেছে।

অপরদিকে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। যেসব সংস্কার-প্রস্তাব মন্ত্রণালয় নিজ উদ্যোগেই বাস্তবায়ন করতে পারে, সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস।

এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশিদ ইনকিলাবকে বলেন, একটা সরকার গত ১৬ বছর প্রশাসনে একটি রেজিমে কাজ করেছে। সেটা ভাঙ্গতে সময় লাগবে। তারপর প্রশাসনে দ্রুত সচিব পদে নিয়োগ দেয়া হবে। আমরা জেনে শুনে যোগ্য কর্মকর্তাদের নিয়োগের জন্য সুপারিশ করছি। আমরা নির্বাচনের আগে নিরপেক্ষ প্রশাসন করতে কাজ করছি।

এদিকে গত ২০১৩-১৪ সালে সাতক্ষীরায় পুলিশের গুলিতে অর্ধশতাধিক বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মী হত্যার শিকার হয়। যার নেপথ্যে ছিলেন তৎকালীন পুলিশ সুপার চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির ও সাবেক ডিসি নাজমুল আহসান। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর তার আস্থাভাজন পুলিশ সুপার চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির দেশ থেকে পালিয়ে যায়। তবে বহাল তবিয়াতে আছেন হাসিনার অবৈধ নির্বাচন ও খুন গুমে অংশ নেওয়া পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বর্তমান সচিব নাজমুল আহসান। প্রশাসনে বহুল আলোচিত পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান আগামীকাল অবসরে যাচ্ছেন। গত এক বছরে বর্তমান সরকার তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না দেওয়া হলে কোন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সচিব নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হবে না। এ কারণে মন্ত্রণালয় ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে সচিব পদে নিয়োগ দিতে সার-সংক্ষেপ অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বদলি-পদায়ন ও পদোন্নতি বিষয়ক কমিটির উপদেষ্টাদের পছন্দ না হলে সে সচিব নিয়োগ হচ্ছে না। উপদেষ্টা কমিটির কয়েকজন ও জামায়াতের রাজনৈতিক তদবির থাকায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ছাড়াও অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সচিব পদ শুণ্য থাকলেও নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এক কথা প্রশাসনে সচিব পদে নিয়োগে ত্রিমুখী টানাটানি চলছে।

ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের আমলে অতিমাত্রায় দলীয়করণ এবং জনপ্রশাসনের সর্বস্তরে দুর্নীতির লাগামহীন বিস্তারের কারণে জনপ্রশাসন পরিণত হয়েছিল একটি অকার্যকর জনপ্রশাসনে। এ অকার্যকর জনপ্রশাসন ছাত্র-জনতার বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণে তছনছ হয়ে একটি ভঙ্গুর ও অস্থির জনপ্রশাসনে পরিণত হয়েছিল। জন-আকাক্সক্ষার রাষ্ট্র গঠনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কাজই হওয়া উচিত ছিল সঠিক কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে ভঙ্গুর ও অস্থির জনপ্রশাসন সুসংগঠিত করে বিরাজমান অস্থিরতা দূর করে জনস্বার্থে জনপ্রশাসনকে কাজে লাগানো। কিন্তু বাস্তবে কি তা হয়েছে? মনে হয় না। জনপ্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর জন্য যে রকম দূরদর্শিতা ও সঠিক কর্মপরিকল্পনার প্রয়োজন ছিল, তাতে যথেষ্ট ঘাটতি ছিল বলেই মনে হয়। প্রয়োজন ছিল দূরদর্শিতা ও সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতার সঙ্গে জনপ্রশাসনকে সাজানোর। প্রয়োজন ছিল ব্যক্তিগত পছন্দ থেকে বেরিয়ে এসে শীর্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে দক্ষ, যোগ্য, অভিজ্ঞ এবং ক্রাইসিস মোকাবিলায় পারদর্শী ও নেতৃত্বদানের গুণসম্পন্ন ব্যক্তিদের পদায়ন। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। জনপ্রশাসনের শীর্ষ পদগুলোয় পদায়নে ব্যক্তিগত পছন্দকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার পরিণতি এখন ভোগ করছে সমগ্র জনপ্রশাসন। জনপ্রশাসনকে সুসংগঠিত করার মতো যোগ্যতা ও দক্ষতা তারা দেখাতে পারেননি। তাদের অনেকের মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো গুণাবলিরও অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এছাড়া তাদের ক্রাইসিস মোকাবিলায়ও পারদর্শী বলে মনে হচ্ছে না বলে জানিছেন প্রশাসন বিষেশজ্ঞরা।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে সচিব, সিনিয়র সচিব ও সমমর্যাদার পদ রয়েছে ৮৪টি। এর মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিবসহ সিনিয়র সচিব ও সচিব পদে ১৭ জন কর্মকর্তা চুক্তিতে রয়েছেন। এর আগে শীর্ষ পদে একসঙ্গে এতসংখ্যক কর্মকর্তা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাননি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে, সিনিয়র সচিব ও সচিব পদে মোট ওএসডি আছেন ১২ জন। তবে বর্তমানে অন্যান্য পদে প্রশাসনে সবমিলিয়ে প্রায় ৫ শতাধিকের উপরে ওএসডি কর্মকর্তা রয়েছেন।

সরকারের সকল মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের পরিধি খুবই বড়। এ বিভাগের অধীনে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা, সরকারি বেসরকারি কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় শাখা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য নিয়োগ থেকে শুরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য কর্মকান্ডে মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা অপরিসীম। এছাড়াও সরকারি কলেজগুলোতে হাজার হাজার বিসিএস (শিক্ষা) ক্যাডার শিক্ষকরা কর্মরত রয়েছেন এই বিভাগের। এদের অনেকেই দেশের বড় বড় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের প্রিন্সিপাল ও ভাইস-প্রিন্সিপাল পদেই আছেন। তাদের মর্যাদাসহ সার্বিক বিষয়ে প্রশাসনিকভাবে দেখভাল করতে হয়। আবার অধীনস্থ দেশের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাশপাশি এমপিওভুক্ত বেসরকারি কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। বেসরকারি কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের লাখ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীদের দেখভালেও এই বিভাগ। শিক্ষাঙ্গনে উদ্ভুদ যে কোন পরিস্থিতি উত্তরণে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা এসে থাকে এখান থেকে। নির্বাহী ক্ষমতাবলে মন্ত্রণালয়ের সচিবই এখানকার আদেশ-নির্দেশনা জারি করে থাকেন। কিন্তু গত এক মাস ধরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ এই বিভাগ সচিব ছাড়াই চলছে। সেখানে সচিবের রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (কলেজ অনুবিভাগ) মোঃ মজিবর রহমান। গত ২১ জুলাই রাজধানী ঢাকা উত্তরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বাহিনীর জেট বিধ্বস্ত হওয়ার পর ছাত্রদের বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে ২২ জুলাই এই বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়েরকে প্রত্যাহার করা হয়। তারপর থেকেই পদটি শুন্য রয়েছে। সচিব না থাকায় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আটকে থাকছে। বিমান বিধ্বস্ত হয়ে রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে শিক্ষার্থী-শিক্ষক নিহত হবার ঘটনায় তদন্ত কমিটির কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। করণীয় বিষয়ে রুটিন সচিবের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নিতে সাহস পাচ্ছেন না। পাশপাশি যথাসময়ে এইএসসি শিক্ষার্থীদের ভর্তির নতুন সিদ্ধান্ত আসলে সেক্ষেত্রে করণীয় কি হবে, সে বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেয়া সচিবের রুটিন দায়িত্বে থাকা কোন কর্মকর্তার পক্ষে সম্ভব নয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে দ্রুত সচিব নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে যথাযথ নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপর যোগ্য কর্মকর্তাদের জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহ করা হয়। এ খবর জানাজানির পর দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলের সমর্থক কর্মকর্তাদের পক্ষে শুরু হয় তদবির। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ঘরনা ও বিসিএস নবম ব্যাচের কর্মকর্তা মো. সামসুল আলমকে চুক্তিতে সিনিয়র সচিব নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাব দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সার-সংক্ষেপ প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠানোর উদ্যোগও নেওয়া হয়। এর আগে শামসুল আলমকে সিনিয়র সচিব পদে নিয়োগ দিতে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান উপদেষ্টা স্বাক্ষর করেছেন। কিন্তু জনপ্রশাসন সচিব ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ তাকে সচিব হিসেবে নিয়োগ না দিয়ে তালবাহানা শুরু করে। গত নয় মাসে চাকরিরত অবস্থায় শামসুল আলম অবসর গ্রহণ করেন। এর আগেও অর্থ উপদেষ্টা তাকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছেন। কারণ তিনি আওয়ামী লীগের আমলে ১৮ বছর ধরে বঞ্চিত। তারপরও তার নিয়োগ কার্যকর করেনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব। শামসুল আলমের মতো একজন দক্ষ কর্মনিরপেক্ষ একজন কর্মকর্তাকে নিয়োগ না দেয়ায় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মাঝে অসন্তুষ্টতা বিরাজ করছে। এদিকে জামায়াত সমর্থক কর্মকর্তা এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব ড. খ ম কবিরুল ইসলামকে ওই বিভাগে সচিব হিসেবে পদায়নের জোর লবিং শুরু হয়। জামায়াত সমর্থক শিক্ষক নেতাদের যুক্তি হচ্ছে- কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব কবিরুল ইসলাম আগেও মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগে অতিরিক্ত সচিবের দায়িত্বে ছিলেন। সততা ও মেধার সাথে সেখানে অনেক ইতিবাচক কাজ করেছেন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক ট্যাগ লাগিয়ে তাকে পদোন্নতি বঞ্চিত করা হয়েছিলো। তাছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাজ করার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাই অভিজ্ঞ হিসেবে তাকে এই বিভাগে চুক্তিভিত্তিক সচিব নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সরকার একজন দক্ষ কর্মকর্তাও পাবে। শিক্ষা প্রশাসনে ইতিবাচক প্রভাব আসবে। অতিসম্প্রতি কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ থেকে অবসর উত্তর ছুটিতে (পিআরএল) গেছেন তিনি। তিনি বিসিএস একাদশ ব্যাচের কর্মকর্তা। তাকে এইবিভাগে সিনিয়র সচিব হিসেবে চুক্তিতে নিয়োগের জন্য জোর চেষ্টা করছে জামায়াত সমর্থক প্রভাবশালী কর্মকর্তারা।

অন্যদিকে বিএনপি সমর্থক শিক্ষক নেতারা বলছেন, বিসিএস নবম প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা মো. সামসুল আলম গত ১৮ বছর ধরে অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। যোগ্যতা ও মেধা থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক কারণে তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সহকারী একান্ত সচিব। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) থাকতে হয়েছে। সুতরাং তিনিই যোগ্য বলে মনে করছেন বিএনপি সমর্থক কর্মকর্তারা। এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দুটি দল থেকে বিভিন্ন সময়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে প্রভাবিত করা হচ্ছে। যে কারণে সচিব নিয়োগ দিতে পারছে না। তাই সব কিছু নির্ভর করছে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ওপর। প্রধান উপদেষ্টার চুড়ান্ত নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগে সচিব পদে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে অন্তর্বর্তী সরকার এই বিভাগে সচিব নিয়োগ দিতে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে গুরুত্বপূর্ণ এ বিভাগে সচিব নিয়োগ দেবে সরকার। কারণ এর আগেও সচিব নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক হওয়ায় সেই সমালোচনা থেকে মুক্ত হতে চাইছে সরকার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হবার পরে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ১৭ আগস্ট বিসিএস ৮২ ব্যাচের (প্রশাসন) অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ড. শেখ আব্দুর রশিদকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সচিব হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে সিনিয়র সচিব করা হয়। এরপর একই বছর অক্টোবরে তাকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে ২৫তম মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে দুই বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর নবম ব্যাচে অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব সিদ্দিক জোবায়েরকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রশাসনে বিএনপি পন্থী কর্মকর্তারা সচিব পদে নিয়োগ না পেলেও ইতোমধ্যে জামায়াতপন্থীরা বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে সচিব পদ বাগিয়ে নিয়েছে। জামায়াতপন্থী কর্মকর্তারা হলেন- মো. নজরুল ইসলাম, কে এম কবিরুল ইসলাম, খাদ্য সচিব মো. মাসুদুল হাসান, স্বাস্থ্য সচিব মো. সাইদুর রহমান, বিদ্যুৎ সচিব ফারজানা মমতাজ, আইএমইডি সচিব মো. কামাল হোসেন, পরিসংখ্যান সচিব আলেয়া আক্তার, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সংস্কার সচিব জাহেদা পারভিন, পিপিপি সচিব মো. রফিকুল ইসলাম, সংস্কৃতিক বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মফিদুর রহমান, স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মো. রেজাউল মাকসুদ জাহেদী। স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে নিয়োগ পাওয়ার জন্য তদবির করছেন। তাকে এক উপদেষ্টার ফোন দিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। এছাড়া ৪৭ উপাচার্যের মধ্যে ৩০ জন, এবং ৪০টির মধ্যে ১৮ জন প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর ও কোষাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত শিক্ষক সংগঠনের সদস্যদের নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের লবিংয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। আর চুক্তিভিত্তিক সচিব নিয়োগ নিয়ে প্রশাসনে নানান সমালোচনা রয়েছে। বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ রেজিমে তিনি সুবিধাভোগী কর্মকর্তা ছিলেন। তারপরও বিশেষ তদবিরে তিনি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এই বিভাগে সচিব হয়েছেন। গোটা প্রশাসনে নেতিবাচক আলোচনা থাকলেও তিনি সর্বদা প্রভাব বিস্তার করে চলতেন। তারই আমলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) পুস্তক ছাপাইয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তারই আমলে সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ ও শিক্ষক পদায়নে গড়ে ওঠে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। তাদের ইশারায় সবকিছুই পরিচালিত হতো। যে কারণে সরকার চাইছে ক্লিন ইমেজের কর্মকর্তাকে এই বিভাগে সচিব নিয়োগ দিতে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে যোগ্য ও দক্ষ কর্মকর্তাকে এই বিভাগে সচিব নিয়োগ দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে কয়েকজন কর্মকর্তার জীবনবৃত্তান্ত সরকারের জনপ্রশাসন বিষয়ক কমিটির কাছে জমা হয়েছে। খুব শিগগির পর্যালোচনা করে রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে থেকে সচিব নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা চলছে। শুধু এক বিভাগ নয়, অন্যান্য শুণ্য থাকা মন্ত্রণালয় ও বিভাগেও নিয়োগ দেওয়া হবে বলে সূত্র জানিয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের কার্যকরী সভাপতি ও সাবেক সচিব মো. আব্দুল খালেক বলেন, শুরু থেকেই আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে প্রশাসন পরিচালনায় নানাভাবে পরামর্শ ও সহযোগিতা করে এসেছি এবং এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। তবে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা কিছু উপদেষ্টা এবং কর্মকর্তার অদূরদর্শিতার কারণে প্রশাসনে লেজে-গোবরে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। ফ্যাসিবাদের দোসর সচিব ও চুক্তিভিত্তিক কর্মে নিয়োজিত বিতর্কিত কর্মকর্তাদের অপসারণ করা প্রয়োজন।