
শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী সুপ্তি আক্তার (২৫)। শুক্রবার রাতে সিলেট থেকে বাসে করে
ঢাকার বাসায় ফিরছিলেন। ভোরবেলা শনির আখড়া প্রধান সড়কে নেমে রিকশা করে বাসায় ফিরছিলেন। এ সময় ছিনতাইকারীরা চলন্ত রিকশা থেকে তার কাছে থাকা ব্যাগ টান দিয়ে নিয়ে চলে যায়। ব্যাগে নগদ টাকা, আইফোন ও জরুরি কাগজপত্র এবং আইডি কার্ড ছিল। ভোরবেলা সড়কে মানুষের যাতায়াতও কম ছিল। তাই তিনি কোনো ধরনের ব্যর্থ চেষ্টা না করে বাসায় ফিরে যান। ফার্মগেটের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন ফাতেমা বেগম। এই নারী অফিসে যাতায়াত করেন রিকশা করে। গত বৃহস্পতিবার তিনি অফিস শেষে বাসায় যাওয়ার জন্য রিকশা খুঁজছিলেন। ওইদিন ফার্মগেট এলাকার অলিগলিতেও রিকশা গাড়ির যানজট তীব্র। রিকশা খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে তার গলায় থাকা স্বর্ণের চেইনটি টান দিয়ে নিয়ে যায় এক ছিনতাইকারী। কোনো কিছু বুঝে ওঠা আর চিৎকার করার আগেই ছিনতাইকারী আশপাশের সবার চোখের সামনে দিয়ে পালিয়ে চলে যায়। ফাতেমা বলেন, অনেক বছর ধরে আমি একটি স্বর্ণের চেইন গলায় নিয়মিত ব্যবহার করি। ওইদিন বাসায় যাওয়ার তাড়া ছিল। তাই এদিক-সেদিক রিকশা খুঁজতে গিয়ে কেউ আমাকে ফলো করছে বা গলায় টান দিবে- এমনটা ভাবিনি। এই সুযোগে আমার শখের চেইনটা নিয়ে গেল। ভেবেছিলাম থানায় অভিযোগ করবো। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর না থাকায় আর অভিযোগ করিনি। তাই ওই আশা ছেড়ে দিয়েছি।
শুধু সুপ্তি ও ফাতেমা নন। রাজধানী ঢাকায় বেপরোয়া ছিনতাইকারীরা। দিন-দুপুরে, সন্ধ্যায়, মধ্যরাতে ভোরে সবসময়ই তারা রাজপথ থেকে শুরু করে অলিগলি পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রতিদিনই অহরহ মানুষ ছিনতাইকারীর কবলে পড়ছে। ভুক্তভোগীরা মূল্যবান জিনিসপত্রই যে হারাচ্ছে- তা নয়। অনেকেই ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে মৃত্যুবরণ করছেন। ছিনতাই ও প্রাণঘাতী ছিনতাই বেড়ে যাওয়ায় বিব্রত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও। ছিনতাইয়ের ডেঞ্জার জোন হিসেবে ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও-মিরপুর জোন পরিচিতি পেয়েছে। অন্যান্য বিভাগেও ছিনতাই হচ্ছে অহরহ। ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী থানা পুলিশের উদ্দেশ্যে বলেন, ছিনতাই বেড়ে গেলে মানুষ অনিরাপদ বোধ করে। ছিনতাই প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ডিএমপি গত ছয় মাসে ১ হাজার ৬০০ ছিনতাইকারী গ্রেপ্তার করেছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, ছিনতাইকারীরা এতটাই বেপরোয়া হয়েছে যে, ভুক্তভোগীরা ছিনতাইয়ের সময় বাধা দিলে তাদেরকে হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করছে না। ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে খুনের শিকার হয়েছেন এমন ঘটনা এখন অহরহ। কিন্তু নানা উদ্যোগ নিয়েও ছিনতাইকারীদের দাপট বন্ধ করা যাচ্ছে না। প্রায়ই থানা পুলিশ, র্যাব ও যৌথবাহিনী ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তার করে। কিন্তু ছিনতাইকারীরা কিছুদিন জেল খেটে জামিনে বের হয়ে আবার ছিনতাইয়ে নামে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশ যখন ছিনতাই মামলা করে তখন আইনি দুর্বলতার কারণে ফাঁকফোকর দিয়ে আসামিরা পার পেয়ে যায়। এছাড়া দীর্ঘদিনের পুরাতন ছিনতাইকারীর পাশাপাশি নতুন ছিনতাইকারীরাও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
ছিনতাইকারী নিয়ে একটি গোয়েন্দা সংস্থা প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ৮টি ক্রাইম জোন এলাকায় ৯৭২ ছিনতাইকারীর নাম উঠে এসেছে। সবচেয়ে বেশি ছিনতাইকারীর অবস্থান তেজগাঁও ও মিরপুর বিভাগে। ২২৩ ছিনতাইকারী তেজগাঁও বিভাগে। এছাড়া রমনা ও লালবাগ বিভাবে ২২০, ওয়ারী ও মতিঝিল বিভাগে ২০৫, গুলশান ও উত্তরা বিভাগে ১৬৭ জন ছিনতাইকারী দাপিয়ে বেড়ায়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, মোহাম্মদপুর থানা এলাকার তালিকাভুক্ত ছিনতাইকারীদের মধ্যে রয়েছে- চন্দ্রিমা মডেল টাউনের বাসিন্দা রাফসান হোসেন আকাশ, জেনেভা ক্যাম্পের মো. ইমতিয়াজ, আহম্মেদ হোসেন, মো. তাজ উদ্দিন, চাঁদ উদ্যান এলাকার মো. বাবলা ওরফে শাকিল, বাঁশবাড়ীর বাসিন্দা মো. মাসুদ পারভেজ। মোহাম্মপুর কৃষি মার্কেট ক্যাম্পের মো. আরমান ও মো. গনি। মোহাম্মদপুরের মো. বাদশা, মিরপুর দশ নম্বরের বাসিন্দা মো. রাজু, মোহাম্মদপুরের বুদ্ধিজীবী কবরস্থান এলাকার বাসিন্দা মহিউদ্দিন, চাঁদ উদ্যান এলাকার মো. পারভেজ, হাজারীবাগের বৌবাজারের বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন দুলু, রায়ের বাজার আজি খান রোডের রাসেল হাওলাদার, কাটাসুর এলাকার মো. শাকিল, আগারগাঁও ৯ নম্বর রোডের বাসিন্দা মো. আলামিন। এছাড়া হাজারীবাগের মো. রাব্বি।
তেজগাঁও থানা এলাকার ছিনতাইয়ের হটস্পটের মধ্যে অন্যতম সোনারগাঁও ক্রসিংয়ের সামনের এলাকা। এখানে চিহ্নিত ছিনতাইকারীদের মধ্যে অন্যতম বরিশালের বাকেরগঞ্জের আমতলী গ্রামের মো. শরীফ। নোয়াখালীর সেনবাগ থানার ইটবাড়ি গ্রামের মো. সাব্বির। এছাড়া নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থানার লদুরচর গ্রামের মো. রাসেল (বর্তমান বাসা তেজগাঁও তেজকুনিপাড়া)। কাওরান বাজার সিএ ভবনের সামনে সক্রিয় ছিনতাইকারীদের মধ্যে আছে-মাদারীপুরের কালিকাপুরের মেহেদী হাসান ওরফে সালমান শরীফ, বরিশালের হিজলা থানার আবুপুর গ্রামের মো. জমি আহম্মেদ, বরিশালের মুলাদী থানার চরমারিয়া ইমন ইসলাম মাসুদ। তেজগাঁও রেলস্টেশনের আশপাশের চিহ্নিত ছিনতাইকারীদের মধ্যে আছে, হাফিজ উদ্দিন, মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম। ফার্মগেট আনন্দ সিনেমা হলের আশপাশের এলাকার ছিনতাইকারীদের মধ্যে অন্যতম মো. সোহেল, সাইফুল ইসলাম মিশু ও সজীব খান। ডিএমপি’র ওয়ারী বিভাগের যাত্রাবাড়ী থানা এলাকায় পুলিশের তালিকাভুক্ত ছিনতাইকারীদের মধ্যে রয়েছে-আসলাম মিয়া, পিচ্চি জনি, নাটাই সোহেল, রাসেল, মিলন, শাহীন, সাইফুল ইসলাম, আতিকুর রহমান সুমন, রুবেল ওরফে সোলেমান, সাইফুল, উজ্জ্বল, আব্দুর রউফ, মো. সুজন, মো. সাগর, সজল, জুয়েল, কৌশিক সরদার, শাহীন আলম ও মহিউদ্দিন।
মিরপুরের শাহ্ আলী থানা এলাকার ছিনতাইকারীদের মধ্যে অন্যতম- রূপনগরের তানভীর, পল্লবীর নয়ন ও শুভ, সাভারের সুজন শেখ, মানিকগঞ্জের ফারুক হোসেন। কল্যাণপুর এলাকায় সক্রিয় রয়েছে-রমজান আলী, রিপন, রাকিব; গাবতলী এলাকার- সজীব, জাফর, লিমন, পল্লবী এলাকায়- ফয়সাল, হাবিবুর রহমান, আক্তার, শান্ত, নাদিম। গুলিস্তান, ফুলবাড়ীয়া, বাবুবাজার ব্রিজ, নয়াবাজার, তাঁতীবাজার এলাকায় সক্রিয় ছিনতাইকারীদের মধ্যে রয়েছে-মুগদার শাওন, কেরানীগঞ্জের ফারুক, মুন্সীগঞ্জের জয়, কেরানীগঞ্জের ইয়ামিন হোসেন রাজু, কোহিনূর বেগম, ফুলবাড়ীয়ার লোকমান পাঠান। মতিঝিলের ত্রাস মো. বাবুল। সে কমলাপুর রেলস্টেশন, খিলগাঁও রেলগেট ও মালিবাগ এলাকার ছিনতাইয়ের নিয়ন্ত্রক। এক দশকের বেশি সময় ধরে ছিনতাই করে চলেছে বাবুল। তার বিরুদ্ধে ডিএমপি’র শাহজাহানপুর থানায় ২০১৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তিনটি ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। একই এলাকার চিহ্নিত ছিনতাকারী মো. শাহাদত ও ভাতে মরা রবিন। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে তিনটি করে ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। একই এলাকার ছিনতাইকারী শাওন গাজী ও বিল্লাল ওরফে ওস্তাদ বিল্লালের বিরুদ্ধে দু’টি করে ছিনতাই মামলা রয়েছে।
ছিনতাইকারীর ওই তালিকায় একেবারে নতুন কিছু মুখও রয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে এখনো কোনো মামলা হয়নি। তালিকা ঘেঁটে দেখা গেছে, ৯৭২ ছিনতাইকারীর মধ্যে ২০৭ জনের নামে রাজধানীর কোনো থানায় মামলা নেই। অর্থাৎ ছিনতাইকারীদের ২১.২৯ ভাগই নতুন। মাঠপর্যায়ে কাজ করা পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ছিনতাইয়ে অংশ নেয়া নতুন মুখই বেশি ভয়ঙ্কর। এরা এক এলাকায় অপরাধ করে অন্য এলাকায় আত্মগোপনে চলে যায়। তাদের খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয়। এদের মধ্যে নিউ মার্কেট এলাকায় আছে- ওলি, মেহেদী, রাব্বি, ইসমাইল, সোহেল। উত্তরা এলাকার- রিফাত, সাব্বির, সম্রাট, মাহাবুব, মিলন, সাকিব, নাসিম, নাজমুল ইসলাম, পিচ্চি বাবু, জিম, নুর আলী, পরাগ প্রমুখ। এদিকে নতুন ছিনতাইকারীদের একটি বড় অংশ সাভার ও গাজীপুর থেকে রাজধানীতে এসে ছিনতাই করে ফের চলে যাচ্ছে। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে চিহ্নিত করেছেন গোয়েন্দারা। গাজীপুর থেকে আসাদের মধ্যে আছে- সুজন, আব্দুল হক, আওয়াল, জলিল, ছুটন, মনির সুজন প্রমুখ।
সাভার থেকে আসাদের মধ্যে- আমিরুল, শিপলু, আক্কাস, রেশমা, সুমন, রবিউল ইসলাম, গোলাম মোস্তফা অন্যতম। ছিনতাইয়ে যুক্ত নতুন মুখের মধ্যে মতিঝিল ও ওয়ারী বিভাগে সক্রিয়দের মধ্যে অন্যতম, সায়েদাবাদ এলাকার বাসিন্দা মো. লিটন, মুগদা এলাকার মো. সাব্বির হোসেন ওরফে রাজন, আরামবাগের সুমন মিয়া, ভাসমান আতিকুল ইসলাম, এজিবি কলোনির খোরশেদ আলম, শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির ভাসমান রফিকুল ইসলাম বাবু, ফকিরাপুলের হেলাল, বাগিচা জামে মসজিদ এলাকার মো. রুবেল, হাজারীবাগের সাগর, যাত্রাবাড়ীর মো. সজল। এছাড়া ভাসমান কিছু ছিনতাইকারী আছে মতিঝিল এলাকায়। এদের মধ্যে অন্যতম- রনি, রাসেল, মনির, ইসমাইল, মো. তারেক প্রমুখ। মিরপুরে ছিনতাইয়ে যুক্ত নতুন মুখের মধ্যে রয়েছে- দারুস সালামের জুয়েল, রবিন, সজীব, সোহেল। শাহ্ আলী এলাকার- শাতীল, জীবন, ইয়াসিন। পল্লবী এলাকার- সুমন, সোহেল, আপন, রবিন, সজলসহ আরও বেশ কয়েকজন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, ছিনতাইকারীদের ধরতে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। প্রতিনিয়তই আমরা ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তার করছি। ব্লকরেইড পরিচালনাও করা হয়। তেজগাঁও বিভাগ থেকে প্রায় প্রতিদিনই ছিনতাইকারী গ্রেপ্তার করা হয়।