Image description

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাক্ষাত এবং বৈঠককে ঘিরে মানুষের মনে সৃষ্টি হয়েছে নানা প্রশ্ন। উদ্রেক করেছে সন্দেহের। কেন তারা সেখানে গেলেন? কী নিয়ে আলোচনা করলেন? অ্যাজেন্ডাই বা কি ছিল আলোচনার? স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের একটি কমিশনের কর্মকা- কেন যুক্তরাষ্ট্রকে অবহিত করতে হবে? তবে কি পশ্চিমের ইশারায় চলছেন তারা? নাকি পশ্চিমা এজেন্ডা বাস্তবায়নের যে গুঞ্জন বাজারে রয়েছে, সেটিরও দৃশ্যমান মঞ্চায়ন এটি? এমন বহু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের রাজনীতিসচেতন মানুষের মনে। তবে আইনজ্ঞ ও রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ঐকমত্য কমিশনের উচিত যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং আলোচনার বিষয়বস্তু জাতির সামনে খোলাসা করা। কেন তারা সেখানে গিয়েছিলেন? কী কথা বলে এলেন?

কমিশন সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ১২ আগস্ট জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজের নেতৃত্বে কমিশন সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। রাজধানীর গুলশানে মার্কিন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কমিশনের তরফ থেকে জানানো হয়, মার্কিন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের আমন্ত্রণে বৈঠকে কমিশনের সদস্য সচিব ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার ও মার্কিন দূতাবাসের রাজনৈতিক বিভাগের প্রধান এরিক গিলান এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

তবে কমিশন একটি সূত্র জানায়, ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন এবং কমিশনের মধ্যকার সাক্ষাৎ ও বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছে কমিশনের আগ্রহে। জ্যাকবসন এর আগে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও দেখা-সাক্ষাৎ করেছেন। তাদেরকে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিল ঐকমত্য কমিশনের ক্ষেত্রে। ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে কমিশনের আগ্রহে মার্কিন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।

ঐকমত্য কমিশন জানায়, ওই বৈঠকে সংস্কার, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন, ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে জাতীয় সনদসহ বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর চলমান সংলাপের অগ্রগতি ও পরবর্তী পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু বিশ্লেষকদের ব্যাখ্যা ভিন্ন রকম।

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট, রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনজিল মোরসেদ বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের কিছুদিন পর যারা পটপরিবর্তন করেছেন তারাই বলছিলেন, একটি দেশের (ভারত) আধিপত্যবাদ থেকে জাতিকে মুক্ত করা হয়েছে আরেকটি দেশের কর্তৃত্ব ও অধীনে যাওয়ার জন্য নয়। আমরা অন্য কোনো সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির হাতের পুতুল হতে চাই না। যারা এ কথাগুলো বলেছিলেন তখন হয়তো তাদের হাতে এমনটি মনে হওয়ার মতো তথ্য-প্রমাণ ছিল। সাধারণ মানুষ তখন বিষয়টি তখন হালকাভাবে নিয়েছে। কিন্তু যাদের বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারেন তারা তখনই বুঝে গিয়েছিলেন অন্তর্বর্তী সরকার কাদের নিয়ে গঠিত হয়েছে। তাদের ওপর কোন দেশের প্রভাব রয়েছে। বিশ্লেষকরা বুঝে গিয়েছিলেন, বিদেশি নাগরিক ড. আলী রীয়াজের মতো ব্যক্তিদের নিয়ে কেন সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে? ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারে কেন অধিকাংশই বিদেশি নাগরিক, দ্বৈত নাগরিক কিংবা পশ্চিমা সাহায্যপুষ্ট এনজিও নেত্রীদের নিয়ে গঠিত হয়েছে। কী কারণে এই ঘটনাগুলো ঘটেছে। আলী রীয়াজরা কাদের স্বার্থে কী কারণে সংস্কারের প্রস্তুবগুলো দিচ্ছেন।

সুপ্রিম কোর্টের এ আইনজীবী অতীতের পটপরিবর্তনগুলোর প্রেক্ষাপট এবং পরবর্তী পরিস্থিতি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যা করার পর কোন দেশের রাষ্ট্রদূতদের বেশি মাত্রায় তৎপর দেখা গেছে। এরশাদ সরকারের পতনের পরও আমরা দেখেছি কারা এ দেশে ঘোরাঘুরি করেছে। কিন্তু এবারই প্রথম দেখলাম, বাংলাদেশ কিভাবে পরিচালিত হবেÑ এ বিষয়ে একটি মাত্র দেশই দৌড়ঝাঁপ করছে। পরিকল্পনা দিচ্ছে। নানারূপ তত্ত্ব-তালাশ করছে। লক্ষ করুন, সংস্কারের কমিশনগুলোতে থাকা ব্যক্তিদের লিঙ্কগুলো কিন্তু এক জায়গায়। এই লিঙ্ক স্থাপিত হয়েছে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার পর। ছাত্ররা যখন বলেছিল, ভারতীয় আধিপত্যবাদ থেকে বেরিয়ে এসেছি মার্কিনিদের আধিপত্য মেনে নেয়ার জন্য নয়। তখন কিন্তু ছাত্ররাও বুঝতে পারেনি। এটি এখন দৃশ্যমান। ভারপ্রাপ্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক এমনটিই নির্দেশ করছে।

মনজিল মোরসেদ বলেন, ২০০৬ সালে বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন দেশের হাইকমিশনারদের একটি সম্মিলিত উদ্যোগ ছিল বাংলাদেশকে ভালো করার। তা সত্ত্বেও আমরা সেটিকে ভালোভাবে নেইনি। এখনো সেটিকে অন্য দৃষ্টিতে দেখি। অথচ এখন দেশের রাজনীতি ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি নির্ধারণে একটিমাত্র দেশের তৎপরতা দেখছি। এতে মানুষের মরে উদ্বেগ ও সন্দেহ প্রথিত হচ্ছে। দেখুন, পরপর কতগুলো ঘটনা আমরা লক্ষ করলাম। দু’টি পক্ষের মধ্যে বিবদমান মিয়ানমারে ‘মানবিক করিডোর’ দেয়ার চেষ্টা দেখলাম। চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ বিদেশিদের হাতে তুলে দেয়ার চেষ্টাও লক্ষ করলাম। চরম অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যেও আমরা উড়োজাহাজ কেনার আলোচনা দেখছি। অর্থাৎ একটি দেশকে এক ধরনের ঘুষ দেয়া হচ্ছে। এসব কারণে মানুষের মনে চিন্তা ঢুকেছে যে, বাংলাদেশিরাই রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন কি-না! এ ছাড়া বিভিন্ন কমিশন এবং সরকারের উপদেষ্টা পদে রয়েছেন বিদেশি এবং দ্বৈত-নাগরিক। কিন্তু বিদেশি নাগরিক এবং দ্বৈত-নাগরিকদের কর্তৃত্ব এবং ছড়ি ঘোরানো নিয়ে রাজনীতিকরা কেন কিছু বলছেন না, এটি আমার বোধগম্য নয়। অন্তত বড় রাজনৈতিক দলগুলোর তো উচিত এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ও শক্ত অবস্থান নেয়া।

ঘোষিত সময়ে নির্বাচন এবং নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করে এই আইনজীবী বিশ্লেষক বলেন, যারা ক্ষমতায় আসবেন তারা সুষ্ঠু নির্বাচন এবং মানুষের ভোটেই নির্বাচিত হবেন। তাদের তো বিদেশি কোনো শক্তির ওপর ভরসা করার কারণ দেখি না। পতিত আ.লীগ সরকারের সময় না হয় বিষয়টি তেমন ছিল। এখন তো কোনো দেশের আশীর্বাদ পাওয়ার বিষয় নেই। নির্বাচনে দুই নম্বরি করারও সুযোগ নেই। তারা তো দেশের মানুষের মেন্ডেট পেয়েই ক্ষমতায় আসবেন। তাহলে বড় রাজনৈতিক দলগুলো কেন পশ্চিমা কর্তৃত্ব ও আধিপত্যকে প্রশ্রয় দিচ্ছে? তারা কেন শক্ত ভাষায় বিদেশিদের বলছেন না যে, এখানে নাক গলাতে আসবেন না! যদি রাজনীতিকরা এটি বলতে না পারেন তাহরে ক্ষমতার শুধু হাত পরিবর্তন হবে। মানুষ ও তথা দেশের কোনো পরিবর্তনই আসবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকের প্রসঙ্গ টেনে মনজিল মোরসেদ আরো বলেন, তারা (ঐকমত্য কমিশন) যেটি করেছে তা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে মোটেই সমীচিন হয়নি। আগেও বলেছি, এখনো বলছি। রাজনীতিবিদদের সামনে সময় এসেছে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ, কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের প্রশ্নে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করার।

অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ মো. মঈদুল ইসলামের মতে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সরকার কর্তৃক গঠিত। নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে সংস্কার প্রস্তাব তুলে ধরার জন্য এসব কমিশন গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছে। এটিই করার কথা। কিন্তু বাইরের কোনো রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনার কী আছে? যেহেতু তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক করতে গেছেন সেহেতু কমিশনের উচিত জাতির সামনে বিষয়টি খোলাসা করা। কোন উদ্দেশ্যে তারা সেখানে গেছেন? কী ধরনের আলাপ-আলোচনা হয়েছেÑ মানুষের মনে এ প্রশ্নগুলো উঠছে। মানুষের মনে সন্দেহের উদ্রেক করেছে। নানা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। এ কারণে দেশবাসীর কাছে পরিষ্কার করা দরকার, ঐকমত্য কমিশন কেন মার্কিন দূতের কাছে গিয়েছিলেন। বিষয়টি মোটেই ভলো দেখায়নি। এ বিষয়ে মানুষকে ধারণা দেয়া উচিত।

মঈদুল ইসলামের মতে, পশ্চিমা স্বার্থেই এ কমিশন কাজ করেছে কি-না এ প্রশ্ন মানুষের মনে সন্দেহের উদ্রেক করেছে।
 
প্রসঙ্গত, গত ১২ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সাত সদস্যের ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ গঠন করে সরকার। ওই কমিশন ইতোপূর্বে গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বিবেচনা ও গ্রহণের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতামত সাপেক্ষে সুপারিশ প্রণয়ন করবে। কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেনÑ সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান আলী রীয়াজ, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন, নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান বিচারপতি এমদাদুল হক ও দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান।
 
ছয় মাস মেয়াদি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যক্রম শুরু করে। কমিশন নির্বাচনকে সামনে রেখে পুলিশের কার্যক্রমসহ, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ এবং দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনগুলোর সুপারিশ বিবেচনা ও গ্রহণের জন্য জাতীয় ঐকমত্য গঠনের জন্য রাজনৈতিক দল ও শক্তিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছে। এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করেছে।