Image description

অন্যের মুক্তিযোদ্ধা সনদে দিব্যি সরকারি চাকরি করছেন বগুড়ার শিবগঞ্জের তফির আলী। তিনি বর্তমানে বগুড়ার কাহালু উপজেলা কৃষি অফিসে ‘উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা’ হিসেবে কর্মরত আছেন। তফির আলী যে ব্যক্তিকে নানা হিসেবে উল্লেখ করে তার মুক্তিযোদ্ধার সনদ ব্যবহার করেছেন সেই নানা তাকে নাতি হিসেবে অস্বীকার করেছেন। তফির আলীর মা’কে ওই মুক্তিযোদ্ধা চেনেন না।

২০১৭ সালে তফির আলী জালিয়াতির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধার নাতি কোটায় চাকরিতে যোগ দেন। এর কিছুদিন পর তার জালিয়াতির বিষয়ে গুঞ্জন ওঠে। বিভিন্নভাবে তার বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে। কিন্তু তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকারের আজ্ঞাবহ দপ্তরগুলোকে অর্থ দিয়ে দমিয়ে রেখেছিলেন বিষয়টি। তফির বিষয়টি স্বীকারও করে বলেছেন, এসব অভিযোগে চাকরি যাবে না। তিনি তার কাগজপত্র সব ঠিকঠাক করেছেন। তার কিছুই হবে না। 

মানবজমিন’র দীর্ঘ অনুসন্ধানে তফির আলীর জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে। অনুসন্ধানে জানা যায়, বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার পীরব ইউনিয়নের দাইমুল্যা গ্রামের তফির আলী অন্য একজন মুক্তিযোদ্ধার সনদ ব্যবহার করে জালিয়াতির মাধ্যমে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা পদে চাকরি নিয়েছেন। তফির আলী দাইমুল্যা (নড়িয়াল) গ্রামের মো. জাফের আলী সরকার এবং মোছা. হাসিমন বেগম দম্পতির ছেলে। গত ২০১৭ সালের ৩১শে জানুয়ারি কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের পুত্র-কন্যা এবং পুত্র-কন্যার পুত্র-কন্যাদের নিকট থেকে আবেদন চাওয়া হয়। সেখানে চতুর তফির আলী বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার আটমুল ইউনিয়নের কঞ্চিথল গ্রামের বীরমুক্তিযোদ্ধা নবীর উদ্দিন আকন্দের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ব্যবহার করেন। তিনি নবীর উদ্দিনকে তার নানা হিসেবে দেখান। তফির আলী নিজের মা মোছা. হাসিমন বেগমকে মুক্তিযোদ্ধা মো. নবীর উদ্দিন আকন্দের কন্যা হিসেবে উল্লেখ করেন। পরে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় তফির আলী উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা পদে চাকরি হয়ে যায়। 

তফির আলী তার মা হাসিমন বিবিকে মুক্তিযোদ্ধা নবীর উদ্দিনের কন্যা দেখিয়ে পীরব ইউনিয়ন পরিষদের প্যাডে মিথ্যা প্রত্যয়নপত্র তৈরি করে জমা দেয়। পরে মুক্তিযোদ্ধা নবীর উদ্দিন আকন্দ তফির আলীর নানা কি না তার সত্যতা নিশ্চিত হতে শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাচন অফিসে মা হাসিমন বেগমের জাতীয় পরিচয় পত্র তল্লাশি করা হয়। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী, হাসিমন বেগমের পিতার নাম হাতেম আলী, মাতা: জয়গুন বিবি, জন্ম: ৩০/০৬/১৯৪৭ ইং, ঠিকানা: দাইমুল্যা (নড়িয়াল), পীরব, শিবগঞ্জ, বগুড়া।

শিবগঞ্জের পীরব ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আসিফ মাহমুদ ও দাইমুল্যা (নড়িয়াল) গ্রাম অন্তর্ভুক্ত ৬ নং ওয়ার্ড ইউপি মেম্বার আকরাম হোসেনের স্বাক্ষরিত হাতেম আলীর ওয়ারিশ সনদ অনুসারে দেখা যায়, হাতেম আলী হাসিমন বেগমের প্রকৃত পিতা অর্থাৎ তফির আলীর আসল নানা।

৬নং ওয়ার্ড মেম্বার আকরাম হোসেন নিশ্চিত করে মানবজমিনকে বলেন, তফির আলী হাসিমন বেগমের পুত্র অর্থাৎ হাতেম আলীর নাতি। মুক্তিযোদ্ধা নবীর উদ্দিন আকন্দ তফির আলীর নানা নন। আমার জানামতে, মুক্তিযোদ্ধা নবীর উদ্দিন আকন্দের সঙ্গে তফির আলীর কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই।
এ বিষয়ে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা তফির আলীর সঙ্গে দেখা করলে তিনি বলেন, এ রকম কেস সারা বাংলাদেশে হাজার হাজার আছে। সকল ডিপার্টমেন্টেই আছে। আমার কাগজপত্র সব ঠিকঠাক করা আছে। অভিযোগ দিলেই চাকরি যাবে না। তিনি বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা) আসনের সাবেক এমপি ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মরহুম আব্দুল মান্নানের নাম উল্লেখ করে বলেন, ’সারিয়াকান্দিতে মান্নান এমপি শত শত লোক পুলিশে ঢুকিয়েছেন। তাদের একজনেরও বৈধ কাগজপত্র ছিল না। পরে সব কাগজপত্র তৈরি করা হয়েছে।

পরে মুক্তিযোদ্ধা সনদ কীভাবে জালিয়াতি করতে হয় সেই কৌশল জানাচ্ছিলেন তফির আলী। তিনি বলেন, ‘এখানে মেইন ফ্যাক্ট হলো আইডি (এনআইডি)। যেমন, আমি দেখাচ্ছি আমার মা হলো নবীরের মেয়ে। আমার মায়ের পিতার নাম যদি নবীর উদ্দিন থাকে, আর আমার মায়ের আইডি’র সঙ্গে আমার সম্পর্ক আছেই। সেই অনুসারে যদি ওয়ারিশ নামার সার্টিফিকেট থাকে তাহলে তো কথাই নেই। যার কিছুই নেই সে আইডি সংশোধন করে নেবে। টাকা হলে ভাই সবই হয়।’

তফির আলী নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা নবীর উদ্দিন আকন্দের নাতি প্রমাণ করতে তার মা হাসিমন বেগমের এনআইডি পরিবর্তনের জন্য আবারো জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। নবীর উদ্দিনই তার নানা এটা প্রমাণ করতে তফির আলী তার মা হাসিমন বেগমের জন্ম নিবন্ধনের একটা হার্ড কপি দেখান, যেখানে হাসিমন বেগমের পিতা হাতেম আলীর পরিবর্তে নবীর উদ্দিন আকন্দের নাম দেয়া হয়েছে। জন্ম নিবন্ধনটি প্রস্তুত করা হয়েছে এ বছরের ১৯শে ফেব্রুয়ারি।
কথা হয় বীরমুক্তিযোদ্ধা নবীর উদ্দিন আকন্দের সঙ্গে। তিনি হাসিমন বিবি নামে তার কোনো মেয়ে নেই মর্মে সাফ জানিয়ে দেন। তফির আলী নামে কোনো নাতিও নেই তার। তফির আলী নামে কাউকে তার মুক্তিযোদ্ধা সনদও দেননি।