
গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময়ে আন্দোলনকারীদের তোপের মুখে পুলিশ বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল। সরকার পতনের খবরে সেদিন সারা দেশে থানা ও ফাঁড়িগুলো এক পর্যায়ে পুলিশ শূন্য হয়ে পড়ে। সে সুযোগে দুষ্কৃতকারীরা বাহিনীটির হাজার হাজার আগ্নেয়াস্ত্র লুট করে নিয়ে যায়। নতুন সরকার গঠনের পর এসব লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে দফায় দফায় অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলারক্ষা বাহিনী। বিভিন্ন অভিযানে এসবের একটা অংশ উদ্ধার হলেও প্রায় দেড় হাজার আগ্নেয়াস্ত্র এখনও পাওয়া যায়নি। এসব অস্ত্র অপরাধীদের হাতে চলে গেছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ইতোমধ্যে নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। তবে পুলিশের খোয়া যাওয়া অস্ত্র ব্যবহার করে দুর্বৃত্তরা নির্বাচনে সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে চাপের মধ্যে রাখতে পারে। এসব অস্ত্র আগামী জাতীয় নির্বাচনে ভোটের মাঠে প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু করতে যত চ্যালেঞ্জ রয়েছে এর অন্যতম এসব লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করা। এসব অস্ত্র যদি উদ্ধার করা সম্ভব না হয় তাহলে নির্বাচনকে ঘিরে বাড়তে নিরাপত্তা শঙ্কা। একই অনুমান পুলিশেরও।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের ঘটনায় থানা ও ফাঁড়ি মিলে পুলিশের মোট ৫৭৪টি স্থাপনায় হামলা ও লুটপাট হয়। খোয়া যায় রাষ্ট্রের ৫ হাজার ৭৫৩টি অস্ত্র এবং ৬ লাখ ৫১ হাজার ৮৩২ রাউন্ড গোলাবারুদ। গত বছরের সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া অভিযানে ফেরত আসে ৪ হাজারের বেশি অস্ত্র এবং প্রায় ৪ লাখ রাউন্ড গোলাবারুদ। তবে এখনও উদ্ধার হয়নি প্রায় দেড় হাজার আগ্নেয়াস্ত্র।
গত ৯ আগস্ট রাতে রাজধানীতে বড় অভিযান চালিয়েছে সেনাবাহিনী। রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার কয়েকটি দোকান ও গুদামে অভিযান চালিয়ে প্রায় ১ হাজার ১০০টি ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনী। এ সময় এসব অস্ত্র বিক্রি ও সরবরাহের সঙ্গে জড়িত ৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
পাশাপাশি লুট হওয়া এসব অস্ত্র উদ্ধারে কাজ করছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। পুলিশের এই ইউনিট জানিয়েছে, পুলিশের স্থাপনা থেকে জুলাই-আগস্টে ডিএমপির প্রায় ১ হাজার ৯০০’র মতো অস্ত্র লুট হয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার ২০০’র কিছু বেশি উদ্ধার করা হয়েছে। ডিএমপি আশা করছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে সব ধরনের অস্ত্র উদ্ধারের।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম ও জনসংযোগ শাখার উপ-কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমরা আশা করি, নির্বাচনের আগে সুষ্ঠু ও সুন্দর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির পূর্বশর্তগুলো আমরা পূরণ করতে সক্ষম হবো। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে আমাদের অভিযান চলমান আছে।
এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান চলমান রয়েছে। দেশব্যাপী অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশের তৎপরতা অব্যাহত আছে। ইতোমধ্যে আমরা লুট হওয়া অনেক অস্ত্র উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি। বাকি অস্ত্রগুলো উদ্ধারেও কাজ করছে পুলিশ।
এছাড়া সারা দেশে বিশেষ করে অপরাধপ্রবণ এলাকায় পুলিশের বিশেষ টহল ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। অপরাধীদের গ্রেফতারে গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। দেশের বড় বড় শহর ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে অপরাধীদের আটক করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সরকারের চেষ্টার পরও অস্ত্র উদ্ধারে সেগুলো যথাযথ হয়নি। সরকারি অস্ত্র লুট হয়েছে, বাস্তবতার নিরিখে গোয়েন্দা সংস্থাকে আরও বেশী সক্রিয় করে, সেনাবাহিনী নিজস্ব ও তাদের যে ইউনিটগুলো রয়েছে তাদের সক্রিয় করে অভিযান চালাতে হবে। তাহলে এসব অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব। নতুবা এসব অস্ত্র দুর্বৃত্তরা ব্যবহার করে আগামী নির্বাচনে সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে চাপের মধ্যে রাখবে। পাশাপাশি জনগণ বা ভোটারদের মাঝেও আতঙ্ক থাকবে। যার কারণে নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতের বিষয়টিও অনিশ্চিত থাকবে।
এই অপরাধ বিশ্লেষক আরও বলেন, অস্ত্রগুলো যারা নিয়েছে তারা তো ভুল করে নেয়নি। যারা নিয়েছে তারা পরিকল্পনা করে নিয়েছে। তাদের আলাদা একটা উদ্দেশ্য আছে। সেটা তাদের অপরাধমূলক কাজে অস্ত্রগুলো ব্যবহার করবে। অস্ত্র উদ্ধারে সরকারের পুরস্কার ঘোষণার যে কৌশল সেটা খুব একটা কাজে দেবে না। পুরস্কারে সাড়া দেবে না অপরাধীরা। আমি বলবো, শুধু অস্ত্র উদ্ধারের জন্য সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ অভিযান পরিচালনা করতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য ইউনিটের পাশাপাশি সেনাবাহিনী যদি সারা দেশে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে তাহলে একটা ফলাফল পাওয়া যাবে।
এর আগে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সোমবার (১১ আগস্ট) সাংবাদিকদের বলেন, ‘যতটা সম্ভব আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করার চেষ্টা করে যাচ্ছি, যদিও কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারিনি। আমরা অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করে যাচ্ছি। যে তথ্য দিতে পারবে, তাকে আমরা পুরস্কারও দেবো।’ কতগুলো অস্ত্র এখনও উদ্ধার হয়নি, এমন প্রশ্নের জবাবে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, সাত শো’র বেশি। তবে সঠিক সংখ্যা এখনও জানা যায়নি।