Image description

বুক চাপড়াতে চাপড়াতে কাঁদছিলেন বৃদ্ধ লালিচা দাস। দুই নাতি-নাতনি রূপা আর জয় দাসের হাত ধরে চিৎকার করে জানতে চাইছেন তার ছেলেকে কেন পিটিয়ে মেরে ফেলা হলো। মা আহাজারি করে বলছিলেন ‘মোর একটায় ছাওয়া (ছেলে) বাবা, তাক মারি ফেলাইলো? মোর ব্যাটার দোষ কী? কেন মানুষ ওকে ডাংগে মারি ফেলাইলো। এখন হামাক কায় দেখপে। ছইল দুইটার কী হইবে? যায় মোর ব্যাটাক মারছে, তার বিচার চামো।’

রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলায় ভ্যানচোর সন্দেহে পিটিয়ে দুই ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে। শনিবার রাত ৯টার দিকে উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের বুড়িরহাট বটতলা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত ব্যক্তিরা হলেন উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর এলাকার বাসিন্দা রূপলাল দাস (৪০) ও মিঠাপুকুর উপজেলার বালুয়াভাটা গ্রামের প্রদীপ দাস (৩৫)। প্রদীপ দাস সম্পর্কে রূপলাল দাসের ভাগ্নির স্বামী ছিলেন। পরিবার সূত্রে জানা গেছে, রূপলাল দাস জুতা সেলাইয়ের কাজ করতেন। আর প্রদীপ দাস ভ্যান চালাতেন।

গতকাল রোববার বিকেলে ঘনিরামপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, রূপলালের বাড়িতে চলছে শোক আর আহাজারি। পরিবারের সদস্যরা বলছেন, এমন নির্মমতার শিকার হবেন, তারা কখনো ভাবেননি। জীবনের সব আশা-আকাঙ্ক্ষা যেন মাটিচাপা পড়ে গেছে। আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী এবং দূরদূরান্ত থেকে আসা মানুষজন রূপলালের পরিবারকে সহমর্মিতা জানিয়ে তাদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন।

স্বামীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রূপলালের স্ত্রী ভারতী দাস পাগলপ্রায়। বারবার হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে তিনি মূর্ছা যাচ্ছিলেন।

প্রতিবেশীরা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। কোনো বুঝই তিনি মানছেন না। বিলাপ করতে করতে বলছিলেন, ‘মোর নির্দোষ স্বামীক মানুষ মারিল ক্যান? এখন ছোট ছাওয়া দুইটার কী হইবে, বেটির বিয়ের কী হইবে, মুই কেমন করি বাঁচিম এখন?’

ছোট্ট রূপা ও জয় দাসের চোখেমুখেও আতঙ্ক। নির্বাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে মানুষের ভিড়ের দিকে।

নিহতের পরিবার, পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে জানা গেছে, রূপলাল দাসের মেয়ে নূপুর দাসের বিয়ে নিয়ে মিঠাপুকুর উপজেলার শ্যামপুর এলাকার লালচাঁদ দাসের ছেলে ডিপজল দাসের সঙ্গে কথাবার্তা চলছিল। গতকাল বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করার কথা ছিল। এ উদ্দেশ্যে শনিবার রাতে মিঠাপুকুর থেকে নিজের ভ্যান চালিয়ে আত্মীয় রূপলাল দাসের বাড়ির দিকে রওনা হন প্রদীপ দাস। কিন্তু প্রদীপ রাস্তা না চিনতে পারায় সয়ার ইউনিয়নের কাজীরহাট এলাকায় এসে রূপলালকে ফোন করেন। কিছুক্ষণ পর রূপলাল সেখানে এলে তারা ভ্যানে চড়ে ঘনিরামপুর গ্রামের বাড়ির পথে রওনা দেন।

রাত ৯টার দিকে তারা তারাগঞ্জ-কাজীরহাট সড়কের বটতলা এলাকায় পৌঁছলে স্থানীয় কয়েকজন ভ্যানচোর সন্দেহ করে তাদের আটক করেন। এ সময় সেখানে ধীরে ধীরে আরও লোক জড়ো হতে থাকে। একপর্যায়ে তারা ভ্যানে বস্তায় থাকা চারটি প্লাস্টিকের ছোট বোতল বের করেন। একটি বোতল খুলে সেখানে উপস্থিত দুজন ব্যক্তি ঘ্রাণ নেওয়ার পর অসুস্থ বোধ করছেন জানালে লোকজন তাদের সন্দেহ করে। ওষুধ প্রয়োগ করে অজ্ঞান করে ভ্যান চুরি করে এমন সন্দেহে তাদের মারধর শুরু করেন। তাদের দুজনকে মারধর করতে করতে বটতলা থেকে বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে নিয়ে আসা হয়। মারধরের একপর্যায়ে অচেতন হলে সেখানে ফেলে রাখা হয়। পরে রাত ১১টার দিকে তাদের উদ্ধার করে পুলিশ তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক রূপলাল দাসকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে প্রদীপ দাসকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে গতকাল ভোরে তিনিও মারা যান।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গত ২৮ জুলাই ওই এলাকায় এক শিশুকে হত্যা করে একটি ভ্যান চুরি করা হয়। এ ঘটনার পর থেকে লোকজন ক্ষুব্ধ ছিলেন। তবে ভ্যানে থাকা বস্তায় প্লাস্টিকের বোতলে চোলাই মদ ছিল বলে দাবি করেছেন নিহত রূপলালের পরিবারের সদস্যরা। তারা জানান, বিয়ে-পূজা-পার্বণে আতিথেয়তায় তারা চোলাই মদ পরিবেশন করেন।

স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল কাইয়্যুম বলেন, রূপলাল সাদাসিধে টাইপের মানুষ। মুচির কাজ করেন। কারও সঙ্গে কোনো ঝামেলা নেই। কিন্তু মানুষ ওকে মেরে ফেলল। নির্মম এ হত্যার বিচার চাই আমরা।’

এদিকে ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল রূপলাল দাস ও প্রদীপ দাসের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সন্ধ্যার দিকে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কে স্থানীয়রা রূপলালের লাশ নিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। তারা গাছের গুঁড়ি ফেলে সড়ক অবরোধ করে রাখেন। তারা বর্বর এ হত্যাকাণ্ডের দ্রুত ন্যায়বিচার ও দোষীদের শাস্তির দাবি জানান।

তারাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম এ ফারুক জানান, এ ঘটনায় নিহত রূপলালের স্ত্রী ভারতী দাস বাদী হয়ে গতকাল দুপুরে ৫০০ থেকে ৭০০ জনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেছেন। এরই মধ্যে তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

ওসি ফারুক আরও বলেন, ‘আমাদের দল এরই মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলামত পেয়েছে, যেগুলো যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। মামলার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে।’