
ক্যানসার আক্রান্ত কুড়িগ্রামের শাকিলা বেগম (৪৫)। স্বামী মারা গেছেন পাঁচ বছর আগে। স্কুলপড়ুয়া দুই ছেলেকে নিয়ে তাঁর সংসার। বাসাবাড়িতে কাজ এবং দিনমজুরি করে দৈনন্দিন খরচ চালান। তিনি বলেন, ‘তিনজনের ভাত জোগাড় করতেই কষ্ট হয়ে যায়, এর মধ্যে ক্যানসার হয়েছে জানতে পেরে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। ছেলেরা শখ করে একটা গরু পালত। ওটা বিক্রি করে ৩৫ হাজার টাকা নিয়ে ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে এসেছি। চিকিৎসক সিটি স্ক্যান করতে বলেছে। এ হাসপাতালে মেশিন নষ্ট থাকায় ডায়াগনস্টিক সেন্টারে টেস্ট করাতে ১৪ হাজার টাকা লাগল। অন্য আরও টেস্ট, ঢাকায় যাতায়াত, থাকা-খাওয়াতে টাকা প্রায় শেষ। জানি না চিকিৎসা কীভাবে করাব?’
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে যন্ত্র নষ্ট থাকায় এক বছর ধরে সিটি স্ক্যান এবং পাঁচ বছর ধরে এমআরআই পরীক্ষা বন্ধ আছে। ভর্তি থাকা গুরুতর রোগীদেরও যেতে হচ্ছে বাইরে। বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে টেস্ট করাতে গিয়ে রোগী ও স্বজনদের গুনতে হচ্ছে কয়েক গুণ বেশি টাকা।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের জন্য ২০১৮ সালে ৭ কোটি টাকায় কেনা হয় সিটি স্ক্যানের অত্যাধুনিক মেশিন। এ হাসপাতালে ৪ হাজার টাকায় রোগীরা সিটি স্ক্যান করতে পারতেন। কিন্তু নষ্ট থাকায় এই দামি যন্ত্র রোগীদের কাজে আসছে না। সরকারি হাসপাতালের যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেলে হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট বিভাগ একটি চাহিদাপত্র বা চিঠি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মলিকুলার ইমেজিং অ্যান্ড আলট্রাসাউন্ডে (নিমিউ) পাঠায়। এটা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি প্রতিষ্ঠান, যারা বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের মেডিকেল যন্ত্রপাতি মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে। সেই চিঠির মাধ্যমে নিমিউকে জানানো হয় যে কোন যন্ত্রপাতিটি নষ্ট হয়েছে এবং সেটি মেরামত করা প্রয়োজন। নিমিউ তখন সেই যন্ত্রটি পরীক্ষা করে দেখে এবং প্রয়োজনীয় মেরামত করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বলেন, এক বছরের বেশি সময় ধরে অচল হয়ে পড়ে আছে হাসপাতালের সিটি স্ক্যান যন্ত্রটি।
এ বিষয়ে আটবার চিঠি চালাচালি হলেও সমাধান মেলেনি। সিটি স্ক্যান মেশিন থেকে মাসে রাজস্ব আয় হতো ১৬ থেকে ২০ লাখ টাকা। অথচ এর চেয়ে কম টাকায় এটা মেরামত করা সম্ভব। একইভাবে মেরামতের অভাবে পাঁচ বছর ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে চীন থেকে উপহার পাওয়া এমআরআই মেশিন। এই নিয়মের বেড়াজালে আটকে থেকে বাড়ছে ক্যানসার হাসপাতালে আসা রোগীদের ভোগান্তি। মেশিন চালু থাকা অবস্থায় ৪ হাজার টাকায় সিটি স্ক্যান করাতে পারতেন রোগীরা। এখন বেসরকারি হাসপাতালে এই টেস্ট করাতে ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ক্লিনিক ভেদে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। ক্যানসার চিকিৎসায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ সিটি স্ক্যান ও এমআরআই। ক্যানসার শনাক্ত ও কোষের বিস্তার দেখা হয় এই পরীক্ষার মাধ্যমে। ক্যানসার আক্রান্ত বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছিলেন সিয়াম হোসেন। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে ভর্তি করে অপারেশন করা হয়েছে।
এখন এমআরআই করানোর জন্য এই অসুস্থ মানুষকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। বাবার শরীরে ভীষণ ব্যথা, যন্ত্রণা। এই রোগীকে অন্য হাসপাতালে টেস্ট করানোর জন্য কীভাবে নিয়ে যাব- সেটা নিয়েই দুশ্চিন্তা হচ্ছে।’ জাতীয় ক্যানসার হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. জাহাঙ্গীর কবীর বলেন, এই মেশিন দুটি নষ্ট থাকায় রোগীদের পরীক্ষার জন্য বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল কিংবা নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে পাঠাতে হচ্ছে। কিছু রোগী বাইরে থেকেও টেস্ট করাচ্ছেন। রোগীদের ভোগান্তি নিরসনে লিনিয়ার এক্সিলারেটর, সিটি স্ক্যান এবং এমআরআই এই তিনটি যন্ত্র কেনার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে কেনার প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে।