Image description
অনিশ্চয়তা কাটেনি অর্থনীতিতে

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্তি হয়েছে ৮ আগস্ট। এ এক বছরে বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম, বিক্ষোভ, মিছিল-মিটিং সামাল দিতেই গলদঘর্ম হতে হয়েছে সরকারকে। তার পরেও এ এক বছরে নানান উদ্যোগ নিয়ে অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়াতে সক্ষম হয়েছে সরকার। এতে সামগ্রিক অর্থনীতির অস্থিরতা কিছুটা কমলেও অনিশ্চয়তা কাটেনি। সরকার মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা কমাতে সক্ষম হয়েছে। তবে চাপমুক্ত হয়নি সামষ্টিক অর্থনীতি। এ সময়ে নানান উদ্যোগ নিয়েও বিনিয়োগের খরা কাটানো যায়নি। বরং  শিল্প, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের আস্থার সংকট আরও বেড়েছে। ব্যাংক খাতে বেড়েছে খেলাপি ঋণের বোঝা। রাজস্ব খাতের অচলাবস্থা সামষ্টিক অর্থনীতিতে বাড়িয়েছে অনিশ্চয়তা। বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমেছে। চলতি বছর শেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার আরও কমার আভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ। সরকারি গবেষণা সংস্থা খোদ বিবিএসও বলছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমবে।

তবে এটা ঠিক, এক বছর আগে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির পরিস্থিতি ছিল বেশ নাজুক। অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের মতে এক বছর আগে হাসিনা রিজিমের পতনের সময় অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচকই ছিল নেতিবাচক। এখনো যে অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে, তা নয়। শুধু মূল্যস্ফীতির চাপ তথা দ্রব্যমূল্যের বাজার মোটামুটি স্থিতিশীলতার দিকে রয়েছে। ভালো অবস্থানে আছে মূলত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এটা সম্ভব হয়েছে প্রবাসীরা বেশি পরিমাণে রেমিট্যান্স পাঠানোর ফলে। এ ছাড়া মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি নেতিবাচক পর্যায়ে থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার খরচ কমেছে; যার ফলে রিজার্ভ বেড়েছে। অবশ্য এ সময়ে সরকারকে রেকর্ড পরিমাণে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে। গেল এক বছরে সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যান্য সূচক যেমন কর্মসংস্থান, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, রাজস্ব আদায়, বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি, বিদেশি বিনিয়োগসহ কোনো সূচকই স্বস্তিদায়ক অবস্থানে নেই। এর ফলে সরকারকে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বহাল রাখতে হয়েছে।

জানা যায়, জুলাই ২০২৪-এ পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা ২০২৫ সালের জুনে এসে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০২৫ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। ২০২৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৪ দশমিক ২২ শতাংশ। এ কম প্রবৃদ্ধির পেছনে রয়েছে বিনিয়োগের ঘাটতি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। এ প্রসঙ্গে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘সবশেষে আগস্ট ২০২৪ থেকে জুলাই ২০২৫ সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংক খাতে সংস্কার উদ্যোগ নিয়ে, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পতন ঠেকানোর মাধ্যমে বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়াতে সক্ষম হয়েছে। তবে মূল্যস্ফীতি এখনো বেশি, বিনিয়োগ বাড়ছে না, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না এবং রাজস্ব আহরণ বাড়ছে না। কিন্তু সরকারের ঋণ পরিশোধ বাড়ছে। ফলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি চাপমুক্ত হয়ে গেছে সেটা বলার মতো সময় এখনো আসেনি।’

এক বছর আগে পরিস্থিতি ছিল বেশ নাজুক : এক বছর আগে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির পরিস্থিতি ছিল বেশ নাজুক। জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে মন্থরতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলারসংকট, বিনিময় হারে অস্থিরতা, রিজার্ভের ক্রমাগত ক্ষয়, বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্যে (বিওপি) রেকর্ড ঘাটতি, ব্যাংক খাতে নৈরাজ্যসহ নানান সংকটে হাবুডুবু খাচ্ছিল দেশের অর্থনীতি। গণ অভ্যুত্থান-পরবর্তী এক বছরে সামষ্টিক অর্থনীতির এসব সংকট অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। তবে দেশিবিদেশি বিনিয়োগে খরা, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে পিছিয়ে পড়াসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল না হওয়ার মতো চ্যালেঞ্জ রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের কাছে সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা ছিল বিদেশি বিনিয়োগ ও অনুদান নিয়ে আসার; কিন্তু এক বছরে এ ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যায়নি। উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও দেশের কাছ থেকে কাক্সিক্ষত সহায়তা পাওয়া যায়নি। কিছু ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি এলেও অর্থ পায়নি বাংলাদেশ।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘সবাই একটা স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতির মধ্যে ঢুকেছিল শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু এরপর নানান আন্দোলন, বিক্ষোভ, বিরোধীদের নানা রকম কর্মসূচির কারণে সরকার নিজের কাজগুলোও ঠিকঠাক করতে পারেনি। ফলে অর্থনীতিতে যেসব পরিবর্তন আমরা আশা করেছিলাম তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।’ জানা গেছে, গত এক বছরে বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ। বহু বছর এ খাতে এতটা ঋণখরা দেখা যায়নি। বিশ্লেষকরা বলছেন, ঋণ প্রবৃদ্ধি না হওয়ার অর্থ বেসরকারি খাতের সম্প্রসারণ রুদ্ধ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জুনের শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ২৭ শতাংশের বেশি এখন খেলাপি। এ ছাড়া সরকারি চাকরির পাশাপাশি দেশের বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পথও সংকুচিত হয়েছে।