Image description

মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের আমন্ত্রণে ১১ আগস্ট দেশটিতে রাষ্ট্রীয় সফরে যাচ্ছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই সফরের মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হবেন প্রধান উপদেষ্টা। অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনসের (আসিয়ান) চেয়ারম্যান আনোয়ার ইব্রাহিম আবার ড. ইউনূসের ঘনিষ্ঠ বন্ধুও। সেজন্য তার সঙ্গে দ্বি-পাক্ষিক বৈঠকে ড. ইউনূস আসিয়ানের সদস্যপদ পেতে মালয়েশিয়ার জোর সমর্থন চাইবেন বলে জানা গেছে। কিন্তু বাংলাদেশ আদৌ কি আসিয়ানের সদস্যপদ পাবে?— সেটি নিয়ে চলছে আলোচনা।

চলতি বছরের শুরু থেকে থেকে মালয়েশিয়া আসিয়ানের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েছে। মূলত আসিয়ানের সঙ্গে বাণিজ্য ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর। আসিয়ানের সদস্যপদ পেলে বাংলাদেশের ভারতের সঙ্গে দ্বি-পাক্ষিক বাণিজ্য নির্ভরতা কমবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর এটির সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে সদস্য রাষ্ট্র মিয়ানমারের বিরোধিতা অন্যতম বাধা। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সদস্যপদ পাওয়া সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই আপাতত সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার হওয়ার দিকে নজর দিতে হবে। সদস্যপদ না পেলে আপাতত বাংলাদেশের এটাই চাওয়া হওয়া উচিত।

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

চীনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সাবেক কূটনীতিক মুন্সী ফয়েজ আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আসিয়ানের সদস্যপদ বাংলাদেশের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা উচিত। তবে সদস্যপদ পাওয়া কিছুটা দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া বলে আপাতত সংস্থাটির সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার হওয়া জরুরি। নিদির্ষ্ট কোনো দেশের ওপর নির্ভরতা কমানোর উদ্দেশ্যে নয়, বাংলাদেশের বাণিজ্যিক-রাজনৈতিক স্বার্থেই আসিয়ানের সদস্য পদ পেতে চেষ্টা করতে হবে। এর সদস্য হলে অন্যান্য সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়বে। বিশেষ করে বাংলাদেশি পণ্যের বহুমুখীকরণ বাড়বে। এতে বাংলাদেশের সামনে অনেক সুযোগ খুলে যাবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিগত সরকারের কিছু ভালো উদ্যোগ ছিল পররাষ্ট্রনীতিতে। কিন্তু আমরা আসিয়ানের সদস্যপদ পেতে অতীতে কখনই জোর প্রচেষ্টা চালাইনি। বাংলাদেশকে এখন আসিয়ানের সদস্যপদ পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে।’ সদস্যপদ পেতে মিয়ানমারের বাধা কোনো অসুবিধার সৃষ্টি করবে কি না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সদস্যপদ পেতে মিয়ানমারের আপত্তি কোনো কাজে আসবে না। আমরা এর আগেই মিয়ানমারকে খুব ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারিনি। চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।’

আসিয়ানের সদস্যপদ পেলে ভারতের ওপর বাণিজ্যিক নির্ভরতা কমবে কি না? জানতে চাইলে সাবেক এই কূটনীতিক বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ও নির্ভরতা সেটির কোনো বিকল্প হয় না। আর দুই দেশের বাণিজ্যিকসহ অন্যান্য ইস্যুগুলো সমানভাবে উভয়কে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তবে ভারত বড় দেশ হিসেবে তাদের অভিযোজন ক্ষমতা বেশি। তারা কোনো না কোনোভাবে পুষিয়ে নিতে পারে। কিন্তু ছোট দেশ হিসেবে আমরা তা পারি না। সে কারণে নিজেদের সুবিধার্থে কোনো কোনো সময় কারও সঙ্গে মানিয়ে চলতে হয়।’

আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর বাণিজ্য অর্থনীতি

আসিয়ানের সদস্যদেশগুলোর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) পরিমাণ চার ট্রিলিয়ন বা চার লাখ কোটি মার্কিন ডলারের মতো। এক ট্রিলিয়ন সমান এক লাখ কোটি। আর বাংলাদেশের জিডিপির আকার ৪৫ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। আসিয়ান দেশগুলোর এটি হবে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি। অন্য বৃহত্তম অর্থনীতির দেশগুলো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও জার্মানি। আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর মিলিত ভূখণ্ড ৪৪ দশমিক ৬ লাখ বর্গকিলোমিটার। এ আয়তন বিশ্বের মোট আয়তনের ৩ শতাংশ এবং দেশগুলোর মিলিত জনসংখ্যা প্রায় ৭০ কোটি।

২০২৩ সালের তথ্যানুযায়ী, বিশ্ববাণিজ্যে ৮ শতাংশ অবদান আসিয়ানের সদস্যদের। দেশগুলো বিশ্বের মোট সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) ১৭ শতাংশ আকর্ষণ করে। ২০২০ সালে অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে আঞ্চলিক সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব (আরসিইপি) চুক্তি করে। ২০১২ সালে প্রথম এ চুক্তির প্রস্তাব করা হয়েছিল। তার পর আট বছর ধরে চীনের প্রবল উৎসাহ ও উদ্যোগে ২০২০ সালের নভেম্বরে এটি বাস্তবে রূপান্তরিত হয়।

এই চুক্তির ফলে ২০ বছরের মধ্যে জোটভুক্ত দেশগুলোকে একে একে অধিকাংশ আমদানি পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক তুলে নিতে হবে। বাংলাদেশ অবশ্য এ চুক্তির বাইরে এখনো। বাংলাদেশ আরসিইপিতে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করলেও শেখ হাসিনা সরকার শেষমেশ তাতে যোগ দেয়নি। ইউনূস সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গতবছরের সেপ্টেম্বরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে নতুন করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি পাঠিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২২–২৩ অর্থবছরে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো থেকে মোট ১ হাজার ১৩৫ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। একই সময়ে দেশগুলোতে পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ আয় করে ৭৬ কোটি ১০ লাখ ডলার। সেই হিসাবে বাংলাদেশের সঙ্গে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর মোট বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ২১১ কোটি ডলার।

সদস্য হওয়ার প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ কতটুকু এগোলো

বাংলাদেশ অনেক বছর ধরেই আসিয়ানের সদস্য হতে আগ্রহ জানিয়ে আসছে। ২০২৪ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকায় নিযুক্ত ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূত হেরু হরতান্তো সুবোলো প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে তার সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি, ইন্দোনেশিয়া আমাদের আসিয়ানের সদস্যপদ পেতে সাহায্য করবে।’ এর আগেও বিগত সরকারের আমলে বিভিন্ন পর্যায়ে আসিয়ানের সেক্টরাল ডায়লগ পার্টনার হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছিল।

২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সম্মেলনের ফাঁকে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকেও এ বিষয়ে সহায়তা চান প্রধান উপদেষ্টা। আসিয়ানের সদস্য হওয়া মানে, বাংলাদেশের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন হওয়া। এতে ব্যবসা ও বিনিয়োগ বাড়বে, বাজারও উন্মুক্ত হবে।

চলতি বছরের মে মাসে জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিত ৩০তম ‘নিক্কেই ফোরাম: ফিউচার অব এশিয়া’ সম্মেলনের সাইড লাইনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি ডা. মাহাথির বিন মোহাম্মদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে আসিয়ানের সদস্যপদ লাভের জন্য মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের সহাযোগিতা চান প্রধান উপদেষ্টা। প্রধান উপদেষ্টা মাহাথির মোহাম্মদের প্রতি বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনার অনুরোধ জানান। মাহাথির মোহাম্মদ আশ্বাস দেন যে, তিনি সবসময় বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে থাকবেন এবং বাংলাদেশকে আসিয়ানের সদস্যপদ অর্জনের প্রচেষ্টায় সমর্থন জানাবেন।

আসিয়ান কী এবং কেন

জানা গেছে, আসিয়ান দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সবচেয়ে শক্তিশালী আঞ্চলিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্থা হিসেবে পরিচিত। ১৯৬৭ সালের ৮ আগস্ট থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর পরস্পরের স্বার্থ সংরক্ষণে এই সংস্থা গঠন করা হয়। তখন দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে এবং শান্তি ও নিরাপত্তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংস্থাটি গঠনের কথা বলা হয়। ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় আসিয়ানের সদর দফতর। আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন বছরে একবার ইংরেজি বর্ণমালা ক্রমানুসারে সদস্যরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত হয়। তবে প্রতি তিন বছর পর পর অনুষ্ঠিত হয় শীর্ষ সম্মেলন।

আসিয়ান গঠিত হওয়ার আগে ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড মিলে ১৯৬১ সালে গঠন করেছিল দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া অ্যাসোসিয়েশন (এএসএ)। আসিয়ানকে ২০০৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পর্যবেক্ষকের মর্যাদা দেওয়া হয়। বর্তমানে আসিয়ানের মোট সদস্য১০। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড—এই পাঁচ দেশ নিয়ে এটির যাত্রা শুরু করেছিল। পরে আরও পাঁচ দেশ অর্থাৎ ব্রুনেই, ভিয়েতনাম, লাওস, মিয়ানমার ও কম্বোডিয়া আসিয়ানের সদস্য হয়।

শুরুর পাঁচটি দেশ বাদে ষষ্ঠ দেশ হিসেবে ব্রুনেই সদস্য হয় ১৯৮৪ সালের ৮ জানুয়ারি। এরপর ১৯৯৫ সালের ২৮ জুলাই সপ্তম সদস্য হয় ভিয়েতনাম। লাওস ও মিয়ানমার সদস্য হয় ১৯৯৭ সালের ২৩ জুলাই। একইদিন কম্বোডিয়ারও সদস্য হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো না থাকায় তা পিছিয়ে যায়। কম্বোডিয়া শেষ পর্যন্ত সদস্যপদ পায় ১৯৯৯ সালের ৩০ এপ্রিল। পূর্ব তিমুর আসিয়ানের সদস্য হতে ২০১১ সালের মার্চে আবেদন করে। দেশটিকে পর্যবেক্ষকের মর্যাদা দিয়েছে আসিয়ান।

জানা গেছে, চলতি বছরে পূর্ব তিমুর সদস্যপদ পেতে পারে। একসময় পাপুয়া নিউগিনি বিশেষ পর্যবেক্ষক ছিল। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানসহ আরও কয়েকটি দেশ আসিয়ানে যুক্ত হওয়ার পথে রয়েছে। এর মধ্যেই বাংলাদেশ নতুন সদস্যপদ থেকে গত কয়েক বছর ধরে আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে।