
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের ( বিআরটিএ ) স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স- সেবা নিয়ে আবারও অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে । ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে প্রায় ৭ লাখ গ্রাহকের ড্রাইভিং লাইসেন্স ঝুলে আছে । ২০২০ সালের ২৯ জুলাই থেকে পাঁচ বছর মেয়াদে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স প্রাইভেট লিমিটেড ( এমএসপি ) এই কাজের দায়িত্বে ছিল । এমএসপির সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় ২০২৫ সালের ২৮ জুলাই । কিন্তু গতকাল রোববার পর্যন্ত নতুন ঠিকাদার নিয়োগ হয়নি । ফলে গত ২৯ জুলাই থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রিন্ট, বায়োমেট্রিক ফিঙ্গারপ্রিন্টসহ যাবতীয় কাজ বন্ধ রয়েছে ।
৩০ জুলাই রাজধানীর বনানীতে বিআরটিএর প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় , জরুরি প্রয়োজনে যাঁরা ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে এসেছেন , তাঁরা ভোগান্তিতে পড়েছেন । সেবাকেন্দ্রের সামনে সাঁটানো নোটিশে লেখা রয়েছে , বিআরটিএ বনানী অফিসে ভুক্তভোগী গ্রাহক জানে আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন করেছিলাম । ৭ আগস্ট ডেলিভারির তারিখ থাকলেও জরুরি প্রয়োজনে আগেই এসেছি । কিন্তু এসে দেখি, সেবা বন্ধ । কর্মকর্তারা আগামী সপ্তাহে খোঁজ নিতে বলেছেন ।'
এদিকে বিআরটিএ সূত্র জানায় , করোনা মহামারি , এলসি ( ঋণপত্র ) খুলতে না পারায় কার্ড সরবরাহে সমস্যা এবং গত জুলাই মাসে কিছু রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে সেবা বিঘ্নিত হয় । এই অজুহাতে এমএসপি চুক্তির বাইরে আরও দুই বছরের সময় চেয়েছিল ; তবে বিআরটিএ রাজি হয়নি । ফলে ২৮ জুলাই চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সার্ভার বন্ধ করে দেয় । এতে প্রিন্টসহ অন্যান্য কার্যক্রমও থেমে যায় ।
উদ্বেগজনক বিষয় হলো , লাইসেন্স- সংক্রান্ত ডেটাবেইস ও সার্ভারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এখনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে রয়েছে । ডেটাবেইসে বিআরটিএর নিজস্ব কোনো অ্যাকসেস নেই । বিআরটিএ সূত্র জানায় , সমস্যার সমাধানে তারা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ( আইসিটি ) মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় সার্ভারের নিয়ন্ত্রণসহ ডেটাবেইসের অ্যাকসেস নিজেদের হাতে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে । পাশাপাশি নতুন ঠিকাদার নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত বিকল্প উপায়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া সম্ভব কি না , সে বিষয়েও চিন্তাভাবনা চলছে ।
জানতে চাইলে বিআরটিএর চেয়ারম্যান আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ বুধবার আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ ঠিকাদারের মেয়াদ শেষ হওয়ায় আমরা ওটিএমে ( উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি ) নতুন ঠিকাদার নিয়োগের কাজ করছি । এ সময়ে জনগণ যেন সেবা থেকে বঞ্চিত না হয় , সেই চেষ্টা করছি । আপৎকালীন ই - ড্রাইভিং লাইসেন্স চালুর পরিকল্পনা আছে; পাশাপাশি আমাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনাতেও সেবা চালুর চেষ্টা চলছে । আশা করছি , দু - এক দিনের মধ্যেই কিছু সমাধান আসবে । ”
তবে বিআরটিএর কর্মকর্তারা বলছেন , নতুন ঠিকাদার নিয়োগে দরপত্র আহ্বান থেকে শুরু করে কার্যাদেশ পর্যন্ত কমপক্ষে ছয় মাস সময় লাগবে । আটকে গেল ৭ লাখ লাইসেন্স : ২০২০ সালের চুক্তি অনুযায়ী , পাঁচ বছরে ৪০ লাখ স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স সরবরাহের লক্ষ্য ছিল এমএসপির । চুক্তির মূল্য ছিল ১২০ কোটি টাকা । সেই হিসাবে প্রতিটি কার্ডের জন্য ঠিকাদারকে প্রায় ৩০০ টাকা দিতে হতো বিআরটিএকে ।
কিন্তু বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী , পাঁচ বছরে ৩৩ লাখের মতো আবেদন জমা পড়ে । এগুলোর মধ্যে প্রায় ২৬ লাখ গ্রাহক লাইসেন্স পেয়েছেন , বাকি ৭ লাখ এখনো পাননি , অর্থাৎ এই ৭ লাখ লাইসেন্স প্রিন্ট করতেই পারেনি ঠিকাদার । তার আগেই চুক্তির মেয়াদ শেষ ।
বিআরটিএর একটি সূত্র অভিযোগ করে জানায় , ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কখনোই চুক্তি অনুযায়ী সেবা দিতে পারেনি । কার্ডের সংকট ছিল নিয়মিত , ফলে সময়মতো গ্রাহকদের হাতে লাইসেন্স পৌঁছায়নি । এ ছাড়া চুক্তি অনুযায়ী প্রতিদিন ৮ হাজার কার্ড সরবরাহের লক্ষ্য থাকলেও কার্ডের সংকটের কারণে কোনো দিনই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি ঠিকাদার । এমন সংকট আগেও হয় : ২০১১ সালে ইলেকট্রনিক চিপযুক্ত ডিজিটাল স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স চালু করে বিআরটিএ । শুরুতে বিআরটিএ ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রকল্পে যুক্ত ছিল টাইগার আইটি । আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রভাব খাটিয়ে কয়েক দফায় তারা ঠিকাদারি কাজ চালিয়ে যায় বলে অভিযোগ আছে ।
২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আবারও ড্রাইভিং লাইসেন্স সরবরাহের দায়িত্ব পায় টাইগার আইটি । কিন্তু বিশ্বব্যাংকের কালোতালিকাভুক্ত হওয়ায় ২০১৯ সালের আগস্টে টাইগার আইটির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে বিআরটিএ । তারপর নতুন টেন্ডার করে ঠিকাদার নিয়োগ দিলেও চুক্তির মেয়াদ ২০২১ - এর জুন পর্যন্ত স্মার্ট কার্ডের সার্ভার এবং ডেটাবেইস হস্তান্তরে গড়িমসি করে টাইগার আইটি । তাদের মেয়াদ শেষে প্রায় ১২ লাখ ৪৫ হাজার লাইসেন্সের আবেদন ঝুলে থাকে । ডেটাবেইস হস্তান্তর নিয়েও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল । এবার মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স একইভাবে ডেটাবেইস নিজের দখলে রেখেই বিদায় নিয়েছে ।
বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে , আগস্টের প্রথম সপ্তাহে নতুন ঠিকাদার নিয়োগে দরপত্র আহ্বান করা হবে । কিন্তু নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে সময় লাগবে । এই মধ্যবর্তী সময়ে কীভাবে গ্রাহকদের লাইসেন্স দেওয়া হবে , তা এখনো অনিশ্চিত । এই সংকট কেন বারবার তৈরি হচ্ছে , জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ( বুয়েট ) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড . শামসুল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে সাধারণ মানুষ বছরের পর বছর ভোগান্তির শিকার হচ্ছে । এর মূল কারণ আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর চরম অপেশাদারি । কোথাও কোনো জবাবদিহি নেই । দায়িত্বশীলেরা শুধু সুবিধা নেন , কিন্তু জনগণের কষ্ট নিয়ে ভাবেন না । আমাদের দেশে প্রতিটি পদকে “ প্রাপ্তি ” হিসেবে দেখা হয় , কর্তব্য নয় । গন্ডগোল হলে একজনকে সরিয়ে আরেকজন বসানো হয় , কিন্তু সমাধান হয় না । বিআরটিএ তারই প্রতিচ্ছবি । ’