
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির বলেছেন, আইনি ভিত্তি ছাড়া গণ-অভ্যুত্থানকে রেখে দেয়া কারো জন্য নিরাপদ নয়। জুলাই সনদের মধ্যে সংস্কারের বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। জুলাই সনদকে প্রাধান্য দিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নাই। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার হলো জনগণের অভিপ্রায়ের মাধ্যমে গঠিত সরকার। বর্তমান সরকার কোনো সাংবিধানিক বিধিবলে গঠিত সরকার নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলতে বাংলাদেশের সংবিধানে কোনো ধারণা নেই। এরকম একটা অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে আমাদের সংবিধানের মধ্যে এমন কোনো ধরনের কোনো কনসেপ্টই নেই।
অ্যাডভোকেট শিশির মনির প্রশ্ন তুলে বলেন, আগামী নির্বাচন কিসের অধীনে আয়োজন করা হবে? কোন সরকার করবে? কোন আইনে করবে? কোন আইনে আছে যে ফেব্রুয়ারি ২০২৬ বা এপ্রিলে নির্বাচন হতে হবে। আর যদি এ সরকারকে পূর্ববর্তী সরকারের কন্টিনিউশন ভাবা হয় তাহলে তো তাকে ২০২৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে হবে। তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন, এ সরকারকে যদি একটা গণ-অভ্যুত্থানের সরকার বলা হয় তাহলে গণ-অভ্যুত্থান সরকারের ক্ষমতা বা ম্যান্ডেট দুনিয়ার সব কিছুর চেয়ে বেশি। কারণ গণ-অভ্যুত্থানই সোর্স অব পাওয়ার। সোর্স অব ল। আইন হতে গেলে কমান্ড অব দি সভেরেইন লাগে। কমান্ড অব দি সভেরেইন কী? কমান্ড অব দি সভেরেইন হলো পিপলস উইল।
শিশির মনির গতকাল রোববার নয়া দিগন্তকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধানের অবিলম্বে ঘোষণা দেয়া উচিত কোন প্রেক্ষাপটে অভ্যুত্থান সাধিত হয়েছে। এখন থেকে বাংলাদেশের সংবিধান জুলাই সনদ কিংবা জুলাই ঘোষণার অধীন থাকবে। যতটুকু বিষয় সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হবে ততটুকু জুলাই সনদ প্রাধান্য পাবে। আর যতটুকু পাবে না ততটুকু সংবিধান কার্যকর থাকবে।
নয়া দিগন্ত : অন্তর্বর্তী সরকার গঠন নিয়ে এখন নানা প্রশ্ন উঠছে, এ নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ আছে কি?
শিশির মনির : আপনি দেখবেন সরকার হয়েছে ৮ আগস্টে। কিন্তু ঘটনা ঘটেছে ৫ আগস্টে। ৮ তারিখ যে সরকার হলো এটা ৫ তারিখ না হলে ৮ তারিখে সরকার হওয়া সম্ভব ছিল না। হাসিনা যে দেশ ছেড়ে চলে গেল, সাংবিধানিকভাবে তিনি দেশ ছেড়ে চলে যাননি। তিনি পালিয়ে গেছেন গণঅভ্যুত্থানের ফলে। গণ-অভ্যুত্থান নিজেই একটা বড় বৈধতা। যখন কোনো দেশে গণ-অভ্যুত্থান বা বিপ্লব ঘটে তখন সেখানে মানুষ এই যুক্তি বলে না যে আইনের কোনো বিধান বলে গণ-অভ্যুত্থান হলো বা বিপ্লব সংগঠিত হলো। বরং সে গণ-অভ্যুত্থান এবং বিপ্লবের পরে আইন গঠন করে। সেখানে গণ-অভ্যুত্থানের স্পিরিট প্রাধান্য পায়।
নয়া দিগন্ত : বর্তমান সরকার কাজ করছে কিভাবে?
শিশির মনির : আমাদের দেশে যে বর্তমান সরকার কাজ করছে, এটা কাজ করছে কোনো সাংবিধানিকভাবে গঠিত সরকার হিসেবে নয় বরং ছাত্র-জনতার ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশের সরকার হিসেবে কাজ করছে।
নয়া দিগন্ত : অতীতের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সার্বিক পরিস্থিতি এখন কোন অবস্থানে দাঁড়িয়েছে?
শিশির মনির : এখন দুটো জিনিস দাঁড়িয়েছে, একটি জুলাই ঘোষণা ও আরেকটি দাঁড়িয়েছে জুলাই সনদ। জুলাই ঘোষণার এই যে প্রেক্ষাপটটা, কী প্রেক্ষাপটে দেশে রাজনীতি পরিবর্তন সাধিত হলো তার সবকিছু বর্ণনা দিয়ে জাতির সামনে একটা ক্লিয়ারকাট অবস্থান বলতে হবে। যেহেতু এইটা হয় নাই, সেহেতু এইটা হয়েছে। এটার নাম হলে জুলাই ঘোষণা, এইটা বাংলাদেশে একবার হয়েছিল ‘প্রক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স’। এটা ফ্রান্সে হয়েছে ছয়বার। সিক্সথ রিপাবলিক। প্রতিটা গণ-অভ্যুত্থানের পরই একবার জনগণ তার ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। আমাদের দেশেও আরো দুইবার হয়েছিল। একবার হয়েছিল শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে, আরেকবার এরশাদ সরকারের আমলে। জিয়াউর রহমানের আমলে জিয়াউর রহমান মার্শাল ল জারি করেন নাই, খন্দকার মোশতাকের জারি করা মার্শাল ল কে অ্যাপ্রুভ করেছিলেন। তারপর তিনি গণভোটের আয়োজন করেছিলেন। তারপর তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন। সংসদ সদস্যদের নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন। সংসদ গঠিত হয়েছিল অতীতের সকল কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দিয়েছিলেন এবং যেদিন বৈধতা দিয়েছিলেন এইদিনই মার্শাল ল উইড্র করেছিলেন। একইরকমভাবে এরশাদ সরকার এসে একটা মার্শাল ল জারি করে বলেছেন যে এখন থেকে মার্শাল ল প্
নয়া দিগন্ত : বর্তমান প্রেক্ষাপটে করণীয় কী?
শিশির মনির : আমি মনে করি সমাধানটা হলো ৫ আগস্ট যে ঘোষণা দেয়ার কথা উনি (অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা) বলছেন, ওনার ঘোষণা দেয়া উচিত যে এই এই প্রেক্ষাপটে এই অভ্যুত্থান সাধিত হলো, এখন থেকে বাংলাদেশের সংবিধান জুলাই সনদ কিংবা জুলাই ঘোষণার অধীন থাকবে। যতটুকু বিষয় সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হবে ততটুকু জুলাই সনদ প্রাধান্য পাবে। আর যতটুকু পাবে না ততটুকু সংবিধান কার্যকর থাকবে।
নয়া দিগন্ত : সংস্কারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা যাবে কিভাবে?
শিশির মনির : এক্ষেত্রে আমরা সংস্কারের যে সব বিষয় আলোচনা করে ঠিক করলাম এই বিষয়গুলোর অধীনে জুলাই সনদ ঘোষণা করলে এই জুলাই সনদের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এটা অনুষ্ঠিত করতে গেলে সংবিধানের কিছু অনুচ্ছেদ অকার্যকর হয়ে যাবে। এই যে অকার্যকর করা হচ্ছে এটা পরবর্তী পার্লামেন্ট গঠিত হওয়ার পরে এই পিরিয়ডটাকে জিয়াউর রহমনের সরকারের সময় অথবা এরশাদ সরকারের সময়ের মতো একটা বৈধতা দিতে হবে। বৈধতা দিয়ে এটাকে সিলগালা করতে হবে। এটা যদি করা না হয় তাহলে গণ-অভ্যুত্থানের কোনো আইনি ভিত্তি দেয়া হলো না। আইনি ভিত্তি ছাড়া এভাবে গণ-অভ্যুত্থানকে এভাবে রেখে দেয়াটা কারো জন্য নিরাপদ নয়।
নয়া দিগন্ত : নির্বাচনের আয়োজনটা কিভাবে হবে?
শিশির মনির : আমরা যে বলছি এখন নির্বাচন আয়োজন করব, এ নির্বাচন কিসের অধীনে আয়োজন করা হবে? কোন সরকার করবে? কোন আইনে করবে? কোন আইনে আছে যে ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এর এপ্রিলে নির্বাচন হতে হবে। আর যদি এ সরকারকে পূর্ববর্তী সরকারের কন্টিনিউশন ভাবা হয় তাহলে তো তাকে ২০২৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে হবে। আর যদি তা না ভেবে এটাকে একটা গণ-অভ্যুত্থানের সরকার বলা হয় তাহলে গণঅভ্যুত্থান সরকারের ক্ষমতা বা ম্যান্ডেট দুনিয়ার সকল কিছুর চেয়ে বেশি। কারণ গণ-অভ্যুত্থানই সোর্স অব পাওয়ার, সোর্স অব ল। আইন হতে গেলে কমান্ড অব দি সভেরেইন লাগে। কমান্ড অব দি সভেরেইন কি? কমান্ড অব দি সভেরেইন হলো পিপলস উইল। জনগণের অভিপ্রায় ৫ আগস্ট প্রকাশিত হয়েছে, এক্সপ্রেস হয়েছে। সরকার বিদায় নিয়েছে, নতুন সরকার এসেছে, এই সরকারের দায়িত্ব এই অভিপ্রায়কে বাস্তবে রূপান্তরিত করা। করতে না পারেন, আইনের দোহাই দিয়ে কোনো লাভ নেই। বিষয়টিকে স্ট্রংলি নেয়া উচিত। সবিধানের ওই পার্টসগুলো সাসপেন্ড করে দেয়া উচিত। বাকি অংশটুকু কার্যকর রাখা উচিত। নতুন সিস্টেম জুলাই সনদের আলোকে নির্বাচনের আয়োজন করা উচিত। এইটাই একমাত্র আইনি সমাধান।
নয়া দিগন্ত : এই ক্ষেত্রে বাধা কি রাজনৈতিক অনৈক্য?
শিশির মনির : রাজনৈতিক অনৈক্য নয় না বুঝাটাই বাধা। এ আরগুমেন্টের বিরুদ্ধে যারা আরগুমেন্ট করছেন আমার মতে তারা বুঝতেছেন না কিংবা তারা বড় বড় আইনজীবীদের নিয়ে বসে পরামর্শ করছেন না। আন্দাজ অনুমানের ভিত্তিতে যার যেমন ইচ্ছা বলে যাচ্ছেন। এগুলোতো লিগ্যাল সলিউশন। এ সলিউশন বের করতে হবে লিগ্যালি মাথাওয়ালা লোকদের। আর এ ড্রাফট করতে হবে যাদের এ ড্রাফট করার ক্যাপাসিটি, ক্যাপাবিলিটি আছে তাদের নিয়ে। শুধু সংখ্যা দেখলে কাজ হবে না। সংখ্যা নিয়ে আলাপ করে সারাদিনও সমাধান আসবে না। এইজন্য অভিজ্ঞতা আছে এমন আইনজীবীদের একসাথে বসতে হবে, দে শুড অ্যানালাইসিস আগের দুই রেজিমে কী হয়েছিল, দে শুড অ্যানালাইসিস ফ্রান্সে কী হয়েছিল, দে শুড অ্যানালাইসিস মিসরে কী হয়েছিল, সেই আরব বসন্তের পর কী হয়েছিল, ইরানে কী হয়েছিল রেভ্যুলুশনের পরে, অনলি দেন দেয়ার ইজ গুড সলিউশন। এখন যা আছে তা জগাখিচুরি। ইতোমধ্যে সংবিধানের ৪৭টি অনুচ্ছেদ কার্যত সাসপেন্ড হয়ে গেছে।
নয়া দিগন্ত : সংবিধানের ৪৭টি অনুচ্ছেদ সাসপেন্ড হয়ে থাকলে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের আয়োজন হবে কিভাবে?
শিশির মনির : প্রশ্ন সেটাই, বর্তমান সংবিধানের অধীনে কি দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের আয়োজন অথবা কী করে প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্টের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য করব, কী করে উচ্চকক্ষে পিআর সিস্টেম থাকবে, কারণ বর্তমান সংবিধানের স্ট্রাকচারের মধ্যে তো এগুলো নাই। এইজন্যই জুলাই সনদের মধ্যে এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, জুলাই সনদকে প্রাধান্য দিতে হবে। এই জন্যই জুলাই সনদের অধীনে নির্বাচন হতে হবে, এই জন্যই জুলাই সনদকে পরবর্তী পার্লামেন্টে রেকটিফাই করতে হবে।