
বাংলাদেশ রেলওয়ের ৯০ শতাংশ ইঞ্জিনেরই ( লোকোমোটিভ ) মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে । ৩০ থেকে ৬০ বছরের পুরোনো এসব ইঞ্জিন যাত্রাপথে বিকল হয়ে দুর্ভোগে ফেলছে যাত্রীদের । শুধু পণ্যবাহী , লোকাল বা মেইল নয় ; কোনো কোনো আন্তনগর ট্রেনও চলছে কার্যকাল পেরিয়ে যাওয়া ইঞ্জিনে । ফলে এসব ট্রেনও চলার পথে থমকে যাওয়ায় একই রকম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে যাত্রীদের । ট্রেন বিলম্বিত হচ্ছে , যাত্রা বাতিলের ঘটনাও ঘটছে । রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে , যাত্রীসেবা উন্নত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হলেও ‘ বুড়ো ’ ইঞ্জিনে সাফল্য আসছে না ।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক ( ডিজি ) মো . আফজাল হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন , রেলওয়ের ইঞ্জিনগুলো ৩০ থেকে ৬০ বছরের পুরোনো হওয়ায় যত্রতত্র বিকল হচ্ছে । এতে যাত্রীরা দুর্ভোগে পড়ছেন । দেশের ৯০ শতাংশ ইঞ্জিন মেয়াদোত্তীর্ণ । ইঞ্জিনের অভাবে প্রতিদিন রেলের যাত্রীসেবা ব্যাহত হচ্ছে । রেল সূত্র জানায় , গত ১৪ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ১৫ দিনে ৩৭ টি ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হয়েছে । এগুলোর মধ্যে ১৮ টি আন্তনগর ট্রেনের , ১৫ টি মেইল ট্রেনের ও ৪ টি পণ্যবাহী ট্রেনের ইঞ্জিন । সারা দেশে প্রতিদিন রেলসেবা দিতে ২০৫ টি ইঞ্জিন দরকার । এগুলোর মধ্যে ১০৫ টি মিটারগেজ এবং ১০০ টি ব্রডগেজ । তবে সংকট থাকায় দেওয়া যায় ১৭০ টি ইঞ্জিন । রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের দৈনিক ইঞ্জিনের ( লোকোমোটিভ ) চাহিদা ১১৬ টি , পাওয়া যায় ৭০-৭৫টি । তবে কানেক্টিং ইঞ্জিনসহ স্বল্প দূরত্বের পথের ফিরতি ইঞ্জিনের মাধ্যমে কোনোরকমে সেবা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চলছে । সাম্প্রতিক সময়ে রেলের মিটারগেজ ইঞ্জিনগুলোর বিকল হওয়ার হার অস্বাভাবিক বেড়েছে । এতে ট্রেন পরিচালনা মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে ।
রেলওয়ের সূত্র জানায় , ২০২৪ সালের জুলাইয়ের তুলনায় ডিসেম্বরে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের যাত্রাপথে ইঞ্জিন বিকলের সংখ্যা তিন গুণের বেশি । জুলাইয়ে সব মিলিয়ে ১২ টি ইঞ্জিন বিকল হলেও ডিসেম্বরে হয়েছে ৩৮ টি । এর মধ্যে আন্তনগর ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল ১৬ টি । চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি লোকোমোটিভের কার্যকারিতা বৃদ্ধি এবং ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণে ৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে রেলের যন্ত্র প্রকৌশল শাখা । কমিটির প্রধান করা হয় রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ( রোলিং স্টক ) আহমেদ মাহবুব চৌধুরীকে । তবে অবস্থার দৃশ্যত কোনো অগ্রগতি হয়নি ।
রেলের সংশ্লিষ্ট নথিপত্র থেকে জানা গেছে , ইঞ্জিন বিকলের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে । ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ইঞ্জিন বিকলের ঘটনা ১৪ টি । তবে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে বিকল হয় ১৮ টি । ২০২৩ সালের অক্টোবরে ১৫ টির বিপরীতে গত অক্টোবরে ২৩ টি এবং ২০২৩ সালের নভেম্বরে ১১ টির বিপরীতে গত নভেম্বরে ১৮ টি ইঞ্জিন বিকল হয় । গত ডিসেম্বরে ইঞ্জিন বিকলের ঘটনা ৩৮ টি । এগুলোর মধ্যে আন্তনগর ট্রেনের ১৫ টি , মেইল / এক্সপ্রেস ট্রেনের ১৬ টি এবং পণ্যবাহী ট্রেনের ৭ টি
ইঞ্জিন বিকল হয় । এ কারণে রেলওয়ে ও যাত্রীদের অনেক সময় নষ্ট হয়েছে । রেলের ইঞ্জিন মেরামতে ওয়ার্কশপগুলোর কর্মদক্ষতার হার কমে যাওয়া , যন্ত্রাংশ কিনতে দীর্ঘসূত্রতার কারণে দ্রুত ইঞ্জিন মেরামত করতে পারছে না চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ও নীলফামারীর সৈয়দপুর ওয়ার্কশপ । ব্রিটিশ আমলে ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর দর্শনা - জগতি অংশে ৫৩ দশমিক ১১ কিলোমিটার রেলপথ স্থাপনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ট্রেন চলাচল শুরু হয় । এরপর দেশে ২ হাজার ৯০০ কিলোমিটার রেলপথ স্থাপিত হয়েছে ।
বর্তমানে দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৪৪ জেলায় রেল যোগাযোগ রয়েছে । রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল নামে দুটি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত । পূর্বাঞ্চলের বেশির ভাগ রেলপথ মিটারগেজ এবং পশ্চিমাঞ্চলের ব্রডগেজ । রেলের পরিবহন বিভাগ সূত্র জানায় , সর্বশেষ প্রবর্তিত ওয়ার্কিং টাইম টেবিল অনুযায়ী পূর্বাঞ্চলে দৈনিক ইঞ্জিনের চাহিদা ১১৯ টি । এগুলোর মধ্যে পণ্যবাহী ট্রেনের জন্য ১৬ টি । তবে প্রকৌশল বিভাগ প্রতিদিন ৭৫ থেকে ৭৮ টির বেশি ইঞ্জিন দিতে পারছে না ।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক ( জিএম ) মোহাম্মদ সুবক্তগীন বলেন , গতকাল রোববার চট্টগ্রামে ইঞ্জিনের চাহিদা ছিল ১১৬ টি , পাওয়া গেছে ৮০ টি । রেলের পরিবহন বিভাগের তথ্য বলছে , গত মে মাসে পূর্বাঞ্চলের ২৪ টি আন্তনগর ট্রেনের ইঞ্জিন যাত্রাপথে বিকল হয় । একই সময়ে মেইল ট্রেনের ১২ টি , লোকাল ট্রেনের ১ টি এবং পণ্যবাহী ট্রেনের ৪ টি ইঞ্জিন বিকল হয় । জুনের প্রথম ১৫ দিনে বিকল হয় ২৮ টি ইঞ্জিন । পরের আট দিনে প্রায় সমপরিমাণ ইঞ্জিন বিকল হয় । এদিকে পার্বতীপুরের কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানায় ( কেলোকা ) জেনারেল ওভারহোলিং ( জিওএইচ ) করা ইঞ্জিনগুলো কিছুদিনের মধ্যেই নষ্ট হচ্ছে ।
সূত্র বলেছে , যাত্রাপথে ইঞ্জিন বিকল হওয়ায় বিকল্প ইঞ্জিন এনে ট্রেনে সংযুক্ত না করা পর্যন্ত ট্রেন থেমে থাকছে । কখনো কখনো বিকল্প ইঞ্জিন না পেলে বিকল ইঞ্জিনই সারিয়ে আবার যাত্রা করা হচ্ছে । এতে কখনো এক ঘণ্টা , আবার কখনো দু - তিন ঘণ্টা বিলম্ব হচ্ছে গন্তব্যে পৌঁছাতে । এতে একদিকে যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়ছেন , অন্যদিকে ট্রেনের সময়সূচি ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে ; যা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে রেলওয়ের যাত্রীসেবায় ।