Image description
হাইকোর্টের রায় স্থগিত » স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে করা আবেদন আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হয়নি এক বছরেও । » মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত হওয়ার আগে কনডেম সেলে রাখা দুবার সাজার শামিল : হাইকোর্ট » হাইকোর্টে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ১,২৩৩ টি মামলা , আপিল বিভাগে রয়েছে ২৪৫ টি ।

বিচারিক আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ হলে আসামিকে কারাগারের কনডেম সেলে ( নির্জন প্রকোষ্ঠ ) পাঠানো হয় । মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত হওয়ার আগে আসামিকে কনডেম সেলে রাখা ‘ দুবার সাজা দেওয়ার শামিল ' উল্লেখ করে এই বিধান বাতিল করেছিলেন হাইকোর্ট । তবে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দুই দিন পরই এই রায় স্থগিত করেন আপিল বিভাগ । এই স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে করা আপিল এক বছরেও নিষ্পত্তি না হওয়ায় মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত হওয়ার আগে কনডেম সেলেই থাকতে হচ্ছে আসামিদের ।

সুপ্রিম কোর্টের সূত্রে জানা গেছে , গত ১৫ জুলাই পর্যন্ত ডেথ রেফারেন্স অনুমোদনসংক্রান্ত ১ হাজার ২৩৩ টি মামলা হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে । হাইকোর্টে নিষ্পত্তির পর আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে ২৪৫ টি আবেদন । অর্থাৎ এসব মৃত্যুদণ্ড এখনো নিশ্চিত হয়নি । এই আপিলকারীদের অনেকে বিচারিক আদালত মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়ার পর থেকে কনডেম সেলে আছেন । হাইকোর্টের ওই রায়ে মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত না হওয়া আসামিদের কনডেম সেল থেকে সরিয়ে সাধারণ সেলে নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ।

মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে করা আবেদন আপিল বিভাগে নিষ্পত্তির বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ আজকের পত্রিকাকে বলেন , “আমরা তো শুনানি করতে চাই । এসব গুরুত্বপূর্ণ মামলা শুনানির জন্য বারবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি । কিন্তু আপিল বিভাগে তো অনেক মামলার বোঝা । এগুলো পর্যায়ক্রমে শুনানি হবে । দণ্ডবিধির ৫৩ ধারায় সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে । আবার দণ্ডবিধির ৭৩ ও ৭৪ ধারায় আসামিকে নির্জন কারাবাসে ( কনডেম সেল ) রাখার বিধানের বর্ণনা রয়েছে ।

৭৩ ধারায় বলা হয়েছে , আদালতপ্রদত্ত কারাদণ্ডের মেয়াদের কোনো অংশ নির্জন অন্তরিণে আবদ্ধ রাখতে পারেন । তবে তা কখনোই তিন মাসের বেশি হবে না । কারাদণ্ডের মেয়াদ ছয় মাস হলে নির্জন কারাবাসে এক মাস , কারাদণ্ডের মেয়াদ এক বছর হলে নির্জন কারাবাসে দুই মাস এবং কারাদণ্ডের মেয়াদ এক বছরের বেশি হলে তিন মাস পর্যন্ত নির্জন কারাবাসে রাখা যাবে । ৭৪ ধারায় বলা হয়েছে , নির্জন কারাবাস একসঙ্গে কখনোই ১৪ দিনের বেশি হবে না । নির্জন কারাবাস তিন মাস হলে একসঙ্গে ৭ দিনের বেশি হবে না ।

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন , কনডেম সেলে রাখার ধারণা ব্রিটিশ আমলের । কারণ , তখন দ্রুত সময়ে সব প্রক্রিয়া শেষে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতো । তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটি মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হতে ১০-১৫ বছরের বেশি সময় লেগে যাচ্ছে । চূড়ান্ত রায় পর্যন্ত দীর্ঘদিন আসামিদের এভাবে নির্জন সেলে রাখা অমানবিক । এটি কেবল মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত হওয়ার পর তা কার্যকরের আগে অল্প সময়ের জন্য হতে পারে । তাই আপিল বিভাগে থাকা জনগুরুত্বপূর্ণ এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে রাষ্ট্রপক্ষের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ।

কোনো মামলায় বিচারিক আদালত আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিলে কার্যকর করতে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ ধারা অনুসারে হাইকোর্টের অনুমোদন নিতে হয় , যা ডেথ রেফারেন্স হিসেবে পরিচিত । ফৌজদারি কার্যবিধির ৪১০ ধারা অনুসারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হাইকোর্টে আপিল করতে পারেন । হাইকোর্টে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলে এর বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করার সুযোগ পান আসামি । আপিল খারিজ হলে সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ ( পুনর্বিবেচনা ) আবেদন করার সুযোগ আছে । রিভিউ আবেদন খারিজ হলে সব শেষে সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারেন । রাষ্ট্রপতি আবেদন নামঞ্জুর করলে বা তাঁর কাছে আবেদন না করলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে বাধা থাকে না । সুপ্রিম কোর্টে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে , চলতি বছরের ১৫ জুলাই পর্যন্ত ডেথ রেফারেন্স অনুমোদনসংক্রান্ত ১ হাজার ২৩৩ টি মামলা হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে । আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে ২৪৫ টি আবেদন ।

সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল অফিসার মো . মোয়াজ্জেম হোছাইন আজকের পত্রিকাকে বলেন , ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতি পাঁচটি বেঞ্চ ঠিক করে দিয়েছেন । নিয়মিত এসব বেঞ্চ শুনানি হচ্ছে । চেষ্টা করা হচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব এসব মামলা নিষ্পত্তির জন্য । মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে আসামিকে কনডেম সেলে রাখার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে হাইকোর্টে রিট করেন বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত হয়ে কনডেম সেলে থাকা তিন আসামি । প্রাথমিক শুনানির পর রুল জারি করেন উচ্চ আদালত । পরে রুল নিষ্পত্তি করে গত বছরের ১৩ মে রায় দেন হাইকোর্ট ।

রায়ে বলা হয় , মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত হওয়ার আগে দীর্ঘদিন নির্জন কারাবাসে রাখা দুবার সাজা দেওয়ার শামিল । তাই মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে দণ্ডিত আসামিকে কনডেম সেলে রাখা অবৈধ । রায়ে মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত হওয়ার আগে যাঁদের কনডেম সেলে রাখা হয়েছে, তাঁদের পর্যায়ক্রমে সাধারণ সেলে স্থানান্তরের নির্দেশ দেওয়া হয় । এ জন্য দুই বছর সময় বেঁধে দেওয়া হয় । তবে কোনো আসামি সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার কারণে অন্যদের সঙ্গে রাখা ঝুঁকিপূর্ণ হলে তাঁকে কনডেম সেলে রাখা যেতে পারে বলে মত দেন । এ ক্ষেত্রে দণ্ডিতের বক্তব্য শোনার শর্ত দেওয়া হয় । সরকার কারাবিধি সংস্কার করলে সেখানে যাতে রায়ের প্রতিফলন থাকে তা নিশ্চিত করতেও বলা হয় রায়ে । হাইকোর্টে রিটকারীদের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির । তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন , “ আপিল বিভাগে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে হাইকোর্টের রায় স্থগিত রয়েছে । তাই চেষ্টা করছি আপিল দ্রুত শুনানি করার জন্য । আশা করি শিগগির বিষয়টি আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হবে এবং হাইকোর্টের রায়

বহাল থাকবে । ’