Image description

পাঁচ মাস আগে রাজধানীর বিয়াম ফাউন্ডেশন ভবনে যে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল তা ছিল পূর্বপরিকল্পিত। যদিও ঘটনার পর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা প্রথমদিকে এসি বিস্ফোরণ থেকে দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা দিয়েছিল। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) সহযোগিতায় আসামি শনাক্তের পর তার দেওয়া তথ্যে বেরিয়ে আসে প্রকৃত ঘটনা। যা গণমাধ্যমকে জানায় পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। 

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) বলছে, রাজধানীর বিয়াম ফাউন্ডেশন ভবনে বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতির অফিসে পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগানো হয়েছিল। সমিতির অফিসে থাকা নথিপত্র ধ্বংস করতেই এই আগুন লাগানো হয়।

আজ সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর কল্যাণপুরে পিবিআইয়ের স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশন (এসআইঅ্যান্ডও) ইউনিটের (উত্তর) কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলা হয়। পিবিআইয়ের বিশেষায়িত এই ইউনিটের পুলিশ কমিশনার মো. আবদুর রহমান এই সংবাদ সম্মেলন করেন। এ সময় এসআইঅ্যান্ডওর (উত্তর) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা থোয়াইঅংপ্রু মারমা উপস্থিত ছিলেন।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) সাহায্যে আসামি শনাক্ত করে ঘটনার রহস্য উন্মোচন করার দাবি করেছে পিবিআই। তারা বলছে, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত ৩টা ২০ মিনিটের দিকে বিয়াম ফাউন্ডেশনের ৫০৪ নম্বর কক্ষে বিস্ফোরণ ঘটে। কক্ষটিতে বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতির অফিস ছিল। বিস্ফোরণে কক্ষে থাকা সমিতির নানা নথি (দলিল, নামজারির কাগজ, জমি কেনার চুক্তিপত্র), ব্যাংক হিসাবের চেকবই, ইলেকট্রনিকসামগ্রী, আসবাবপত্র, শীততাপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্র প্রভৃতি পুড়ে যায়। বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই মারা যান অফিস সহায়ক আবদুল মালেক। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সমিতির সাধারণ সম্পাদকের গাড়িচালক মো. ফারুক। প্রাথমিকভাবে পুলিশ বলেছিল, শীততাপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্র (এসি) বিস্ফোরণে এই ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক অবসরপ্রাপ্ত সচিব মশিউর রহমান বাদী হয়ে হাতিরঝিল থানায় একটি মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করে পিবিআইয়ের বিশেষায়িত ইউনিট। প্রায় দুই মাসের তদন্ত শেষে ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়।

সংবাদ সম্মেলনে আবদুর রহমান বলেন, পিবিআই এই ঘটনার ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা ফুটেজ বিশ্লেষণ করে। এতে দেখা যায়, সেদিন রাতে মাথায় মাস্কিংক্যাপ, মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস আর পায়ে স্যান্ডেল পরা অবস্থায় এক ব্যক্তি বিয়াম ভবনের পাঁচতলায় ঘটনাস্থলে যান। তিনি সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে দেন। পিবিআই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) সাহায্যে এই ব্যক্তিকে শনাক্ত করে। তাঁর নাম আশরাফুল ইসলাম। আশরাফুলকে কুড়িগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ঘটনার বিস্তারিত জানা যায়। তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকা থেকে বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. জাহিদুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়।

আবদুর রহমান বলেন, জাহিদুল ও আশরাফুল পূর্বপরিচিত। দুজনের বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলায়। ঘটনার কয়েক মাস আগে আশরাফুলকে এলাকা থেকে এনে রাজধানীর একটি তিন তারকা হোটেলে রাখেন জাহিদুল। সমিতির নথিপত্র ধ্বংস করতে জাহিদুল আসামি আশরাফুল, অফিস সহায়ক আবদুল মালেক ও গাড়িচালক ফারুক মিলে পরিকল্পনা করেন। কাজ শেষে তাঁদের ১০-১২ লাখ টাকা দেবেন বলে মৌখিক চুক্তি করেন জাহিদুল। পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটনার দিন রাতে আশরাফুল পাঁচতলার সিসি ক্যামেরা বন্ধ করেন। সিসি ক্যামেরা বন্ধের পর মালেক ও ফারুক ৫০৪ নম্বর কক্ষে প্রবেশ করেন। তখন আশরাফুল কক্ষের দরজার পাশে সিঁড়ির কোনায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন। কক্ষে প্রবেশ করে মালেক ও ফারুক গুরুত্বপূর্ণ কাগজে পেট্রল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেন। এর আগে আশরাফুল সিঁড়ি দিয়ে তৃতীয় তলায় নেমে যান। আশরাফুল তৃতীয় তলায় নামতেই কক্ষটিতে বিকট বিস্ফোরণ হয়। এতে ঘটনাস্থলেই মালেক মারা যান। আর ফারুকের শরীর আগুনে পুড়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছালে আশরাফুল ভবন থেকে পালিয়ে হোটেলকক্ষে চলে যান। পরে জাহিদুল ঘটনাস্থলে আসেন। তিনি আশরাফুলের সহযোগিতায় ফারুককে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নিয়ে ভর্তি করেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ফারুক মারা যান।

আবদুর রহমান বলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী শুধু সমিতির নথিপত্র পোড়ানোর কথা ছিল। কিন্তু পেট্রল দিয়ে আগুন দেওয়ার সময় বিস্ফোরণ হবে, এটি তাঁরা বুঝতে পারেননি। যার কারণে ঘটনায় জড়িত থাকা মালেক ও ফারুক আগুনে পুড়ে মারা যান। পুড়ে যাওয়া নথিপত্র কী ধরনের, তাতে কী তথ্য ছিল, তা এখনো জানা যায়নি। মামলার প্রথম ধাপ শেষ করেছে পিবিআই। দ্বিতীয় ধাপে তারা নথিপত্রে কী ছিল, তা নিয়ে কাজ করবে। পাশাপাশি এই ঘটনায় আর কেউ জড়িত আছে কি না, তা খতিয়ে দেখবে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে আসামি শনাক্তের বিষয়ে আবদুর রহমান বলেন, ‘প্রথমে আমরা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করি। একটা কক্ষের ক্যামেরা বন্ধ করে দেওয়া হলেও বাকিগুলো চালু ছিল। সেখান থেকে আমরা আশরাফুলের মাস্ক পরা ছবি পাই। পরে এআইয়ের সহযোগিতায় আশরাফুলকে শনাক্ত করি। আশরাফুলের ওই অফিসে আসা-যাওয়া ছিল, সেই ছবি দেখেই তাঁকে শনাক্ত করি।’
শীর্ষনিউজ