Image description
৫ আগস্ট হাসিনার পলায়ন

প্রায় ১৯-২০ দিনের সংঘাতে গোটা দেশ তখন রক্তের নদী। ঢাকাসহ সারাদেশে ঝরেছে শত শত ছাত্র-জনতার প্রাণ।

এমনই প্রেক্ষাপটে ছাত্র-জনতা ডাক দেয় ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির। এই কর্মসূচি ঠেকাতে তৎকালীন পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নেয় নানা দমনমূলক ব্যবস্থা। এজন্য ৫ আগস্ট সকাল থেকেই ঢাকায় বিরাজ করতে থাকে থমথমে পরিস্থিতি।

কিন্তু সব বাধা ভেঙে ছাত্র-জনতা পায়ে হেঁটে এগোতে থাকে রাজধানীর দিকে। ‘গণভবন’ গণমানুষের দখলে যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র বুঝতে পেরে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা বঙ্গভবনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ফলে সিটি এসবির (গোয়েন্দা সংস্থা স্পেশাল ব্রাঞ্চের নগর ইউনিট) কন্ট্রোল রুম থেকে ওয়ারলেসে তার যাত্রার ক্লিয়ারেন্স চাওয়া হতে থাকে, বাজতে থাকে ‘ভিক্টর টু বঙ্গভবনে যাবেন’ বার্তা। কিন্তু এর জবাবে কোনো সাড়াশব্দ মিলছিল না। ওদিকে সময় গড়াচ্ছিল। ছাত্র-জনতা গণভবনের কাছাকাছি চলে আসছে বুঝে শেখ হাসিনা প্রাণ বাঁচাতে তার বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে পালিয়ে যান ভারতে।

বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েও হাসিনার নিষ্ফল হওয়ার এমন তথ্য দায়িত্বশীল সূত্রে জানতে পেরেছে বাংলানিউজ।

অবশ্য, শেখ হাসিনার পালানোর সুযোগ তৈরির জন্যও সিটি এসবির কন্ট্রোল রুম থেকে এ ধরনের বার্তা দেওয়া হয়ে থাকতে পারে বলে কেউ কেউ মনে করছেন।

সূত্র মতে, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ঢাকার যে কোনো সড়ক দিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে চাইলে তাদের নিরাপত্তার পাশাপাশি সেসব সড়কে সাধারণ যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এসব রাস্তার দুই পাশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবস্থান নেয়, খালি করা হয় পুরো সড়ক, যাতে সড়ক দিয়ে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী।

এই ভিআইপিদের চলাচলের আনুমানিক দুই ঘণ্টা আগে থেকেই স্পেশাল ব্রাঞ্চ (গোয়েন্দা সংস্থা) তাদের ওয়ারলেস সেটে সতর্কতা জারি করে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ওয়ারলেস সেটের মাধ্যমে কিছু নির্দিষ্ট শব্দ ব্যবহার করেন, যার মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বুঝে নেন—কোনো ভিআইপির আগমন হচ্ছে। এই সাংকেতিক শব্দগুলো হলো–‘ভিক্টর ওয়ান’, ‘ভিক্টর টু’। আছে ‘ভিক্টর থ্রি’, ‘ভিক্টর ফোর’ও। ‘ভিক্টর ওয়ান’ মানে রাষ্ট্রপতি, ‘ভিক্টর টু’ মানে প্রধানমন্ত্রী।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাষ্যে, ভিক্টর ওয়ান বা ভিক্টর টু কোথাও যেতে চাইলে তারা যে সড়ক ব্যবহার করবেন, সেটা আগে থেকেই ঠিক করা হয়। সেসব সড়ক সম্পূর্ণ যানবাহনমুক্ত করার পাশাপাশি জনসাধারণের চলাফেরাও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিশেষ করে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর চলাচলের ক্ষেত্রে দুই ঘণ্টা আগেই স্পেশাল ব্রাঞ্চ থেকে বারবার ওয়ারলেসের মাধ্যমে জানানো হয়, ‘ভিক্টর ওয়ান’ বা ‘ভিক্টর টু’ অমুক সড়ক দিয়ে অমুক সময় যাবেন। রুট ক্লিয়ার করে দ্রুত রিপোর্ট করুন।  

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়া পর্যন্ত ঢাকায় একটি স্থানে সিটি এসবির হয়ে ডিউটিতে ছিলেন এক কর্মকর্তা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সম্প্রতি বাংলানিউজকে তিনি বলেন, আমরা সরকারি কর্মচারী, যে সরকারই থাকবে আমাদের সেই সরকারের নির্দেশনা মানতে হবে। স্পেশাল ব্রাঞ্চের সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় সাদা পোশাকে ডিউটি করে থাকেন। এছাড়া ডিউটিতে কী পেলাম সেসব রিপোর্ট স্যারদের (ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা) সামনে পেশ করতে হয়। আমি যে স্যারের নিয়ন্ত্রণে ডিউটিতে ছিলাম তিনি হচ্ছেন ইন্সপেক্টর, একটি জোনের দায়িত্বে ছিলেন। ওনারও কলসাইন আছে। ওয়ারলেস ডাকার সময় নির্দিষ্ট নম্বর যুক্ত করে চার্লি বলে ডাকা হয় তাকে।

বর্তমানে ঢাকার বাইরে কর্মরত ওই কর্মকর্তা বলেন, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় অনেক পরিশ্রমের ডিউটি করতে হয়েছে। ৫ আগস্ট সকালে ঢাকার এক জায়গায় ডিউটিতে ছিলাম। হঠাৎ সকালে—নির্দিষ্ট সময়টি মনে নেই—আমার হাতে থাকা ওয়ারলেস সেটে শোনা গেল, কয়েকবার সিটি এসবির কন্ট্রোল রুম থেকে বলা হচ্ছে, ‘ভিক্টর টু বঙ্গভবনে যাবেন’, রুট ক্লিয়ারেন্স চাওয়া হচ্ছে। কিন্তু এর পাল্টা জবাব আর কন্ট্রোল রুম পায়নি। বারবার কন্ট্রোল রুম থেকে ‘ভিক্টর টু’ মুভমেন্টের ক্লিয়ারেন্স চাওয়া হলেও পাল্টা উত্তরে কোনো কর্মকর্তার জবাব শোনা যায়নি। তার মানে বোঝা যাচ্ছে, নির্দিষ্ট কিছু জায়গা ছাড়া কেউ সড়কে নেই। আস্তে আস্তে স্পেশাল ব্রাঞ্চের সবাই সটকে পড়েন।  

আক্ষেপ প্রকাশ করে এই কর্মকর্তা আরও বলেন, তখন আমি আমার হাতে থাকা ওয়ারলেস সেটে আমার স্যারকে (তিনটি নম্বর যুক্ত করে কলসাইন চার্লি) খোঁজার চেষ্টা করলাম, কিন্তু আমার স্যারেরও কোনো জবাব পেলাম না। অথচ ঘণ্টাদুয়েক আগেও ওয়ারলেসে কিছু কর্মকর্তা কথাবার্তা বলেছেন। তখন চতুর্দিক থেকে হাজার হাজার মানুষ শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে গণভবনের দিকে রওনা হয়েছে। সেসময় আমি প্রচণ্ড ভয়ে চারদিকে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। কোনো মতে সংশ্লিষ্ট একটি থানায় ঢোকার চেষ্টা করলাম। থানার ওয়ারলেসের কলসাইন আবার আলাদা, সিটি এসবির সঙ্গে কোনো সংযুক্তি নেই। লক্ষ্য করলাম থানার ওয়ারলেসেও কোনো সাড়াশব্দ নেই। বুঝতে পারলাম কিছু একটা হতে চলছে। এর আনুমানিক তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা পরে সংবাদ পেলাম শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন।  

চোখের পানি মুছতে মুছতে ওই কর্মকর্তা বলেন, যেসব পুলিশ কর্মকর্তার নির্দেশে আমরা সড়কে ডিউটিতে ছিলাম, তারা কিছুই না বলে আমাদের মৃত্যুর মুখে ফেলে পালিয়ে যান।

সেদিন ঢাকার সড়ক পরিস্থিতি কেমন ছিল, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আলেমদের কাছে শুনেছি, হাশরের ময়দানে কেউ কাউকে চিনবে না। নিজের ‘ইয়া নফসি’ নিজেকেই করতে হবে। ঠিক সেদিনের অবস্থাটা হাশরের ময়দানের মত ছিল। আমাদের পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা সবাই সবার জান বাঁচানোর জন্য যে যেদিকে পেরেছে পালিয়ে গেছে। কেউ কারও দিকে তাকানোর সময় পায়নি।

শেখ হাসিনার পতন যেভাবে
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু এই আন্দোলন দমনে তৎকালীন শেখ হাসিনার সরকার আগ্নেয়াস্ত্রের বাড়াবাড়ি রকমের ব্যবহার করে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় হাসিনার দল আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং স্বেচ্ছাসেবক লীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা। তাদের গুলিতে জুলাইয়ের মাঝমাঝিতে কয়েক শ’ ছাত্র-জনতার প্রাণ ঝরে। পরে সেই আন্দোলন সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। এই আন্দোলন দমনে হাসিনার সরকার আরও কঠোর হয়। নির্বিচারে শিশু-কিশোরদের গ্রেপ্তারের পাশাপাশি হত্যাযজ্ঞ চালায় আওয়ামী লীগের ক্যাডার বাহিনী।

জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে, জুলাই-আগস্টে অভ্যুত্থান চলাকালে ১৪ শতাধিক মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। ক্ষমতায় টিকে থাকতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ও আওয়ামী লীগ নৃশংসতা চালিয়েছে। আর এই হত্যাযজ্ঞে সমন্বয়ের ভূমিকায় ছিলেন খোদ শেখ হাসিনাই। এমনকি সম্প্রতি বিবিসি ও আল জাজিরার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে হাসিনার সেইসময়কার ফোনালাপ ফাঁস হয়, যেখানে তাকে সরাসরি লেথাল ওয়েপন (প্রাণঘাতী অস্ত্র) ব্যবহারের নির্দেশ দিতে শোনা যায়।

এত দমন-পীড়নের পরও হাসিনা গদি আঁকড়ে রাখতে পারেননি। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা গণভবন অভিমুখে রওয়ানা দিলে হাসিনা জনরোষ থেকে বাঁচতে ভারতে পালিয়ে যান। সঙ্গে নিয়ে যান বোন শেখ রেহানাকেও। তার আগে পরে বিদেশে পালিয়ে যান হাসিনার নির্দেশে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালানো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা ও দলের মন্ত্রী-এমপিসহ নেতা-কর্মীরা।

শেখ হাসিনা যখন ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন তখন তিনি গণভবন বরাদ্দ নিয়ে সেখানে বসবাস করতে শুরু করেন। প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়ার পরেও তিনি সেখানে বাস করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তীব্র রাজনৈতিক বিতর্কের মুখে শেখ হাসিনা ২০০১ সালে গণভবন ছাড়তে বাধ্য হন। পরে ২০০৮ সালে বিতর্কিত ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী হয়ে আবার গণভবনে থাকতে শুরু করেন তিনি। এই গণভবনকেই তিনি তার ফ্যাসিবাদী শাসনের কেন্দ্রে পরিণত করেন। ৫ আগস্ট সেই গণভবন থেকে তাকে পালাতে হয়। অন্তর্বর্তী সরকার ওই ভবনকে ‘জুলাই গণ–অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর’ হিসেবে গড়ে তুলছে।