
আন্তর্জাতিক একটি দাতা সংস্থায় কর্মরত আহসান কবিরের ছেলে রায়হান আহমেদ। রাজধানীর ইংরেজি ভার্সন স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। স্কুল এ শিক্ষার্থীর খুব প্রিয় জায়গা। বন্ধুদের সঙ্গে খেলা, শিক্ষকদের স্নেহ সব মিলিয়ে অসুস্থ না হলে রায়হান সাধারণত স্কুল কামাই করে না। গত দুই দিন ধরে সে কিছুতেই স্কুলে যেতে চাইছে না। জানতে চাইলে রায়হান বলে, ‘স্কুলে গেলে যদি প্লেন ক্রাশ হয়! ভয় লাগে।’ তার মতো আরও অনেক শিশুই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় এখন ট্রমায়। মনে তাদের ভয়- এই বুঝি কোনো দুর্ঘটনা হয়!
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, বড় দুর্যোগের সময় শিশুদের মধ্যে তীব্র মানসিক চাপ হয়। ঘুমের সমস্যা হয়। মনোযোগ কমে যায়। খাবার খেতে পারে না। বয়স হয়ে গেলেও কেউ কেউ বিছানায় প্রস্রাব করে। চিন্তা ও আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা
দেয়। নিজেকে আঘাত করে। আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়। দূরবর্তী প্রভাব হিসেবে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার হতে পারে। ব্যক্তিত্বেও সমস্যা হতে পারে। মানসিক ভারসাম্য হারানোর আশঙ্কা আছে। বিষণ্ন হয়ে যেতে পারে। সব সময় আতঙ্ক কাজ করতে পারে।
মানসিক চিকিৎসকরা জানান, বড় ট্রমার পর পাঁচ ক্যাটাগরিতে মানুষের ভিতর ট্রমা তৈরি হয়। যারা স্বজন হারিয়েছে বা আহত হয়েছে। যারা আহত না হলেও দুর্ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে প্রত্যক্ষ করে। উদ্ধারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তি। চিকিৎসক ও সংবাদকর্মী। শেষ ক্যাটাগরিতে আছেন সাধারণ মানুষ, যারা দূরে থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে এ দুর্ঘটনা দেখে। মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায়ও এমনটি হয়েছে।
শিশু-কিশোরদের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, শিশুদের মানসিক চাপের বিষয়টি এখানে আলাদা। এ দুর্ঘটনায় শিশুরা বেশি আহত-নিহত হয়েছে। স্কুল শিশুদের আনন্দের জায়গা। সেই জায়গায় বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাদের বয়সি অন্য শিশুরা আহত ও নিহত হওয়ায় তাদের মধ্যে বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, এ ধরনের দুর্যোগে শিশুদের বীভৎসতার দৃশ্য না দেখানোর চেষ্টা করতে হবে। সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের আহত শিশুদের কাছে ঘটনার বিবরণ না জানার অনুরোধ করেন তিনি। শিশুটিকে আগে ধাতস্থ হতে দিতে হবে। শিশুদের কাছে নেতিবাচক কথা বলা ঠিক হবে না। তারা যেন স্কুল ও বন্ধুদের থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন না থাকে। রাতে পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করতে হবে। শিশুর স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু রাখতে হবে। আত্মীয়স্বজন ও মা-বাবাদের শিশুদের সঙ্গে ভালো সময় কাটাতে হবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. নূর আহমেদ গিয়াসউদ্দিন বলেন, মাইলস্টোন স্কুল ট্র্যাজিডিতে শিশুদের মধ্যে মানসিক চাপজনিত রোগ তৈরি হতে পারে। এ দুর্ঘটনায় শিশুরা নিজের জীবনে ঘটা দুর্ঘটনা বা মিডিয়া থেকে দুর্ঘটনার চিত্র দেখেছে। চিকিৎসক ও নার্সরা কম বয়সি শিশুদের কষ্ট পেতে দেখছেন। তারাও ভারাক্রান্ত। তাদেরও মানসিক রোগ সৃষ্টির আশঙ্কা আছে। আহত শিশুসহ প্রত্যক্ষদর্শী অন্য মানুষের মধ্যে মানসিক রোগ বিস্তার করতে পারে এ দুর্ঘটনা। সরাসরি ক্ষতিগ্রস্তদের শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা নিশ্চিতসহ ফলোআপ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। দগ্ধ শিশুদের পাশাপাশি তাদের ট্রমাটাইজড অভিভাবকদেরও মানসিক স্বাস্থ্যসেবার প্রাথমিক নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে। গণমাধ্যমে দুর্ঘটনার ভয়াবহ দৃশ্য ঢেকে দেখাতে হবে। পরোক্ষভাবে ভীত হয়ে পড়া শিশুদের আগের চেয়ে বেশি সঙ্গ দিতে হবে অভিভাবকদের। শিশুদের নিয়ে ঘুরতে যেতে পারেন। ঘরে খেলতে পারেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রেজাউল করিম বলেন, যে শিশুরা এ দুর্ঘটনা সরাসরি বা মিডিয়ায় দেখেছে, তাদের এখন বেড়ে ওঠার সময়। এ সময়ে তাদের মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটে। এ ধরনের ট্রমাটিক অভিজ্ঞতায় মস্তিষ্কের ক্ষতি হয়। বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। শিশুর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিষণ্ন হতে পারে। আতঙ্ক কাজ করতে পারে।