Image description

হঠাৎ পুলিশের গুলি। টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড। সামনে থাকা অসহায় জনতা। দৌড়াচ্ছেন প্রাণপণে। কী হচ্ছে, বুঝে উঠতে পারছেন না কেউ। সাংবাদিকরা আশ্রয় নিয়েছেন ডায়াবেটিস গলির একটু ভেতরে। খানিক পর শান্ত পরিবেশ। রক্তাক্ত এক যুবক রাস্তায় দাঁড়িয়ে। হাতে ক্যামেরা। পরনে প্রেস লেখা ওভার কোট। বুলেটে ঝাঁঝরা শরীর। চোখে, মুখে গুলি আর গুলি। রক্ত ঝরছে। এগিয়ে গেলেন সাংবাদিকরা। সে তুরাব। সিলেটের সাংবাদিক এটিএম তুরাব। এডিসি দস্তগীর রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে তখনো গুলি ছুড়ছিলেন। এমন সময় ফের বন্দুক তাক করছিলেন তুরাবের দিকে। ওপাশ থেকে সাংবাদিক মুহিতের চিৎকার- ‘ভাই আমরা সাংবাদিক।’ তুরাবের শরীরের অবস্থা দেখে অনেকেই ভড়কে যান। দ্রুতই তুরাবকে নেয়া হলো সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। বিকালে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে নিয়ে আসা হলো সুবহানীঘাটে ইবনে সিনা হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তুরাব। তিনি ছিলেন জাতীয় দৈনিক নয়াদিগন্ত ও সিলেটের স্থানীয় দৈনিক জালালাবাদ পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার।

সিলেটের শহীদ সাংবাদিক এটিএম তুরাব। টগবগে এক তরুণ। লন্ডনি কইন্যা বিয়ে করেছিলেন মাত্র কয়েক মাস আগে। সেদিন ঘটনাস্থলেই ছিলেন মানবজমিনের মাল্টিমিডিয়ার সিলেটের ফটো সাংবাদিক মাহমুদ হোসেন। ঘটনাস্থলে তার খুব কাছেই ছিল তুরাব। জানালেন; ‘দিনটি ছিল শুক্রবার। ১৯শে জুলাই। জুম্মার নামাজের পর বিএনপি’র তরফ থেকে মিছিল বের করা হবে। সে মেসেজ ছিল সাংবাদিকদের কাছে। এ কারণে জুম্মার নামাজের আগেই সবাই সেখানে যান। নামাজ পড়েন কালেক্টরেট মসজিদে। আর নামাজ শেষে শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল বের হয়। 

মিছিলটি যখন চলে যাচ্ছিলো তখন পেছন থেকে গুলি ছুড়ে পুলিশ। টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। সাংবাদিক তুরাব তখন ছিলেন রেলিংয়ের উপর। আর পুলিশের এই গুলিতেই ঝাঁঝরা হয়ে যায় তুরাবের দেহ। মাহমুদ বলেন- ‘তুরাবের বাড়ি আর আমার বাড়ি একই উপজেলায়, বিয়ানীবাজারে। তুরাব আমার অনেক কাছের ছিল। সেদিনের তুরাবের রক্তমাখা শরীর আজও আমার চোখে ভাসছে।’ তুরাব নিহত হওয়ায় ক্ষোভের সঞ্চার হয় সিলেটে। দায়ীদের গ্রেপ্তার দাবিতে আন্দোলনও চালিয়েছেন সাংবাদিকরা। মামলা হয়েছে পরিবারের পক্ষ থেকে। এক বছরে দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে একজন হচ্ছেন ওদিনের মাঠের কমান্ডিং অফিসার সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি সাদেক কাওছার দস্তগীর ও অপরজন পুলিশ কনস্টেবল উজ্জ্বল। দুই আসামিকে রিমান্ডে আনা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে এখনো দেয়া হয়নি চার্জশিট। তুরাব হত্যা মামলাটি প্রথমে তদন্ত করেছিল পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই। সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা মুহাম্মদ মুরসালিন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন- মামলাটি এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে তদন্ত চলছে। তিনি ইতিমধ্যে মামলার সব নথিপত্র ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়েছেন। এ মাসেই তদন্ত শেষ করে তদন্ত টিম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রিপোর্ট জমা দিতে পারেন বলে জানান তিনি। তুরাব হত্যার মামলার বাদী তার বড় ভাই আবুল আহসান মোহাম্মদ আজরাফ জাবুর। 

তুরাব হত্যার পর তিনি মামলা করতে কোতোয়ালি থানায় গিয়ে ওই সময় নানাভাবে হেনস্তার শিকার হন। উল্টো তার উপর চলে চোখ রাঙানি। তিনি যে এজাহার জমা দিয়েছিলেন সেটি নিয়েও চলে তৎকালীন পুলিশের টালবাহানা। ৫ই আগস্ট রক্তাক্ত গণ-অভ্যুত্থানের পর মামলা করেন জাবুর। সেই মামলাটির তদন্ত এখনো চলমান। ইতিমধ্যে মামলার তদন্তের জন্য সিলেট সফর করে গেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তারাও। মামলার বাদী জাবুর জানিয়েছেন- তুরাবকে পরিকল্পিত ভাবে খুন করা হয়েছিল। দ্রুততম সময়ের মধ্যে মামলার চার্জশিট ও বিচার চাই। তিনি বলেন- তার বৃদ্ধা মা তুরাব হত্যার বিচার চান। প্রতিদিনই তার প্রশ্ন কবে তুরাব হত্যার বিচার শুরু হবে। বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন সিলেট বিভাগীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশকার আমীন লস্কর রাব্বি জানিয়েছেন- মামলায় মোট ১৮ জন আসামি হলে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন দুইজন। আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের এক বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো মামলাটি তদন্তেই আটকে আছে। তিনি বলেন- আমাদের দাবি হচ্ছে সকল আসামিকে গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা। একই সঙ্গে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচার শেষ করা। ছেলের শোকে কেঁদেই চলেছেন সাংবাদিক এটিএম তুরাবের মা মমতাজ বেগম। পরিবারের ছোট ছেলে তুরাব। তুরাবকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল মায়ের। কিন্তু ঘাতকদের গুলিতে তুরাব নিহত হওয়ায় সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। ছেলের শোকে কাতর বয়োবৃদ্ধ মায়ের একটিই চাওয়া- ছেলে তুরাব হত্যার বিচার। তিনি বলেন- ‘আমার জীবদ্দশায় তুরাব হত্যার বিচার দেখে যেতে চাই।’