
জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অবিস্মরণীয় সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ স্মরণে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় রাজধানীর হাতিরঝিল অ্যাম্ফিথিয়েটারে অনুষ্ঠিত হয় ‘১৮ জুলাই : প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি রেজিস্ট্যান্স ডে’। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় যৌথভাবে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানজুড়ে ছিল বিশেষ চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, গান এবং ড্রোন শো। প্রদর্শিত হয় ‘হিরোস উইদাউট কেপস : প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিজ ইন জুলাই’, ‘ইউ ফেইল্ড টু কিল আবরার ফাহাদ’।
জুলাই বিদ্রোহের সেই দিনগুলো শব্দ আর সুর হয়ে ফিরে আসে র্যাপার কালেকটিভ, সেজান, তাশফি, সানি এবং আর্টসেল ব্যান্ডের কণ্ঠে। ড্রোন শো-তে ভেসে ওঠে সেদিনের রাজপথের দৃশ্যাবলি।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের চোখেমুখে ঝিলিক কাটে সেই সময়কার স্মৃতি। তাঁরা স্মরণ করেন সেই সংগ্রামী দিনগুলো। অনুষ্ঠানে জুলাই নিয়ে প্রদর্শিত ডকুমেন্টারি দেখে তাঁদের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে পানি। গানের সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাঁদের কণ্ঠে প্রকাশ পায় সহপাঠী হারানোর বেদনা।
‘কত মারবে, আমরা সরব না’—জুলাইয়ের স্মৃতি স্মরণ করে কথাটি বলছিলেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত নর্দান ইউনিভার্সিটির ল বিভাগের শিক্ষার্থী সামিহা তাহের।
তিনি বলেন, ‘আমরা ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ১৬ জুলাই থেকে এয়ারপোর্ট সড়কে নামি।
পরে ১৮ জুলাই উত্তরায় অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলি। পুলিশের গুলি আমাদের থামাতে পারেনি। আমার ভাইয়েরা যখন পুলিশের টিয়ার শেল আর গুলিতে পিছু হটে যাচ্ছিল, তখন আমি কিছু মেয়ে শিক্ষার্থীকে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাই। আমাদের দেখে আবারও শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। আন্দোলনে আমাদের সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল উত্তরার বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা।
ওই শিক্ষার্থীদের সাহস দেখে আমাদের ভেতর থেকে মৃত্যুভয় চলে যায়।’
‘সংঘাত করতে চাইনি, প্রতিবাদ জানাতে গিয়েছিলাম, কিন্তু আমাদের ওপর নেমে আসে নিপীড়ন,’ কথাগুলো বলছিলেন ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (আইইউবি) শিক্ষার্থী সাফায়াত আলম ফাহিম।
তিনি বলেন, ‘আমাদের মনে হয়েছিল—আমরা কিছু পারি না পারি, অন্তত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইদের পাশে দাঁড়াব। তাতে যদি তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সাহস পায়। আমরা ১৫ জুলাই থেকে প্রতিবাদ শুরু করি। কিন্তু ১৮ জুলাই যখন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির দিকে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হচ্ছে শুনতে পাই, আমরা নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সঙ্গে একত্রিত হয়ে বাড্ডার দিকে এগিয়ে যাই। সেদিন মনে হয়েছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যিকার লড়াইয়ে নেমেছি।’
আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের শিক্ষার্থী মো. শাহারিয়া ইমন বলেন, ‘যখন আমরা ফেসবুকে দেখলাম, জাহাঙ্গীরনগর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ ও ছাত্রলীগ আক্রমণ চালিয়েছে, তখন থেকেই মন অশান্ত হয়ে উঠেছিল। পরে যখন আবু সাঈদের গুলি খাওয়ার দৃশ্য নিতে পারছিলাম না, তখন আমরা ক্যাম্পাস থেকে উদ্যোগ নিই রাজপথে নামার। ওই সময় আমরা জানতাম না আমরা কী করব। আমাদের চিন্তায় ছিল কেবল আমাদের ভাইদের পাশে দাঁড়াতে হবে।’
বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান। তারুণ্যের হাত ধরে সৃষ্টি হওয়া ওই গণ-অভ্যুত্থান ফের প্রমাণ করেছিল, অন্যায় চাপিয়ে দেওয়া যায় না। ন্যায্য দাবির কারণে যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর চালানো হচ্ছিল রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হচ্ছিল শিক্ষার্থীদের, তাঁদের রক্ত দেখে নীরব থাকতে পারেননি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গত বছর ১৫ জুলাই থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিকে সমর্থন জানিয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসভিত্তিক প্রতিবাদ শুরু করলেও ১৮ জুলাই থেকে সম্মিলিতভাবে রাজপথে নেমে এসেছিলেন তাঁরা। দাঁড়িয়েছিলেন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও। ছিলেন লড়াইয়ের শেষ দিন পর্যন্ত।
সেদিন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রমাণ করেছিলেন, শুধু নিজের জন্য বাঁচা নয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অন্যের পাশেও দাঁড়াতে জানেন তাঁরা। ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রাণও দিয়েছিলেন। বন্ধুর লাশ কাঁধে নিয়ে ফের রাজপথে নেমেছেন। ফ্যাসিবাদের পতনের পথ সংক্ষিপ্ত হয়েছিল তাঁদের আত্মত্যাগে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই সংহতির শক্তি সে সময় ছড়িয়ে পড়েছিল সমাজের মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত এবং সচেতন মানুষের মাঝে।