
গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর খাদ্যসচিব হিসেবে চুক্তিতে নিয়োগ পেয়েছিলেন অবসরে থাকা ইলাহী দাদ খান। তিনি দুদকের দুর্নীতির মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি হওয়ায় পরদিনই তাঁর নিয়োগ বাতিল করে সরকার। একইভাবে বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান এ কে এম মতিউর রহমানকে অতিরিক্ত সচিব থেকে পদোন্নতি দিয়ে নৌপরিবহন সচিব করার পরের দিনই ওএসডি করা হয়। কারণ তিনি ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর, বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে ২৯টি বই লিখেছেন। ঠিক একই কায়দায় বিদেশের মিশনগুলোর কোনো কোনোটিতে বিভাগীয় ও দুদকের মামলায় অভিযুক্ত কর্মকর্তাদেরও পদায়ন করা হচ্ছে।
প্রশাসনের এমন বেখেয়াল কর্মকাণ্ডকে ‘বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি ও সুশাসনের পরিপন্থী’ বলে মন্তব্য করেছেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, মামলা চলমান আছে এমন কর্মকর্তাকে বিদেশে পদায়ন করা মানেই সেই মামলাকে কবর দেওয়া বা ধামাচাপা দেওয়ার শামিল, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
উল্লিখিত বিষয় নজরে আসায় নড়েচড়ে বসেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
প্রশাসনে বৈদেশিক নিয়োগের আগেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার চাকরি জীবনের সব তথ্য চুলচেরা বিশ্লেষণ করার নির্দেশ দিয়েছে তারা। বিদেশে কর্মকর্তা পদায়নের মৌখিক পরীক্ষার আগেই শৃঙ্খলা (বিভাগীয় মামলা ও দুদক) এবং গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করার ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
গত ৩ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনিকে লেখা এক চিঠিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব (এপিডি) মো. এরফানুল হক জানান, ‘ইদানীং লক্ষ করা যাচ্ছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগের কর্মকর্তাদের বৈদেশিক নিয়োগের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে প্রেষণাদেশ জারির পর তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা ও শৃঙ্খলাসংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে। এতদসংক্রান্ত জটিলতা এড়ানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ কর্তৃক বিদেশে কর্মকর্তা পদায়নের নিমিত্ত প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণের আগেই শৃঙ্খলা (বিভাগীয় মামলা ও দুদক) এবং গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করা সমীচীন।
প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিষয়টি নির্দেশক্রমে অবহিত করা হলো।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এপিডি শাখার একাধিক কর্মকর্তা বলেন, “বিদেশে পদায়নে এখন আর যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা দেখা হয় না। দেখা হয় ‘অজ্ঞাত যোগ্যতা’। সিলেকশন কমিটির সদস্যদের খুশি করার যোগ্যতা অর্জন করলেই পাওয়া যায় বিদেশে পোস্টিং। অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আছে এমন অনেক কর্মকর্তাকেও বিদেশে পদায়নের জন্য মনোনীত করেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ।
যেহেতু এটির দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের, তাই এখানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কোনো ভূমিকা থাকে না। আমরা শুধু ডাকঘরের দায়িত্ব পালন করে থাকি। পরে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার অনিয়ম, দুর্নীতি ও মামলা চলমান থাকার নানা তথ্য আসে আমাদের হাতে। এসব কারণেই মূলত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।”
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্মকর্তাদের পার্সোনাল ডেটাশিট (পিডিএস) সঠিকভাবে পর্যালোচনা না করে পদায়ন-পদোন্নতি দেওয়া, ফের পরের দিনই পদ থেকে অপসারণের ঘটনায় প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে পড়ার চিত্র ফুটে উঠেছে। পদায়নের ক্ষেত্রে আর্থিক দুর্নীতির অনাকাঙ্ক্ষিত অভিযোগ জনপ্রশাসনের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করেছে।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. ফিরোজ মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মামলা চলমান আছে এমন কর্মকর্তাকে প্রশাসনে নিয়োগ বা বিদেশে পদায়ন করা মানেই সেই মামলাকে কবর বা ধামাচাপা দেওয়ার শামিল, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এটা বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি ও সুশাসনের পরিপন্থী কাজ। এ ধরনের কর্মকর্তাদের যাঁরা মনোনয়ন দিয়ে থাকেন বা এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কমিটির সদস্যদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।’
জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পরপরই জনপ্রশাসনে এক ধরনের অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ভেঙে পড়ে প্রশাসনের ‘চেইন অব কমান্ড’। অবসর ও বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া বিএনপি-জামায়াতপন্থী কর্মকর্তাদের চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। মন্ত্রিপরিষদসচিব, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্যসচিব, জনপ্রশাসন, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র, স্বাস্থ্য, ভূমি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সচিব পদে এমন কর্মকর্তাদের চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়, যাঁদের সঙ্গে প্রশাসনে বিগত ১৫ বছরে কোনো সম্পর্ক বা সংযোগ ছিল না। ফলে তাঁদের ফ্যাসিস্ট আমলে নিয়োগ পাওয়া জুনিয়র কর্মকর্তাদের ওপরই নির্ভর করতে হয়েছে। এ ছাড়া যাঁরা চুক্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁদের অনেকে নিজ নিজ ব্যাচের বন্ধু কর্মকর্তাদেরও নানাভাবে প্রমোট করার চেষ্টা করেছেন।
এর জলজ্যান্ত উদাহরণ হলো, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে গত ৩০ সেপ্টেম্বর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল অবসরে থাকা বিসিএস ১৯৮২ নিয়মিত ব্যাচের খাদ্য ক্যাডার কর্মকর্তা ইলাহী দাদ খানকে। তিনি নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি হওয়ার পরও তাঁরই ব্যাচমেট চুক্তিতে নিয়োগ পাওয়া এসএসবির কর্মকর্তারা এ নিয়োগে প্রভাব রাখেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পরে বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ায় পরের দিনই তাঁর নিয়োগ বাতিল করে সরকার। এর আগে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পরপরই মাঠ প্রশাসনে ব্যাপক রদবদলের অংশ হিসেবে ৫৯ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগের পর তীব্র হট্টগোলের মুখে আটজনকে পরের দিনই প্রত্যাহার করে নেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সেই সঙ্গে চারজনের কর্মস্থল বদলে দেওয়ার পাশাপাশি ওএসডি করা হয় একজনকে। এ ছাড়া ডিসি নিয়োগে চুক্তিতে নিয়োগ পাওয়া জনপ্রশাসনসচিব ও দুই যুগ্ম সচিবের বিরুদ্ধে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ ওঠার পরও তার কোনো সুরাহার কথা শোনা যায়নি। বরং প্রশাসনে অস্থিরতা আরো বেড়েছে।