Image description

দেশের ৬৪ জেলার সবকটিকে যুক্ত করে উড়াল মহাসড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করছে অন্তর্বর্তী সরকার। যার অংশ হিসেবে মূল সড়কের ওপর তৈরি হবে আরেকটি দ্বিতল সড়ক ব্যবস্থা। কোথাও কোথাও কয়েক তলার সড়ক নির্মাণের ভাবনাও আছে। এতে বাধাহীনভাবে সারা দেশে সর্বক্ষণ পণ্যবাহী যান চলাচলের সুযোগ তৈরি হবে। আর বিপুল এ কর্মযজ্ঞের শুরু হবে ঢাকা-চট্টগ্রাম উড়াল মহাসড়ক (এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে) নির্মাণের মধ্য দিয়ে। তবে প্রশ্ন উঠেছে, অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় ব্যয় সংকোচনে বড় প্রকল্প না করার যে কথা দিয়েছিল, সেই নীতি থেকে কি তাহলে সরে আসছে সরকার?

জানা গেছে, গত ২৭ এপ্রিল ‘সেতু বিভাগের আওতাধীন চলমান, প্রক্রিয়াধীন এবং পরিকল্পনাধীন বৃহৎ প্রকল্প সংক্রান্ত পর্যালোচনা’ সভায় ৬৪ জেলাকে উড়াল মহাসড়কের আওতায় নিয়ে আসতে নীতিগত সম্মতি হয়েছে। সভায় সভাপতিত্ব করেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।

সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়, ‘দেশের ৬৪ জেলাকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যুক্ত করার বিষয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের জন্য দ্রুত প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।’

সভা সূত্রে জানা গেছে, দেশের সব জেলাকে কেন্দ্র করে ‘ইন্টিগ্রেটেড মাল্টিমোডাল’ পরিবহন যোগাযোগ ব্যবস্থা (একাধিক মোড বা পদ্ধতির সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা) তৈরি করা নিয়ে আলোচনা হয়। সারা দেশে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বা উড়াল মহাসড়ক নির্মাণের যে ভাবনা, এটি সেই বড় পরিকল্পনারই একটি অংশ। আর এ বড় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ প্রথম শুরু হবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মাধ্যমে।

বিষয়টি নিয়ে ওই সভায় অংশ নেওয়া এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কথা বলেছেন কালবেলার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এখন ইচ্ছামতো আলাদা আলাদা সড়ক তৈরি হচ্ছে। এগুলো বন্ধ করতে একটা বড় পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এ পরিকল্পনায় নৌ, রেল ও সড়ককে এক সুতোয় আনা হচ্ছে। যাত্রীর চাহিদা বিবেচনা করে যেখানে যে ধরনের পরিবহন ব্যবস্থা দরকার, সেখানে সে ধরনের পরিবহন ব্যবস্থা কীভাবে তৈরি করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।’

জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘আমরা একটা হাব নির্মাণের চিন্তা করছি। যেখানে রেলপথ, নৌপথ, সড়কপথ— সবই থাকবে। কোথায় কোথায় এগুলোর সংযোগ নেই, সেটা খোঁজা হচ্ছে। যেখানে যেটা জরুরি, সেখানে সেটা নির্মাণ করা হবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ) নির্বাহী পরিচালক ও সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ আবদুর রউফ কালবেলাকে বলেন, ‘সব জেলাকে যুক্ত করে যদি উড়াল মহাসড়ক নির্মাণ করা হয়, তাহলে নিচের সড়কে চাপ কমবে। পণ্যবাহী যানে দিন ও রাতে কোনো বাধা থাকবে না। অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখা যাবে।’

ঘোষিত নীতি থেকে কি সরে আসছে সরকার: দ্বিতল মহাসড়কের সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলা হলেও এসব ভাবনার সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের এর আগের ঘোষিত নীতি মিলছে না। সরকারের পক্ষ থেকে বড় প্রকল্পে আগানোর ভাবনা ছিল না। সরকার সেই কথা রাখছে না। বরং নতুন নতুন প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) পাস করা হচ্ছে। সঙ্গে আরও বড় বড় প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) প্রথম সভা হয় গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর। ওই সভায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ‘এখন থেকে মেগা প্রকল্প না নিয়ে জনগুরুত্বপূর্ণ ছোট প্রকল্প নেওয়া হবে।’ পরবর্তী সময়ে তার কথার সুর ধরে সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা, অর্থ উপদেষ্টাসহ একাধিক দায়িত্বশীল ব্যক্তি বড় প্রকল্প হাতে না নেওয়ার পক্ষে কথা বলেছেন।

সেসব আলোচনার বিষয়টি সড়ক উপদেষ্টার সামনে তুলে ধরা হলে তিনি বলেন, ‘যেগুলো খুবই জরুরি, শুধু সেগুলো করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে আমরা ৫০ হাজার কোটি টাকার মতো ব্যয় কমিয়েছি। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দেওয়া হয়েছে। ইন্টিগ্রেটেড মাল্টিমোডাল হাব জরুরি।’

ভাবনায় কয়েক তলা পর্যন্ত সড়ক: সড়কের ওপরে সড়ক, নাকি সড়কের পাশে সড়ক—এটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এ দুটির ক্ষেত্রে দুই ধরনের জটিলতা রয়েছে। প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে প্রথমে প্রাথমিক জরিপ ও পরে অধিকতর যাচাইয়ের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়ে থাকে। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর উড়াল মহাসড়কের মূল পথ নির্ধারণ করা হবে।

বিদ্যমান সড়কের ওপর যদি উড়াল সড়ক নির্মাণ করা হয়, তাহলে মূল সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি ও বন্ধ থাকার ভোগান্তি বহু বছর পোহাতে হবে সড়ক ব্যবহারকারীদের। আর যদি বিদ্যমান সড়কের বাইরে গিয়ে উড়াল সড়কের পথ নির্ধারণ হয়, সে ক্ষেত্রে কিছু জায়গায় ভূমি অধিগ্রহণের জটিলতার মুখে পড়তে হতে পারে।

সেতু বিভাগের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘সভায় আলোচনা অনুযায়ী কয়েক তলা পর্যন্ত উড়াল সড়ক নির্মাণ করা হতে পারে। উড়াল মহাসড়ক নির্মাণের আইনি বৈধতা সেতু বিভাগের রয়েছে। তাই এগুলো সেতু বিভাগ নির্মাণ করবে। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর অর্থায়নের সন্ধান মিললে প্রয়োজনীয় ভূমি অধিগ্রহণ করে ফেলা হবে।’

এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামছুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘আমাদের বেশিরভাগ প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে ভূমি অধিগ্রহণ একটা ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে যদি দেখা যায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নযোগ্য, তাহলে আগে ভূমি অধিগ্রহণ করতে হবে, পরে অবকাঠামোর বিনিয়োগে যেতে হবে।’

টাকা মিলবে কোথায়, পিপিপিতে অগ্রাধিকার: পুরো প্রকল্প বাস্তবায়নে কত টাকা খরচ হবে, মোটাদাগে তার ধারণা এখনো নির্ধারণ করা যায়নি। খরচের ধারণা নির্ধারণ হবে বিশদ নকশার পর। আবার বিশদ নকশা তৈরির পাশাপাশি সম্ভাব্যতা যাচাই, পরামর্শক নিয়োগ, ঠিকাদার বাছাই প্রক্রিয়া চলমান রাখা হয়। বিনিয়োগের ধরনের ওপর এসব নির্ভর করে।

তবে চোখের সামনে থাকা দুটি উড়াল মহাসড়কের মধ্যে প্রায় ২০ কিলোমিটারের ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে খরচ হচ্ছে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণসহ সহযোগিতামূলক কাজের জন্য আলাদা একটি ‘সাপোর্ট প্রজেক্টে’ খরচ হয়েছে আরও প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। আরেকটি ২৪ কিলোমিটারের উড়াল মহাসড়ক ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে খরচ হচ্ছে প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে, সরকারের ভাবনায় থাকা জাতীয় পর্যায়ের প্রথম ঢাকা-চট্টগ্রাম উড়াল মহাসড়কের দৈর্ঘ্য হবে অন্তত ২০৬ কিলোমিটার। যদি ঋণ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে আগে খরচ নির্ধারণ করে ঠিকাদার খোঁজা হয়। কিন্তু দুই দেশের সরকারি উদ্যোগে (জি-টু-জি) বা সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে বিনিয়োগ নেওয়া হয়, তাহলে আগে ঠিকাদার নিয়োগ হয়, পরে ঠিকাদার খরচ নির্ধারণ করে। বর্তমান কর্তৃপক্ষ পিপিপি পদ্ধতিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায়।

কথা হলে সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ আবদুর রউফ কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা পিপিপিতে কাজ করতে চাই। এতে আমাদের কোনো খরচ যাবে না। একটা সম্পদ তৈরি হবে। এরই মধ্যে চীন, কোরিয়া ও জাপানের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। এর বাইরেও অনেকেই বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করছে।’

কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের বড় প্রকল্প নিয়ে এমন ভাবনা অর্থনীতির বিদ্যমান বাস্তবতার সঙ্গে কতটা সমান্তরাল—এমন প্রসঙ্গে আলোচনা হলে অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখা ভালো। কিন্তু করদাতার অর্থ খরচ করে স্বপ্ন দেখার আগে একটু ভাবেন। এত বড় প্রকল্প করার আগে যে সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হবে, সেখানেই অনেক টাকা খরচ হবে। সেই টাকা এ সরকারের খরচ করা কতটুকু দরকার, সেটা ভাবা জরুরি।’

সরকারের নীতিনির্ধারকদের উদ্দেশে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘আপনারা আছেন অল্প দিনের জন্য। পারলে এ সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় চলমান কিছু কাজ শেষ করে যান। জাতীয় পর্যায়ে নতুন কাজ শুরু করার দরকার নেই। নতুন কাজে অর্থনৈতিক যাচাই-বাছাই জরুরি, অর্থনৈতিক ঝুঁকি থাকে। সেটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ। বড় প্রকল্পের অর্থায়ন কীভাবে হবে, সেই ঝুঁকি স্বল্পমেয়াদি সরকারের নেওয়া ঠিক হবে না।’