Image description
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ আকরাম খান রাব্বির মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয় ঘটনার তিন দিন পর। এই তিনটি দিন ছেলের মরদেহ একটু ছুঁয়ে দেখার অপেক্ষায় ছিলেন মা। সেই হাহাকার এখনো তাঁর শূন্য বুকে গুমরে মরছে।

২০২৪ সালের ১৯ জুলাই রাজধানীর মিরপুরে শহীদ হন আকরাম খান রাব্বি। তবে ঢাকা মেডিক্যাল থেকে তাঁর লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর হয় ২১ জুলাই।

বাষ্পরুদ্ধ গলায় কালের কণ্ঠকে বিউটি বলেন, ‘১৯ তারিখ সকালে রাব্বি আমার সঙ্গে ওয়াশিং মেশিনে কাপড় ভিজাল। এরপর রাব্বি গোসল করে এক পিস রুটি খেয়ে একটা হাসি দিয়ে চলে গেল। আমাকে দরজা লাগাতে বলল, কিন্তু আমি আর আমার ছেলের দিকে ফিরা তাকাই নাই।
কী মনে করে আমাকে বারবার তাকাইতে বলছিল, কিন্তু তাকাই নাই। আমি আমার সন্তানরে আরেকটা নজর দেখতে পারলাম না। তিন দিন অপেক্ষায় থাকার পরেও আমি আমার বাবার লাশ ছুঁইতে পারলাম না। আমার লক্ষ্মীসোনা আর আসবে না।
আমাকে জড়িয়ে ধরবে না।’

রাব্বির বাবা মো. ফারুক খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১৯ জুলাই একটু বেলা করেই দুপুরের খাবার খাচ্ছিলাম। বিকেল ঠিক ৪টা ১৭ মিনিটে আমার কাছে ফোন আসে যে রাব্বির গায়ে গুলি লেগেছে। এটা শুনে ভাত ফেলে দৌড় দিলাম। আমাকে বলা হলো, ওকে ১১ নম্বরের ইসলামী হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
তো আমরা ইসলামী হাসপাতালের উদ্দেশে প্যারিস রোডে পৌঁছি। তখন আরেকটি কল আসে। বলা হয়, ইসলামীতে তাকে রাখেনি। ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে গেছে। আমরা গাড়ি ঘুরিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল গেলাম। সেখানে ওকে আর জীবিত পাইনি। তো আমি যখন লাশ চাইলাম, তখন আমাকে বলা হলো, পুলিশের অনুমতি ছাড়া লাশ দেবে না। তখন আমি পুলিশের অনুমতির জন্য থানাগুলোতে ঘুরছি। কোনো থানাই আমাদের গুরুত্ব দেয়নি। পরে কয়েকজনের সহযোগিতায় ২১ তারিখ লাশ আনতে পারি।’

রাব্বির শূন্যতা আর কখনো পূরণ হবে না—বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন ফারুক খান। তিনি বলেন, ‘রাব্বির কথাবার্তা, চলাফেরার স্মৃতি সব সময় মনে পড়ে। ওকে আমরা অনেক মিস করি। ও যখন ঘরে আসত, ঘরটা উজ্জ্বল হয়ে যেত। এখন আমার সেই জিনিস নেই। এই শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়।’

বাবা ফারুক খানের কথা শেষ না হতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন মা বিউটি। চোখ মুছতে মুছতে তিনি বলেন, “আমি গর্বিত যে আমি রাব্বির আম্মু! সারা দিন ও আমার খোঁজখবর নিত। অফিসে গেলেও, ভার্সিটিতে গেলেও ফোন দিয়ে জানত—‘আম্মু কী করতাছ, কী রান্না করতাছ?’ খাবার খেয়ে ওষুধ খাইছি কি না, পানি নিছি কি না—সব খোঁজ নিত। আবার রাতে উঠে দেখত আমার কোনো সমস্যা কি না। বলত, ‘তোমার কোনো সমস্যা হলে আমাকে ফোন দিও।’ সকালে উঠে ওর রুমে যাইতাম, ওকে দেখতাম। যখনই দেখি ঘরে রাব্বি নেই, মনে হয় মৃত্যুর সমান কষ্ট! রাব্বি শুধু ছেলে না, আমার বন্ধু ছিল। ও আমার মা-বাবাও ছিল। সেই সন্তান যাওয়ার পরে কোনো মা বেঁচে থাকতে পারে? আমি যে বেঁচে আছি এটাই আলহামদুলিল্লাহ। ও আমার মাথায় তেল দিয়ে দিত, হাত-পায়ের নখ কেটে দিত—এত কেয়ার আমার মা-বাবাও করে নাই।’

সন্তান হত্যার বিচার চেয়ে ফারুক খান বলেন, ‘এই শহীদদের বিনিময়ে একটা স্বৈরাচারের পতন হয়েছে। এর পরও এই শহীদরা অবহেলিত। এখনো আমরা সন্তান হত্যার বিচার পাইনি। এক বছর হয়ে গেল, কোনো বিচার পাইনি। জানি না এ বিচার হবে কি না। আমার দাবি হচ্ছে, ড. ইউনূস সরকার যেন বিচারটা করে দিয়ে যায়।’

তিনি বলেন, ‘যারা শহীদ হয়েছে, সবারই একটা চাওয়া—এই সরকারই যেন জুলাই সনদ দিয়ে যায়। আর শহীদদের কবরগুলো যেন সরকারিভাবে গেজেট করে সংরক্ষণ করা হয়।’