
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থানা ও ফাঁড়ি থেকে লুট হয় পুলিশের অস্ত্র ও গোলাবারুদের একটি অংশ। লুট হওয়া ৫ হাজার ৭৫৩টি অস্ত্রের মধ্যে ৪ হাজার ৩৮৩টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি ১ হাজার ৩৬৬টি অস্ত্র। লুট হওয়া অস্ত্রের বড় অংশ সন্ত্রাসী, ডাকাত, ছিনতাইকারী, মাদক কারবারি ও কিশোর গ্যাংয়ের হাতে চলে গেছে।
এসব অস্ত্র কেউ কেউ নিজের কাছে রেখেছে, আবার কেউ বিক্রি করে দিয়েছে। লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে গত সেপ্টেম্বরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী জোরেশোরে নেমেছিল। পরে তার গতি কমে যায়। যদিও যৌথ বাহিনী বিভিন্ন স্থানে আবার অভিযান শুরু করেছে। এসব অস্ত্র ব্যবহার করে খুনাখুনি, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধ করছে দুর্বৃত্তরা।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে অপরাধ বৃদ্ধির বড় কারণ অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার। লুট হওয়া পুলিশের অস্ত্রেও বাড়ছে অপরাধ। বিশেষ করে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার ও মাদক কারবারে অবৈধ অস্ত্র বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। আসন্ন নির্বাচনের আগে এসব অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারলে বড় রকমের হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তাই নির্বাচনকে সামনে রেখে লুটের অস্ত্র উদ্ধারের পাশাপাশি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের বিকল্প নেই। পুলিশ বলছে, লুটের অস্ত্র উদ্ধারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিনই কমবেশি অস্ত্র উদ্ধার হচ্ছে।
লুট হওয়া অস্ত্র দিয়ে গত বছরের অক্টোবর-নভেম্বরে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে গোলাগুলি করে একাধিক হত্যাকা-সহ নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটানো হয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে থেকে উদ্ধার করা হয় ময়মনসিংহের কোতোয়ালির মো. মোতালেবের মেয়ে শাহিদা ইসলামের গুলিবিদ্ধ লাশ। তিনি পুরান ঢাকার ওয়ারীতে মা ও ভাইয়ের সঙ্গে ভাড়া বাসায় থাকতেন। এ ঘটনায় তার প্রেমিক তৌহিদ শেখ তন্ময়কে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে জানা যায়, শাহিদাকে যে অস্ত্র দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, সেটি ছিল পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর জনকণ্ঠকে বলেন, ছিনতাই হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন অল্প অল্প অস্ত্র উদ্ধারও হচ্ছে। যাতে আইনশৃঙ্খলা ও জনশৃঙ্খলা কোনোভাবে বিঘিœত না হয় সেই লক্ষ্যে এবার জোরালোভাবে অস্ত্রগুলো উদ্ধারে কাজ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, পুলিশ চায় না নির্বাচন ঘিরে কোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হোক কিংবা স্থিতিশীলতা নষ্ট হোক। তাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে এসব অস্ত্র উদ্ধারের বিকল্প নেই। আর পুলিশও বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে মাঠে নেমেছে।
পুলিশের তথ্য বলছে, উদ্ধার না হওয়া বিপুলসংখ্যক আগ্নেয়াস্ত্র অপরাধীদের হাতে চলে গেছে বহু আগেই। সর্বশেষ গত ২৮ মে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থানা এলাকা থেকে মো. পারভেজ ও রিয়াজুর রহমান নামের দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ সময় দুজনের কাছ থেকে ধারালো দেশীয় অস্ত্রসহ একটি রিভলভার ও গুলি উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ বলছে, এসব রিভলভার ও গুলি গত বছরের ৫ আগস্ট পাহাড়তলী থানা থেকে লুট করে দুর্বৃত্তরা। ওই দুই ব্যক্তি লুট করা অস্ত্র দিয়ে পাহাড়তলী টোল সড়কে বিমানবন্দর ও পতেঙ্গাগামী যাত্রীদের ছিনতাই করত।
গত বছরের ১৪ আগস্ট থেকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থান থেকে অস্ত্র উদ্ধার করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। এর বেশির ভাগই বিদেশি পিস্তল ও রিভলভার। এ ছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ চট্টগ্রাম নগর থেকে অস্ত্র ও গুলিসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে। পরে পুলিশ জানতে পারে, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা ডাকাত ও ছিনতাইকারী দলের সদস্য। উদ্ধার হওয়া অস্ত্র চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানা থেকে তারা লুট করেছিল। গত ১৭ এপ্রিল ভোরে চট্টগ্রাম নগরের ডবলমুরিং থানার বারিক বিল্ডিং মোড় থেকে আরিফ হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র ও গুলিসহ গ্রেপ্তার করে নগরের পুলিশ। পরে তার আস্তানা থেকে ইতালির তৈরি একটি পিস্তল ও ৫০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। ডবলমুরিং থানার ওসি রফিক আহমেদ বলেন, গ্রেপ্তার আরিফ ডাকাতদলের নেতা।
সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা বলেন জনকণ্ঠকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষা করতে পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। নির্বাচনের সঙ্গে অবৈধ অস্ত্র কিংবা পুলিশের লুটের অস্ত্র উদ্ধারের কোনো সম্পর্ক নেই।
তবে নির্বাচন একটি অতিরিক্ত বিষয়। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এসব অস্ত্র উদ্ধার করতেই হবে। না হলে এই অস্ত্র নির্বাচনের জন্য বড় রকমের থ্রেট (হুমকি)। এতো মাসেও সব অস্ত্র উদ্ধার না হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শুধু নির্দেশনা রক্ষা করার জন্য অভিযান বা অস্ত্র উদ্ধার করলে হবে না। দ্রুততা ও সিরিয়াসলি অস্ত্রগুলো উদ্ধার করতে হবে। জান-মাল রক্ষায়ও এসব অস্ত্র উদ্ধার করা জরুরি। যৌথ অভিযানে এসব অস্ত্র উদ্ধার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। আগের চেয়ে আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে অস্ত্রগুলো যাদের হাতে চলে গেছে তারা এগুলো নিয়ে বসে থাকবে না। তারা ব্যবহার করবেই। আর খুনাখুনিতেই ব্যবহার করবে। কেননা, অস্ত্র হলো শক্তি প্রয়োগের মাপকাঠি। তাই তারা তো এই অস্ত্র নিয়ে বসে থাকবে না।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, ৫ আগস্টের পর দেশের ৬৬৪টির মধ্যে ৪৬০ থানায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট হয়। ১১৪টি ফাঁড়িতেও লুটপাট চালায় দুর্বৃত্তরা। থানা ও ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে পিস্তল, রিভলভার, শটগানসহ ১১ ধরনের পাঁচ হাজার ৭৫৩টি অস্ত্র লুট করে হামলাকারীরা। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত লুট হওয়া ৪ হাজার ৩৮৩টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি ১ হাজার ৩৬৬টি অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া লুট হওয়া ৬ লাখ ৫১ হাজার ৮৩২টির মধ্যে ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৮৭টি গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৪৫টি গোলাবারুদ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. মো. ওমর ফারুক জনকণ্ঠকে বলেন, সরকারি বা যেকোনো অস্ত্র অপরাধীদের হাতে চলে গেলে জননিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে। পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য সার্বিক ব্যর্থতা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতায় ঘাটতি রয়েছে। নির্বাচনের আগে এসব অস্ত্রের পাশাপাশি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা উচিত। কেননা অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এই অস্ত্র হুমকি। কর্তৃত্ব বা ক্ষমতার পালাবদল নিতে গেলে এসব অস্ত্র ব্যবহার হবে। নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এসব অস্ত্রের ব্যবহার হতে পারে। এটি আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ এবং দৃশ্যমান চ্যালেঞ্জ।
তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে এমনেই অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে দাবি করছে, সুষ্ঠু নির্বাচন করতে তারা প্রস্তুত। কিন্তু তা মনে হয় না। কেননা লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা সেরকম সার্বিক পরিস্থিতি নির্দেশ করে না। অন্যদিকে অস্ত্রের সক্ষমতা দেখানোর জন্য অপরাধীরা প্রস্তুত রয়েছে। তার মতে, এই সংখ্যার বাইরেও অপরাধীদের হাতে অস্ত্র রয়েছে। আরও কি পরিমাণে অস্ত্র অপরাধীদের হাতে রয়েছে সরকারের কাছে সেই পরিসংখ্যান ও তথ্য থাকা উচিত। এবং উদ্ধারে আরও জোরালোভাবে কাজ করা উচিত।
নির্বাচনের আগে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও। সেই লক্ষ্যে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে অস্ত্রগুলো উদ্ধার করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ৮০ শতাংশ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে বলে সম্প্রতি জানিয়েছে সেনাসদর।
গত বৃহস্পতিবার ঢাকা সেনানিবাসে এক সংবাদ সম্মেলনে সেনাসদরের মিলিটারি অপারেশনস ডিরেক্টরেটের (স্টাফ কর্নেল) কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম জানান, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ৮০ শতাংশ অস্ত্র উদ্ধার করেছে। বাকি ২০ শতাংশ অস্ত্র আসন্ন নির্বাচনের আগে জব্দ করা হবে। যাতে আগামী নির্বাচনে এসব অস্ত্র দিয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারে অপরাধী চক্রগুলো।