Image description
১৯৪৭, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর থেকে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানসহ সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ধারণ করে নতুন খসড়া * সংবিধান পুনর্লিখনের বিপক্ষে মত নেতাদের

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র দ্রুত চূড়ান্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসাবে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির কাছে পুনরায় ঘোষণাপত্রের খসড়া পাঠিয়ে মতামত চেয়েছে সরকার। গত মঙ্গল ও বুধবার রাতে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এই খসড়া ঘোষণাপত্র পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ করে কিছুটা সংযোজন-বিয়োজনের মধ্য দিয়ে তা চূড়ান্ত করেছে দলটি। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানকে ধারণ করার বিষয়ে একমতের পাশাপাশি একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বরকেও জুলাই ঘোষণাপত্রে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলে আসছিল। ঘোষণাপত্রের নতুন খসড়ায় এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সবমিলিয়ে এ ব্যাপারে বিএনপি ইতিবাচক।

তবে সংবিধান পুনর্লিখনের বিপক্ষে মত দিয়েছে দলটি। জুলাই ঘোষণাপত্রে সংবিধানের মৌলিক বিষয় অক্ষুণ্ন ও মুজিবনগর সরকারের স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার পক্ষে বিএনপি। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় গণতন্ত্র ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা-এই দুই বিষয়কেও ঘোষণাপত্রে গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়ে মত দেওয়া হয়েছে। আগামী দু-একদিনের মধ্যে ঘোষণাপত্র খসড়ার একটি কপি সরকারকে পৌঁছে দেবে বিএনপি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উভয় বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। জানা গেছে, বৈঠকে বিএনপি নেতারা বলেছেন, ছাত্রদের মতো বিএনপিও চায় দ্রুত ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ চূড়ান্ত করে ঘোষণা করা হোক। এজন্য তারা আন্তরিকতার সঙ্গে বিষয়টি মূল্যায়ন করছেন।

জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরতে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ জারির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এ ঘোষণাপত্র নিয়ে তখন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা তৈরি হয়। হঠাৎ ঘোষণাপত্রের বিষয়টি কেন সামনে আনা হলো, এর প্রভাব কী হতে পারে, তা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন ওঠে। অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রেস উইং তখন এ উদ্যোগের সঙ্গে সরকার সম্পৃক্ত নয় বলে উল্লেখ করেছিল। অবশ্য পরে ৩০ ডিসেম্বর রাতে জরুরি প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানিয়েছিলেন, অন্তর্র্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ওই রাতে বৈঠক করে ৩১ ডিসেম্বর শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ (ঐক্যের জন্য যাত্রা) কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। ওই কর্মসূচি থেকে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়। এর মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়।

বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো তখন ওই খসড়ার ওপর তাদের মতামত দেয়। পরে ছাত্রদের দেওয়া সময়সীমা শেষ হওয়ার পরদিন গত ১৬ জানুয়ারি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তবে সেখানেও এ নিয়ে ঐকমত্য হয়নি। এরপর তরুণদের নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির পক্ষ থেকে ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে এই ঘোষণাপত্র ঘোষণার বিষয়ে সরকারকে আলটিমেটামও দেওয়া হয়। সেই আলটিমেটামের সময়ও শেষ হয়। পরে নতুন এই দলের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে বলা হয়, আগামী ৩ আগস্ট দলের পক্ষ থেকে জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়া হবে। এমন প্রেক্ষাপটে জুলাই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে একটি খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। যা অন্যতম স্টেকহোল্ডার বিএনপির কাছে পাঠানো হয়েছে। জানা গেছে, এই খসড়া ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পর্যায়ক্রমে দেওয়া হবে।

জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল, আগের খসড়ায় মহান মুক্তিযুদ্ধকে অনেকটা খাটো করে দেখানো হয়েছে। বিএনপিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল আগে থেকে সংবিধান পুনর্লিখনের বিপক্ষে। সূত্রমতে, গণতন্ত্রে উত্তরণের পাশাপাশি জুলাই ঘোষণাপত্রের নতুন খসড়ায় বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের এই ভূখণ্ডের মানুষের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যুগের পর যুগ সংগ্রামের প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়। পাকিস্তান আন্দোলনের মাধ্যমে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জন, এই ভূখণ্ডের মানুষের ওপর দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তান শাসকদের বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ১৯৭১ সালে লাখ লাখ প্রাণের বিনিময়ে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কথা তুলে ধরা হয়। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আরও উল্লেখ করা হয়েছে, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নব্বই-পরবর্তী সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন হয়। আবার দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ১/১১ বন্দোবস্তের মাধ্যমে সে জায়গাটা আবার ফাঁদে পড়ে। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার একচ্ছত্র ক্ষমতা ও আধিপত্যের পথ সুগম করা হয়।

ধারাবাহিক ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে বিতর্কিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে। বিগত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসন, গুম-খুন, আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ এবং একদলীয় স্বার্থে সংবিধান সংশোধন ও পরিবর্তন বাংলাদেশের সব রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে। বিগত সরকারের আমলে একটি চরম গণবিরোধী, একনায়কতান্ত্রিক, মানবিক অধিকার হরণকারী শক্তি বাংলাদেশকে একটি খুনি রাষ্ট্রের রূপ দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে। উন্নয়নের নামে শেখ হাসিনা পরিবারের নেতৃত্বে অবাধে লুটপাট, ব্যাংক লুট, টাকা পাচার এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে বিগত সরকার বাংলাদেশ ও এর সম্ভাবনাকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। যেহেতু শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দল, ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনসহ সমাজের সর্বস্তরের জনগণ প্রায় সাড়ে পনেরো বছর ধরে নিরন্তর সংগ্রাম করে জেল-জুলুম, হামলা-মামলা, গুম-খুন ও আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়; বাংলাদেশে বিদেশি রাষ্ট্রের অন্যায় প্রভুত্ব, শোষণ ও খবরদারির বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষের ন্যায়সংগত আন্দোলনকে তল্পিবাহক আওয়ামী লীগ সরকার নিষ্ঠুর শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে দমনের বিষয়টিও খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন প্রেক্ষাপট তুলে ২০২৪ সালে কীভাবে ছাত্র-জনতার উত্তাল গণবিক্ষোভ গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয় এবং প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান, সে প্রসঙ্গও রয়েছে জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়ায়। বলা হয়েছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুটপাটের অপরাধগুলোর উপযুক্ত বিচার করা হবে। জানা গেছে, আগের ওই খসড়ার সঙ্গে নতুন করে আরও বেশ কিছু ইস্যু যুক্ত করা হয়েছে।

জানা গেছে, গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর মার্কিন শুল্ক আরোপ, নারী আসন, নির্বাচনের পিআর পদ্ধতিসহ সংস্কারের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ মার্কিন শুল্ক আরোপের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিএনপি। একই সঙ্গে এই শুল্কনীতি পুনর্বিবেচনার জন্য আমেরিকা সরকারের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছে দলটি।

জানা গেছে, বৈঠকে সংস্কার ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপের রিপোর্ট তুলে ধরেন স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। এরপর সংস্কারের বিভিন্ন ইস্যুতে মতামত দেন নেতারা। ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে ইতোমধ্যে সংসদে নারীদের আসন ৫০ থেকে ১০০-তে উন্নীত করার ব্যাপারে রাজনৈতিক ঐকমত্য হয়েছে। তবে তারা কীভাবে নির্বাচিত হবেন, সে ব্যাপারে এখনো ঐকমত্য হয়নি। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, তারা প্রচলিত পদ্ধতিতে সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব নির্বাচিত করার পক্ষে অবস্থান নেবে। পাশাপাশি পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিপক্ষে নেতারা।

বৈঠকে স্থায়ী কমিটির দুজন সদস্য বলেন, ঐকমত্য কমিশনে সংস্কারের অনেক বিষয়ে ইতোমধ্যে ঐকমত্য হয়েছে। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সরকার সেগুলো কেন বাস্তবায়ন করছে না। সরকারের উচিত অবিলম্বে এটা বাস্তবায়ন করা।