Image description
ট্রাম্পের ৩৫ % পাল্টা শুল্ক » দুই দেশের ‘ ওয়ান টু ওয়ান ' বৈঠক শুরু । » মার্কিন শুল্ক কমার প্রত্যাশা । » আলোচনায় রয়েছে শঙ্কার ছায়াও ।

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশাধিকার নিয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কঠোর অবস্থানে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত এক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি । অর্থ - বাণিজ্য খাত , রাজনীতিসহ অনেক মহলেরই চোখ এখন নিবদ্ধ ওয়াশিংটনের দিকে । এমন প্রেক্ষাপটে গতকাল বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানীতে সে দেশের বাণিজ্য প্রতিনিধি দপ্তরে ( ইউএসটিআর ) মুখোমুখি আলোচনা শুরু করেছেন দুই দেশের কর্মকর্তারা । এ আলোচনা চলতে পারে কয়েক দিন ধরে । ডোনাল্ড ট্রাম্প ৮ জুলাই প্রধান উপদেষ্টা ড . মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন , বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা সব পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাঁর প্রশাসন ।

চিঠিতে ট্রাম্প আরও ইঙ্গিত দিয়েছেন , এ নিয়ে আলোচনার সুযোগ থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রকে কঠোর অবস্থান থেকে সরতে হলে বাংলাদেশকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য উন্নয়নে নমনীয় হওয়ার বার্তা দিতে হবে । শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর অবস্থানে অস্বস্তিতে পড়েছে বাংলাদেশ সরকার । দেশের ব্যবসায়ী মহলে দেখা দিয়েছে তীব্র উদ্বেগ । তৈরি পোশাকসহ প্রধান রপ্তানি খাতগুলোতে বৈদেশিক ক্রয়াদেশ হারানো , প্রতিযোগী সক্ষমতা এবং উৎপাদন হ্রাসের আশঙ্কা ছড়িয়েছে ।

স্থানীয় অর্থনীতিবিদদের অনেকেই অতিরিক্ত ৩৫ % শুল্ক আরোপের ঘোষণাকে অন্যায্য দাবি করে বলেছেন , এটা আসলে একধরনের চাপে রাখার কৌশল । এর মাধ্যমে একতরফা মার্কিন সুবিধা নেওয়ার পথ প্রশস্ত করে রাখা হয়েছে ।

গতকাল স্থানীয় সময় বেলা ১১ টায় বহুল প্রতীক্ষিত ‘ সিঙ্গেল কান্ট্রি ওয়ান টু ওয়ান ' বৈঠকে মুখোমুখি বসেছে যুক্তরাষ্ট্র । ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল । এতে বাংলাদেশের পক্ষে অংশ নিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন , যিনি আগে থেকেই ওয়াশিংটনে অবস্থান করছেন । যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতসহ দূতাবাসের জ্যেষ্ঠ কুটনীতিকেরাও আলোচনায় যুক্ত ছিলেন । গতকাল গিয়ে সেই দলে যোগ দেন বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান । দেশ থেকে ভার্চুয়ালি এ বৈঠকে অংশ নেন গত কিছুদিন ওয়াশিংটনে কাটানো জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানও ।

মনে করা হচ্ছে , এই ওয়ান টু ওয়ান বৈঠকের ফলাফল শুধু শুল্কের হার নয় , বরং অদূর ভবিষ্যতের জন্য হলেও বাংলাদেশ- যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণ করতে পারে । বিশেষ করে এমন সময়ে , যখন বৈশ্বিক বাণিজ্য রাজনীতিতে নতুন শক্তির বিন্যাস শুরু হয়ে গেছে । গতকাল রাতে এ খবর লেখা পর্যন্ত ওয়াশিংটনের একাধিক সূত্র আজকের পত্রিকাকে জানিয়েছে , ওয়ান টু ওয়ান বৈঠকটি তিন দিনে গড়াতে পারে ।
গতকাল প্রথম দিনের বৈঠকটি স্থানীয় সময় বেলা ১১ টা থেকে শুরু হয়ে বিকেল ৪ টা পর্যন্ত চলার কথা । দ্বিতীয় দিনের আলোচনাও দীর্ঘ হবে বলে ধারণা । বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাতে চায় , ট্রাম্প প্রশাসনের এই শুল্ক আরোপ উদ্যোগ একতরফা , বৈষম্যমূলক এবং ‘ বাণিজ্য প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা ” -এর গণ্ডি পেরিয়ে অর্থনৈতিক নিপীড়নের পর্যায়ে পড়ে । সরকারের দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন , এই বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কয়েকটি বিষয় জোর দিয়ে তুলে ধরা হবে ।
সেখানে বলা হবে , বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য ঘাটতি মাত্র ৫ বিলিয়ন ডলার । অথচ ভিয়েতনামের সঙ্গে ঘাটতি ১২৫ বিলিয়ন ডলার হওয়ার পরও তাদের ওপর শুল্ক কমে হয়েছে ২৬ শতাংশ পর্যন্ত । সেখানে বাংলাদেশের ৩৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক অগ্রহণযোগ্য । এ ছাড়া বাংলাদেশ এখনো এলডিসি ( স্বল্পোন্নত দেশ ) । এই অবস্থায় এ দেশের বাড়তি ছাড় পাওয়া উচিত ।
এই বাস্তবতায় সরকারের করণীয় কৌশল উল্লেখ করে বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান জানান , যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে সরকার আগে থেকেই রোডম্যাপ তৈরি করে রেখেছে । সেই অনুযায়ী ইতিমধ্যে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে এলএনজি , গম , তুলা , উড়োজাহাজ ও সামরিক সরঞ্জাম আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে । এটি যুক্তরাষ্ট্রের দাবি অনেকটাই মেটাবে । তা ছাড়া বাংলাদেশ নিজের স্বার্থেই দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে বিদ্যমান শুল্ক - অশুল্ক বাধা কমিয়ে আনতে সমন্বিত পদক্ষেপ নিচ্ছে , যা অচিরেই দৃশ্যমান হবে । এর বাইরে দেশীয় উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে । উৎপাদন খরচ কমিয়ে রপ্তানিতে লিডটাইম কমিয়ে আনা হবে । এ জন্য সামগ্রিক আমদানি - রপ্তানি প্রক্রিয়াটি সিঙ্গেল উইন্ডোতে সারার কাজ ইতিমধ্যে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে । অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে উদ্যোক্তারা যেন টিকে থাকতে পারেন , সে লক্ষ্যেই এসব করা হচ্ছে ।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন উদ্বেগভরা দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সরাসরি আলোচনা শুরু হলেও বলা হচ্ছে , বিষয়টি সহজ হবে না । এর ফলাফল নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে । এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড . জাহিদ হোসেন বলেন , ‘ ইউএসটিআরের সঙ্গে ওয়ান টু ওয়ান বৈঠকে বাংলাদেশকে অবশ্যই তার অবস্থান স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে হবে । দর - কষাকষির সক্ষমতা দেখাতে হবে । পাশাপাশি কিছু ছাড়ও দিতে হবে । তবেই আলোচনা ফলপ্রসূ হবে । ”

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের ( সানেম ) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান মনে করেন , আলোচনা ফলপ্রসূ করতে হলে দরকার দ্রুত , তথ্যনির্ভর ও কৌশলগত জবাব । তিনি বলেন , এ ক্ষেত্রে প্রস্তুতির ঘাটতি থাকলে ফল আবারও শূন্য হবে । বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার - উল আলম চৌধুরীর কণ্ঠেও ছিল উদ্বেগের ছোঁয়া ।

তিনি বললেন , যুক্তরাষ্ট্রের মতো বাজারে শুধু সরকারি প্রতিনিধি পাঠিয়ে দর- কষাকষিতে সফল হওয়া কঠিন , প্রয়োজন ছিল আগেই লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করা । বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু গতকাল বলেন , ' ইতিমধ্যেই পোশাকশিল্প সংকটে । কাঁচামালের দাম , মজুরি বৃদ্ধি ও বিদ্যুৎ- গ্যাস সংকটের মধ্যে পড়ে আমরা কোনোমতে টিকে আছি । যদি আরও ৩৫ শতাংশ শুল্ক যুক্ত হয় , তবে মার্কিন ক্রেতারা অপেক্ষাকৃত কম শুল্কের প্রতিযোগী দেশগুলোতে চলে যাবে । ' যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে বাংলাদেশি পণ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য ।

ট্রেডিং ইকোনমিকস ও ইউএসটিআরের তথ্য অনুযায়ী , ২০২৪ সালে দেশটি বাংলাদেশ থেকে আমদানি করেছে ৮ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য , যার মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি ছিল তৈরি পোশাক । অন্যদিকে বাংলাদেশ আমদানি করেছে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য । অর্থাৎ বাণিজ্য ভারসাম্য ভালোভাবেই বাংলাদেশের পক্ষে । কিন্তু অতিরিক্ত ৩৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হলে শুধু তৈরি পোশাকেই বছরে অন্তত তিন থেকে সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলারের বাড়তি খরচ গুনতে হতে পারে । অনেক কারখানার জন্য এটি মারাত্মক ধাক্কা হয়ে দাঁড়াবে ।