Image description
রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতীয় সম্মেলনে নেত্রকোনা জেলার শ্রেষ্ঠ ইমামের সম্মাননা হাতে জসিম উদ্দিন।

নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলা ওলামা দলের সাবেক সভাপতি জসিম উদ্দিনকে জেলার শ্রেষ্ঠ ইমামের সম্মাননা দিয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। তবে তিনি কোনো মসজিদের ইমাম নন। তাঁকে যে মসজিদের ইমাম হিসেবে দেখানো হয়েছে, সেখানে এক যুগ ধরে ইমামতি করছেন আরেকজন। এ নিয়ে জেলাজুড়ে ইমামদের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

জানা গেছে, জসিম উদ্দিন বারহাট্টা উপজেলার বিক্রমশ্রী গ্রামের বাসিন্দা। তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন পরিচালিত মসজিদভিত্তিক সহজ কোরআন শিক্ষা বিভাগের উপজেলা শাখার মডেল কেয়ারটেকার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। এ ছাড়া তিনি উপজেলা হেফাজতে ইসলামের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা মোটরশ্রমিক ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে রয়েছেন।

গত ২৯ জুন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আয়োজনে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইমামদের জাতীয় সম্মেলন হয়। সেখানে জসিম উদ্দিনকে নেত্রকোনা জেলার শ্রেষ্ঠ ইমামের সম্মাননা, সনদ ও সম্মাননার চেক দেওয়া হয়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। এ ছাড়া ধর্মসচিব এ কে এম আফতাব হোসেন প্রামাণিক ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক (সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ) আ. ছালাম খান উপস্থিত ছিলেন।

জসিম উদ্দিন সম্মাননা পাওয়ার সেই ছবি সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করলে বিষয়টি জানাজানি হয়। এতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানান অনেকে।

নেত্রকোনা ইসলামিক ফাউন্ডেশন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বরে শ্রেষ্ঠ ইমাম নির্বাচনের জন্য জেলার ১০টি উপজেলা থেকে ২০ জন করে মোট ২০০ জন ইমামের তালিকা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের জেলা কার্যালয়ে পাঠানো হয়। এতে জসিম উদ্দিন নিজেকে বারহাট্টা উপজেলার বিক্রমশ্রী জামে মসজিদের ইমাম হিসেবে উল্লেখ করেন।

চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি কার্যালয়ের সাবেক উপপরিচালক শফিকুর রহমান সরকার তালিকা যাচাই-বাছাই করে জসিম উদ্দিনসহ তিনজনকে জেলার শ্রেষ্ঠ ইমাম নির্বাচন করে তালিকা বিভাগীয় কার্যালয়ে পাঠান। সেখান থেকে তালিকা যায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ঢাকার কার্যালয়ে। গত ২৯ জুন রাজধানীতে ধর্ম উপদেষ্টার উপস্থিতিতে সম্মেলনের মাধ্যমে জসিম উদ্দিনসহ তিনজনকে জেলার শ্রেষ্ঠ ইমামের সম্মাননা দেওয়া হয়।

জানা গেছে, জেলায় সহস্রাধিক ইমাম রয়েছেন। তাঁদের অধিকাংশই ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, জসিম উদ্দিন যে মসজিদের ইমাম হিসেবে সম্মাননা পেয়েছেন, সেই বিক্রমশ্রী জামে মসজিদে ২০১৪ সাল থেকে ইমামতি করেন রফিকুল ইসলাম।

ক্ষোভ প্রকাশ করে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘দুই যুগের বেশি সময় ধরে ইমামতি করেও তালিকায় আমাদের নাম নেই। জসিম উদ্দিন কোথাও ইমামতি করেন না। অথচ যাচাই-বাছাই ছাড়াই তাঁকে জেলার শ্রেষ্ঠ ইমাম নির্বাচিত করা হয়েছে। এটা দুঃখজনক। পেশাদার ইমামদের এই সম্মাননা দেওয়া হলে ইমামদের মধ্যে উৎসাহ বেড়ে যেত। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মতো একটি প্রতিষ্ঠান যদি এমন করে, তাহলে মানুষের ভরসার আর জায়গা কোথায়?’

জসিম উদ্দিনের প্রতিবেশী বিক্রমশ্রী গ্রামের বাসিন্দা জামান মিয়া বলেন, ‘জসিম উদ্দিনকে আমরা কোনো দিন ইমামতি করতে দেখিনি। তিনি রাজনীতি করেন জানি।’

আছাব উদ্দিন নামের আরেক প্রতিবেশী বলেন, ‘জসিম ইসলামিক ফাউন্ডেশনে চাকরি করেন। পাশাপাশি রাজনীতি করেন। কিন্তু ইমামতি করেন না। আমাদের কথা বিশ্বাস না হলে এলাকার সবাইকে জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন।’

রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ইমামদের জাতীয় সম্মেলনে জসিম উদ্দিন। ছবি: তাঁর ফেসবুক ওয়াল থেকে সংগৃহীত
রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ইমামদের জাতীয় সম্মেলনে জসিম উদ্দিন। ছবি: তাঁর ফেসবুক ওয়াল থেকে সংগৃহীত

বারহাট্টা হাফিজিয়া দারুল উলুল মহিউসুন্নাহ মাদ্রাসার মোহতামিম ও বারহাট্টা বড় মসজিদের সাবেক ইমাম আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘জসিম উদ্দিন নামের যাঁকে জেলার শ্রেষ্ঠ ইমামের সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, তিনি গত ১৫ বছরেও কোনো মসজিদে ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেননি। তিনি ইমামতি করলে আমরা তো অন্তত জানব।’

আনোয়ার হোসেন আরও বলেন, ‘এমন সম্মাননা দেওয়ায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হবে। আমি ইমাম প্রশিক্ষণ নিয়েছি, বারহাট্টা বড় মসজিদে দীর্ঘ সময় ইমামতি করেছি। এখন মাদ্রাসায় ইমামতি করছি। অথচ এই তালিকায় যুগ যুগ ধরে ইমামতি করেন এমন কাউকে রাখা হয়নি। এটি বড় ধরনের একটি কারচুপি। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে এমনটা আশা করি না। সত্যিকারের ইমামেরা এ সম্মাননা পেলে অন্যরা অনুপ্রেরণা পাবেন।’

বারহাট্টা উপজেলা ওলামা দলের সভাপতি মাহবুব আলম বলেন, ‘জসিম উদ্দিন উপজেলা ওলামা দলের সভাপতি থাকা অবস্থায় শেখ মুজিবের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়েছেন। এখন আবার হেফাজতের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, খেলাফত আন্দোলনসহ অনেক দলের নেতা তিনি। জসিম উদ্দিন কোনো দিনও ইমামতির দায়িত্ব পালন করেননি। তবুও ইসলামিক ফাউন্ডেশন তাঁকে কীভাবে জেলার শ্রেষ্ঠ ইমাম নির্বাচন করল, বুঝতে পারছি না।’

জানতে চাইলে জসিম উদ্দিন বলেন, ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে কমপক্ষে ১৫টি প্রশিক্ষণ নিয়েছি। ইমামতি করিনি, এটা সঠিক নয়। অনেক আগে জেলা সদর ও ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের ভেতরের মসজিদে ইমামতি করেছি। জেলা ওলামা দলের প্রতিষ্ঠাতা সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলাম। একসময় জেলা ছাত্রদলের পদে ছিলাম। আওয়ামী লীগের আমলে ১৭টি মামলার আসামি হয়েছি। গ্রেপ্তার হয়েছি, জেল খেটেছি। একাধিক মানবাধিকার সংগঠনে আছি। পাশাপাশি শ্রমিক সংগঠনের পদে আছি।’

ইসলামিক ফাউন্ডেশন নেত্রকোনা জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি এখানে যোগদান করেছি গত ফেব্রুয়ারিতে। ইমাম নির্বাচনের কাজটি করেছেন আগের উপপরিচালক শফিকুর রহমান সরকার। দুর্নীতির অভিযোগে তিনি বরখাস্ত হয়েছেন।’

সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিটি উপজেলায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা প্রথমে বাছাই করে ২০ জনের তালিকা জেলায় পাঠায়। পরে জেলা কার্যালয় থেকে একজনের নাম চূড়ান্ত করে ঢাকার কার্যালয়ে পাঠানো হয়।’