
শিশুটির মায়ের আদরমাখা স্পর্শ তাকে আর ছুঁয়ে যায় না। ছোট কোমল হাতে মাকে স্পর্শ করতে পারে না। টলোমলো চোখে খুঁজে ফিরে মায়ের মুখটি। আধো আধো বুলিতে মা মা করে ডাকতে শিখেছে। কিন্তু কোথাও মিলে না ছোট্ট সুহাইবা’র সেই মা ডাকের সাড়া। জন্মের পঁচাত্তর দিন পর হারাতে হয় মাকে। ২০২৪-এর ২০শে জুলাই শনিবার সন্ধ্যায় গুলিতে মারা যান বিশ বছর বয়সী সুমাইয়া আক্তার। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ নতুন মহল্লায় ভাড়া বাসায় তার একমাত্র শিশু সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর পর ঘুম পাড়িয়ে বেলকনিতে দাঁড়িয়েছিলেন। এ সময় ভবনটির ৬তলার বারান্দার গ্রিল ছিদ্র হয়ে তার মাথায় এসে একটি বুলেট বিদ্ধ হয়। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঢলে পড়েন মেঝেতে।
শহীদ সুমাইয়ার মা আসমা বেগম মানবজমিনকে বলেন, সন্তান ছাড়া একজন মা কেমন থাকতে পারে? এই কষ্ট কাউকে বুঝানো যায় না। একটা মাছুম শিশু বাচ্চা রেখে গেছে। যখন মারা যায় তখন আড়াই মাস বয়স ছিল এখন এক বছরের বেশি বয়স। মাঝে মাঝে ভাঙা ভাঙা গলায় মা মা বলে ডাকে। আমরা এই হত্যার ন্যায়বিচার চাই। এই রকম যেন কোনো মায়ের ও সন্তানের বুক আর খালি না হয়। কোনো সন্তান যেন এতিম না হয়। শহীদদের জীবন যেন বৃথা না যায়। এই গণহত্যার এখন বিচার হলে পরবর্তীতে যারা ক্ষমতায় আসবে তারা এই ধরনের কাজ করতে সাহস পাবে না। তারা একবারের জন্য হলেও জনগণের কথা ভাববে। মানুষের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করবে। তিনি বলেন, সবাই খোঁজখবর রাখছে, আর্থিক কিছু সহযোগিতা ছাড়া তেমন কিছু দেখছি না। আমরা চাই সরকারের পক্ষ থেকে এই অবুঝ শিশুর দায়িত্বটা যেন নেয়া হয়। ওর মা-তো কোনো অপরাধ করেনি, এই শিশুটিকে রেখে তার জীবন দিতে হয়েছে। মাত্র ২০ বছর বয়সে আমার মেয়েটা জীবন দিলো। আমি মা হয়ে আমার সন্তানের রক্তে ভিজে যাওয়া শরীর দেখেছি।
তিনি আরও বলেন, এই শিশুটির তো ভবিষ্যৎ আছে। ওর বাবাও খোঁজখবর রাখে না। আমি কখনো আমার মেয়েকে ভুলতে পারবো না। পুতুলের মতো শিশুটাকে রেখে সে চলে গেল। এই কষ্ট আমি একবছর ধরে আঁকড়ে ধরে আছি। নাতনিটা যখন আধো আধো বুলিতে মা মা করে তখন আমার মনে হয় বুকের ভেতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। যখন বুঝতে শিখবে তখন তাকে আমি কী বলে এই মা শব্দটার মানে বুঝাবো। কী বলে তাকে সান্ত্বনা দেবো। এটা ভেবে ভেবে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ছি।
আসমা বেগম বলেন, সে তো অবুঝ, মায়ের অভাব বুঝতে পারলেও মুখ ফুটে বলতে পারছে না কাউকে। ওইদিন নতুন মহল্লার আশপাশের সবাই গুলি ও হেলিকপ্টারের শব্দ শুনতে পায়। অনেকে তখন বারান্দা, ছাদ এবং জানালায় ছুটে যায় দেখার জন্য। আমার মেয়েও তার বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে বাসার উত্তরদিকের বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। এসময় গ্রিল ভেদ করে বুলেটটি এসে সুমাইয়ার মাথায় লাগে। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, আমি হারিয়েছি আমার বুকের সন্তানকে। আমার নাতনি হারিয়েছে তার মাকে। মায়ের কষ্টটা ওর কি কখনো পূরণ হবে। আমার মেয়েটা খুব শান্ত ছিল নিজের কষ্ট সবসময় লুকিয়ে রাখতো। সুমাইয়ার বাচ্চা হওয়ার পর এত খুশি ছিল যেটা বলার বাইরে। সব সময় মেয়েকে নিয়ে হাসিখুশিতে কেটে যেতো। মেয়েটিও ওর মাকে মাত্র চিনতে শিখেছিল। মেয়ের জন্য বেশি লাল জামা পছন্দ করতো সুমাইয়া। আমাকে এমন কিছু বলে যেতেও পারেনি আমার মেয়েটা। আমার মেয়েটা বলে যেতে পারেনি যে, মা আমি চলে যাচ্ছি- আমার মেয়েটিকে দেখে রেখো। গুলি লাগার পরেই নিচের দিকে ঢলে পড়ে যায়।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ২০শে জুলাই সন্ধ্যায় ঘটনাটি ঘটে। ওইদিন পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ ছিল। চারদিকে গোলাগুলি হচ্ছে। একটার পর একটা হেলিকপ্টার ঘুরছিল। এটা দেখার জন্য সবাই উৎসুক ছিল।