Image description
বেপরোয়া ভাঙচুর, দখল, লুট, চাঁদাবাজিতে বিএনপিতেই ক্ষোভের আগুন

খুব একটা দেখা যায়নি আওয়ামীবিরোধী আন্দোলনে। ঝামেলামুক্ত থাকতে তখন বলেছেন বিএনপি না করার কথা। আন্দোলন করতে গিয়ে বিপদে পড়া নেতাকর্মীরাও পায়নি পাশে। এলাকায় কেন্দ্রীয় নেতাদের কর্মসূচি পর্যন্ত এড়িয়ে চলেছেন। ফ্যাসিস্ট আমলে গা বাঁচিয়ে চলা এমন নেতারাই এখন সাগরপারের কুয়াকাটার সবচেয়ে বড় বিএনপি নেতা। পরিণত হয়েছেন মূর্তিমান আতঙ্কে। বেপরোয়া দখল, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে ফ্যাসিস্টদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে। এক্ষেত্রে দলের নেতাকর্মীরাও রেহাই পাচ্ছেন না। সবমিলিয়ে পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটায় এখন আজিজ-মতিউর আতঙ্ক। একজন পৌর বিএনপির সভাপতি, অন্যজন সাধারণ সম্পাদক। তাদের বিরুদ্ধে সরব স্থানীয় বিএনপি নেতারাও। তারা বলছেন, দুই নেতার কারণে ক্ষতি হচ্ছে দলের। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত পৌর বিএনপির সভাপতি আজিজ মুসুল্লী বলেন, আইন আদালতের ভরসায় থাকলে কাঙ্ক্ষিত ফল মেলে না বলে নিজেই সমাধান করি। তবে সবকিছুই প্রতিপক্ষের অপপ্রচার বলে দাবি করেছেন সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান। 

একাধিক ভিডিওতে মেলে অপকর্মের প্রমাণ : ৫ আগস্টের আগে তেমন একটা সক্রিয় ছিলেন না কুয়াকাটা পৌর বিএনপির এই দুই নেতা। একবার দলীয় কর্মসূচিতে কুয়াকাটায় যান বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। সেখানে কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক এবিএম মোশাররফ হোসেনও ছিলেন। কিন্তু ছিলেন না পৌর সভাপতি আজিজ মুসুল্লী। যোগাযোগ করা হলে নিজেকে অসুস্থ উল্লেখ করে আর দল করবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন তখন। এর আগে পরের কোনো কর্মসূচিতেও দেখা যায়নি তাকে। প্রায় একই অবস্থা ছিল সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমানের। অথচ আজ তারাই সাগর পাড়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী বিএনপি নেতা। তারা এখানে চালাচ্ছেন বেপরোয়া দখল ভাঙচুর লুটপাট ও চাঁদাবাজি। টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে হেন অপকর্ম নেই যা করেন না এই দুজন। তাদের দখল আর চাঁদাবাজির একাধিক ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বিআরটিসি বাসের কাউন্টার দখল নিয়ে একটি ভিডিও ভাইরাল হলে মতিউরকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছিল জেলা বিএনপি। তবে পরে আর নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। ফ্যাসিস্টের দোসর সাবেক এক এমপির হয়ে নিজ দলের নেতাকর্মীদের জমি দখল নিয়ে আজিজ মুসুল্লীরও একটি ভিডিও ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ভিডিওতে দেখা যায়, বিএনপির ওই কর্মীর জমি দখল করেছিল সাবেক এক এমপি। ৫ আগস্টের পর আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সেই জমির দখল নিতে গেলে বাধা দেন আজিজ। তাকে দেখে নেওয়ারও হুমকি দেন তিনি। ভাইরাল হওয়া এই ভিডিওর ব্যাপারে অবশ্য তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি দল।

মতিউর বাহিনীর ভাংচুর-লুট : পৌর কমিটির বর্তমান সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক কেউই পৌর এলাকার বাসিন্দা নন। মতিউরের বাড়ি কুয়াকাটা থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে আলিপুরে। স্ত্রী সন্তান নিয়ে থাকেন আরও অন্তত ২০ কিলোমিটার দূরে কলাপাড়া উপজেলা শহরে। আজিজ মুসুল্লীর বসতি লতাচাপলি ইউনিয়নের মুসুল্লীয়াবাদ গ্রামে। নেতৃত্ব ধরে রাখতে কিছুদিন আগে পৌর এলাকার ভোটার হলেও সেখানে থাকেন না দুজনের কেউ। 

লতাচাপলি ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য কুতুব উদ্দিন বলেন, গত ১০/১১ মাসে পুরো এলাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন মতিউর। এই সময়ে কম করে দুই শতাধিক বাড়িঘর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ভাঙচুর লুটপাট চালিয়েছে তার বাহিনী। সেই সঙ্গে চলেছে বেপরোয়া দখল। লতাচাপলি ইউনিয়নে আমার দুটি ঘরসহ মাসুদ মৃধা, মোশাররফ, নাসির গাজী, রঞ্জু বিশ্বাস, সোহেল ফকির, মোশাররফ মোল্লা, সবুজ, আবুল কমিশনার, তৈয়ব ডাক্তার, আলম মিয়া, নাসির বিপ্লব ও আবুল হোসেনের বাড়ি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুরের পর সব মালামাল নিয়ে গেছে মতিউরের ক্যাডাররা। লতাচাপলি, আলিপুর, মাটিভাঙ্গা, মিশ্রি পাড়া, খাজুরা, গো রাখাল, খঞ্জু পাড়া ও আজিমপুরে ঘটেছে এসব ঘটনা। আলিপুর-মহিপুরের শতাধিক দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট চালিয়েছে তারা। দখল করে নিয়েছে অনেকের আয়-রোজগারের শেষ সম্বল। ইসলামিয়া মোবাইল সেন্টারের মালিক বলেন, টিভি, ফ্রিজ, মোবাইল ফোনসেটসহ আমার কয়েক কোটি টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে গেছে। লুটপাটের শিকার তাজ ইলেট্রনিকসের মালিক বলেন, প্রবাসে থেকে টাকা আয় করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি গড়েছিলাম। আগাগোড়া বিএনপি করেছি। বিদেশে থাকতে জিয়া গবেষণা পরিষদের পদেও ছিলাম। ২০২২ সালে দেশে এসে শুরু করি ব্যবসা। হামলা, ভাঙচুর, লুটের মুখে তাও শেষ।

জানা যায়, এই বাহিনীতে মতিউরের সঙ্গে আছেন তার দুই ভাই মহিপুর থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব আতিকুর রহমান মিলন ও লতাচাপলি ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি মিজানুর রহমান। এদের অন্যতম ক্যাডার আব্দুল খালেক খলিফা। 

বসতবাড়ি গুঁড়িয়ে ফসল চাষ : আলিপুরের আ. সাত্তার ফরাজির দুটি ঘরের একটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে দখল করা হয়েছে অপরটি। বেপরোয়া এই দখলের হাত থেকে রেহাই পায়নি বিএনপি নেতারাও। লতাচাপলি ইউনিয়ন বিএনপির ৯নং ওয়ার্ডের সভাপতি লতিফ মুসুল্লীর বাড়িঘর ভেঙে এস্কেভেটর দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে মতি ও তার লোকজন। এই ঘটনায় মতিউরসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হলেও কাউকে গ্রেফতার করেনি পুলিশ। ওই এলাকার কাদের মোল্লার বাড়িঘরও ভাঙচুর করা হয়েছে। এ ছাড়া নুরুজ্জামান ও কালাম ফরাজীসহ মোট ৭টি ঘর সম্পূর্ণ ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে সেখানে এখন চলছে ট্রাক্টর দিয়ে ফসলের চাষ। এসবই করেছে মতি ও তার বাহিনী। দখল সন্ত্রাসে পিছিয়ে নেই আজিজ মুসুল্লীও। মাসদুয়েক আগে কুয়াকাটায় সাবেক এক সেনা কর্মকর্তার ৪০ শতাংশ জমি রাতারাতি দেওয়াল দিয়ে দখল করিয়ে দেন আজিজ। স্থানীয়দের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, ফ্যাসিস্ট আমলের মন্ত্রী-এমপিদের জমিসহ পর্যটন কেন্দ্রের নানা স্থাপনা দেখেশুনে রাখেন আজিজ। এরকম অন্তত ৭টি ঘটনার প্রমাণ মিলেছে। চলতি বছরের মার্চে কুয়াকাটা পর্যটন কেন্দ্রের শুঁটকি মার্কেটে ১০ ব্যবসায়ীর দোকান দখল করে নেন আজিজ মুসুল্লীর দুই ছেলে রিয়াজ ও সালাহউদ্দিন। মালিকানা দাবি করে দোকানগুলোতে তালা ঝুলিয়ে দেন তারা। পরে অবশ্য উপজেলা বিএনপির হস্তক্ষেপে দোকান ফিরে পান ব্যবসায়ীরা। 

পরিত্রাণ চান বিএনপি নেতারা : আজিজ মুসুল্লী ও মতিউর রহমানের এসব কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ কুয়াকাটার বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। পৌর বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি জসিমউদ্দিন বাবুল ভূঁইয়া বলেন, এ দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনতে শুনতে এখন ক্লান্ত আমরা। দলের বর্ধিত সভায়ও এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। আজিজ-মতিউরের কারণে বিএনপি এখানে চরম ক্ষতিগ্রস্ত।

পৌর বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন ঘরামী বলেন, দখল আর চাঁদাবাজি প্রশ্নে দুই নেতা যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এদের অপকর্ম আর অরাজকতার কারণে এলাকার মানুষ বিএনপিকে অপছন্দ করছে। 

পৌর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সাইদুর রহমান সোহেল বলেন, সভাপতি আর সাধারণ সম্পাদককে নিয়ে চরম বিব্রত আমরা। পর্যটন কেন্দ্রের মতো স্পর্শকাতর জায়গায় তারা যা করছে তাতে সারা দেশে বিএনপির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

পৌর যুবদলের সভাপতি সৈয়দ মো. ফারুক বলেন, আমাদের নেতা তারেক রহমানের ভাষ্য অনুযায়ী আগামী নির্বাচন বিএনপির জন্য একটি অগ্নিপরীক্ষা। কিন্তু পৌর বিএনপির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের যত অপকর্ম তাতে প্রতিদিনই কমছে দলের ভোট। 

পৌর কৃষক দলের সভাপতি আলী হোসেন সরদার বলেন, বিগত ১৭ বছর যে আওয়ামী লীগ আমাদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে, তাদের রক্ষাকর্তা হিসাবে কাজ করছেন আজিজ-মতিউর। আওয়ামী লীগের টাকা খেয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের বাড়িঘর দখল এমনকি তাদের গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করেন না এরা।

পৌর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি আলী হায়দার শেখ বলেন, জমি দখল, চাঁদাবাজি তাদের প্রতিদিনের কাজ। আজিজ-মতিউরের কারণে মানুষ বিএনপির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। পৌর ছাত্রদলের আহ্বায়ক জুবায়ের আহম্মেদ বলেন, ৫ আগস্টের আগে কোনো কর্মসূচিতে পাইনি আজিজ-মতিউরকে। 

যা বললেন অভিযুক্ত দুই নেতা : সব অভিযোগই অস্বীকার করেন আজিজ মুসুল্লী ও মতিউর রহমান। দলের ভেতরে থাকা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ অপপ্রচার ছড়াচ্ছে বলে দাবি তাদের। মতিউর বলেন, ৫ আগস্টের পর আওয়ামী নেতাকর্মীদের বাড়িঘর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর হয়েছে। সেসবই ছিল গণরোষ। আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। গত ১৬ বছর বিএনপির বহু লোকজনের বাড়িঘর, জমি দখল করেছিল আওয়ামী লীগ। ৫ আগস্টের পর তারা তাদের সম্পত্তি বুঝে নিয়েছে। এসবের সঙ্গে আমাকে জড়ানোর সুযোগ নেই। আমার কোনো বাহিনী নেই। এসবই মিথ্যা প্রচার।

আজিজ মুসুল্লী বলেন, অনেক সময় স্থানীয় পর্যায়ের জমিজমাসংক্রান্ত বিরোধের সালিশি করতে হয়। যারা পক্ষে রায় পায় না তারা অভিযোগ করে। আমি কোনো জমি দখল করিনি। ফ্যাসিস্টের পক্ষেও নেই। আওয়ামী কোনো নেতাকর্মীকে প্রশ্রয় দিইনি। স্থানীয় পর্যায়ের বিরোধ মীমাংসায় পুলিশ কিংবা আইন আদালতের কাছে গেলে মাসের পর মাস ঘুরতে হয়। আমরা যেখানে আছি সেখানে আইন আদালতের কাছে যেতে হবে কেন? আমরাই তো সমস্যার সমাধান করে দিতে পারি। যেসব বলা হচ্ছে তা সত্য নয়। পটুয়াখালী জেলা বিএনপির সদস্য সচিব স্নেহাংশু সরকার কুট্টি বলেন, আমাদের কাছে কেউ লিখিত অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক এবং পটুয়াখালী-৪ আসনে দলের মনোনয়ন প্রার্থী এবিএম মোশাররফ হোসেন বলেন, দখল-ভাঙচুর-লুট-চাঁদাবাজি প্রশ্নে জিরো টলারেন্সে রয়েছে দল। জনস্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডে কেউ জড়িত হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।