
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) এলপিজি সিলিন্ডার বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত চার জ্বালানি বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান এসব সিলিন্ডার ডিলারদের মধ্যে সমবণ্টন করছে না। বিশেষ করে স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেড (এসএসিওএল) অপকর্মের সঙ্গে অভিযুক্ত একটি প্রতিষ্ঠানকে ট্রাকে ট্রাকে এলপিজি সিলিন্ডার সরবরাহ করছে। এলপিজি প্ল্যান্টের এক শীর্ষ কর্মকর্তাকে ‘ম্যানেজড’ করে ওই প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ এলপিজি নিয়ে যাচ্ছে। প্রতি ট্রাকে বাড়তি লক্ষাধিক টাকা ঘুসের বিনিময়ে একটি প্রতিষ্ঠান এলপিজি নেওয়ার কারণে সাধারণ ডিলারদের অনেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিপিসির এলপিজির চেয়ে বেসরকারি কোম্পানির এলপিজি সিলিন্ডারের দাম প্রায় দ্বিগুণ। এ কারণে বিপিসির এলপিজি নিয়ে একটি চক্র রমরমা বাণিজ্য শুরু করেছে। অভিযোগ আছে, এ গ্যাস বেসরকারি কোম্পানির বোতলে ভরে বেশিদামে বিক্রি করা হচ্ছে। এতে প্রায় দ্বিগুণ লাভ করছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের অধীন ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) এলপিজি (তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস) উৎপাদন করে। উৎপাদিত এলপিজি সিলিন্ডার চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি তেল বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক কোম্পানি লিমিটেড (এসএওসিএল) অন্যান্য জ্বালানির মতো এই এলপিজি সিলিন্ডারও বিক্রি করে। সংস্থাগুলো তাদের নির্ধারিত ডিলারদের কাছে এসব এলপিজি সরবরাহ করে এবং ডিলাররা মাঠপর্যায়ে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেয়। রন্ধন কাজেই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় এ গ্যাস। তবে প্রতিদিন ২২-২৩ গাড়ি বিপিসির এলপিজি সিলিন্ডার বরাদ্দ দেওয়া হলেও বাজারে বিপিসির সিল মারা এলপিজি সিলিন্ডার খুব একটা চোখে পড়ে না বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
বর্তমানে বাজারে বেসরকারি বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিটি এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৫০০ টাকা দামে। আর বিপিসির এলপিজি সিলিন্ডারের ডিলার পর্যায়ে মূল্য ৭৮৪ টাকা। আর ভোক্তাপর্যায়ে মূল্য ৮২৫ টাকা নির্ধারিত রয়েছে। সে হিসাবে প্রায় দ্বিগুণ লাভ হওয়ায় বিপিসির সিলিন্ডারের চাহিদা বেড়েছে। ডিলাররাও এসব সিলিন্ডারের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। ডিলাররা এতে লাভবান হলেও ভোক্তারা কম দামের সেই সিলিন্ডার খুব একটা পাচ্ছেন না। বিপিসির এলপিজি বেসরকারি কোম্পানির বোতলে ভরে চড়া দামেই বিক্রি করা হচ্ছে।
ইআরএল সূত্র জানায়, বর্তমানে এলপিজি প্ল্যান্টে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে পাঁচ হাজার সিলিন্ডার এলপিজি উৎপাদন হচ্ছে। প্রতি গাড়িতে ২৩৮ বোতল করে ২২ থেকে ২৩ গাড়ি সিলিন্ডার সরবরাহ করা হয়। উৎপাদিত এসব সিলিন্ডার বিপিসির নির্দেশনা অনুযায়ী সরকারি চার প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। চার কোম্পানি তাদের ডিলারদের মাধ্যমে গ্রাহক পর্যায়ে এলপিজি পৌঁছে দেয়। ডিলাররা শিডিউল অনুযায়ী সিলিন্ডার পাওয়ার কথা।
এসএওসিএল-এ ৩৪০ জন ডিলার থাকলেও বর্তমানে সরব আছে ২০০’র মতো ডিলার। কিন্তু এর মধ্যে সুমন এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন ১ থেকে ২ গাড়ি এলপিজি পাচ্ছে। এলপিজি প্ল্যান্টের মহাব্যবস্থাপক ইউসুফ হোসেন ভূঁইয়ার প্রভাবে এ একটি প্রতিষ্ঠানই বিপুল পরিমাণ এলপিজি নিয়ে যাচ্ছে বলে ভুক্তভোগী ডিলাররা অভিযোগ করেছেন। তারা বলছেন, প্রতি গাড়িতে সুমন এন্টারপ্রাইজ লক্ষাধিক টাকা ঘুস দিয়ে এলপিজি হাতিয়ে নিচ্ছে। ওই প্রতিষ্ঠান এসব এলপিজি ভিন্ন কোম্পানির সিলিন্ডারে ভরে দ্বিগুণ দামে বাজারে বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। একই কোম্পানিতে কাজী মোজাম্মেল, শামীম ও দিদার, মেঘনা পেট্রোলিয়ামে শাকিল নামে এক ডিলারও বেশি সিলিন্ডার উত্তোলন করেন বলে অভিযোগ আছে।
সূত্র জানায়, সুমন এন্টারপ্রাইজ নগরীর সাগরিকা এলাকায় তছলিম উদ্দিনের গুদামে বিপিসির সিলিন্ডার থেকে অন্য কোম্পানির সিলিন্ডারে গ্যাস ভরার সময় হাতেনাতে ধরা পড়ে। দুর্নীতি দমন কমিশনে এ বিষয়ে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। এসএওসিএল অভিযোগটি তদন্ত করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পদ্মা মেঘনা-যমুনার একাধিক ডিলার অভিযোগ করেন, এলপিজির সমবণ্টন হচ্ছে না। কেউ মাসে দুবার-তিনবার উত্তোলন করলেও কেউ কেউ একবারও সিলিন্ডার উত্তোলন করতে পারেন না। কেউ কেউ কালেভদ্রে পান। এক্ষেত্রে সরকারি সব সংস্থাতেই কমবেশি স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি হচ্ছে।
এলপিজি বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এলপিজি প্ল্যান্টের মহাব্যবস্থাপক ইউসুফ হোসেন ভূঁইয়া যুগান্তরকে বলেন, ‘বিপিসির নির্দেশনা অনুযায়ী উৎপাদিত এলপিজি রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলোকে বরাদ্দ দেওয়া হয়। বিপণন প্রতিষ্ঠান তাদের নিবন্ধিত ডিলারকে রোস্টার অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়ার কথা। এখন প্রতিষ্ঠানগুলো ডিলারদের মাঝে এলপিজি সিলিন্ডার সমবণ্টন করছে কিনা সেটা সংশ্লিষ্টরা ভালো জানবে। এ ক্ষেত্রে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা জরুরি। তবে তার প্রভাবে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত এলপিজি সিলিন্ডার পাচ্ছে এবং এক্ষেত্রে বড় অঙ্কের ঘুস লেনদেন হচ্ছে-এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ডিলারদের বিরুদ্ধে ডিলারদের এমন কিছু অভিযোগ সব সময় থাকে। তার সত্যতা কতটুকু তা তদন্তসাপেক্ষ। তিনি নিজে এ ধরনের কোনো অনিয়ম-দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেন না বলে জানান।