Image description
দুই মামলায় পিবিআই’র তদন্ত। আগ্নেয়াস্ত্র ঠেকিয়ে কেড়ে নেয় মোবাইল ফোন, স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা । অভিযুক্ত আওয়ামী লীগের ১৬ নেতাকর্মী ।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় সড়কে সশস্ত্র অবস্থান নেওয়া আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কেউ কেউ লুটেও অংশ নিয়েছিল। আন্দোলনকারী, বিরোধী রাজনৈতিক দলের লোক অথবা পূর্ববিরোধ রয়েছে এমন লোকদের সামনে পেলেই মারধর ও আগ্নেয়াস্ত্র ঠেকিয়ে মোবাইল ফোন, স্বর্ণালংকার ও টাকা ছিনিয়ে নেয়। লুটের শিকার হওয়াদের একজন জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) লালবাগ থানার সভাপতি মো. রাজেশ গণি। রাজধানীর ধানমন্ডিতে আগ্নেয়াস্ত্র ঠেকিয়ে ও আঘাত করে তার সবকিছু ছিনিয়ে নেয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এছাড়া বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত যেসব ব্যবসায়ী বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগ ক্যাডারদের চাঁদা দেয়নি আন্দোলন চলাকালে তাদেরও টার্গেট করে মারধর করা হয়েছে। এমন তথ্য উঠে এসেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে।

ওই আন্দোলন ঘিরে রাজধানীর ধানমন্ডি ও রামপুরা থানায় হওয়া দুটি হত্যাচেষ্টার মামলার তদন্ত শেষে গেল মে’তে আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) জমা দিয়েছে পিবিআই ঢাকা মেট্রো দক্ষিণ। চার্জশিটে আওয়ামী লীগের ১৬ নেতাকর্মীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যদিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাইরে পুলিশের কোনো সংস্থা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মামলার চার্জশিট দেওয়া শুরু করল।

জানতে চাইলে পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মো. মোস্তফা কামাল যুগান্তরকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ঘিরে দুটি মারামারির মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। বাকি মামলাগুলোও আস্তে আস্তে চার্জশিট দেওয়া হবে।

সূত্র বলছে, আন্দোলন চলাকালে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ও নির্যাতনের ঘটনায় সারা দেশে হত্যা, হত্যাচেষ্টা ও ভাঙচুরের ঘটনায় হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। এসব মামলার মধ্যে পিবিআই তদন্ত করছে ১৯৫ মামলা। জানা গেছে, জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) লালবাগ থানার সভাপতি মো. রাজেশ গণি ধানমন্ডি থানায় গত বছরের ১৮ আগস্ট হত্যাচেষ্টা ও স্বর্ণালংকার-টাকা পয়সা ছিনিয়ে নেওয়ার মামলা করেন। মামলাটি থানা পুলিশ তদন্তকালে গত বছরের ১০ নভেম্বর পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়।

মামলাটি তদন্ত করেন পিবিআই ইনস্পেকটর (পরিদর্শক) তাপস চন্দ্র পণ্ডিত। চারজনকে অভিযুক্ত করে তিনি আদালতে চার্জশিট দেন। তারা হলেন-যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণ মহানগর কমিটির সাবেক সদস্য এ কে আজাদ, লালবাগ থানার ২৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা মোনোয়ার হোসেন বাবলু, একই ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সদস্য দেলোয়ার হোসেন ওরফে হিজরা দেলোয়ার, যুবলীগ হাজারীবাগ থানা সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাইজুল ইসলাম রবিন। তাপস চন্দ্র পণ্ডিত যুগান্তরকে বলেন, চার্জশিট দেওয়াকালে রবিন গ্রেফতার ছিল।

মামলা সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ৪ আগস্ট বিকালে রাজেশ গণি রিকশায় ধানমন্ডির নিজ বাসা থেকে ইবনেসিনা হাসপাতালের উদ্দেশে রওয়ানা হন। ধানমন্ডি জিগাতলা সাতমসজিদ রোডে জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের প্রধান গেটের সামনে পৌঁছামাত্র যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাকে ধরে মারধর করে। ঘটনার সময় এ কে আজাদ পিস্তলের লোহার বাঁট দিয়ে আঘাত করে রাজেশকে। আসামিরা অতর্কিত হামলা করে রাজেশের কাছে থাকা মোবাইল ফোন, গলার স্বর্ণের চেইন ও মানিব্যাগ নিয়ে নেয়। সব মিলে তিনি প্রায় ৬৯ হাজার ৮০০ টাকার জিনিস খোয়ান। আহত অবস্থায় রাজেশকে আশপাশের লোকজন রিকশায় করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়।

এ ছাড়া ডিএমপির রমনা থানায় পানি ব্যবসায়ী ও যুবদলের কর্মী মো. রাকিবকে হত্যাচেষ্টা মামলার চার্জশিট দিয়েছে পিবিআই। আন্দোলনে অংশ নিয়ে গত বছরের ৩ আগস্ট বিকালে রাজধানীর রামপুরা টিভি সেন্টারের পাশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হামলায় গুরুতর আহত হন তিনি। এ ঘটনায় ১৭ আগস্ট রামপুরা থানায় ৯ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ২০০ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেন মো. রাকিব।

এজাহারে উল্লেখ করা হয়, গত বছরের ৩ আগস্ট বিকালে রামপুরা টিভি সেন্টারের পাশে লেগুনা স্ট্যান্ডে ছাত্র-জনতার আন্দোলন কর্মসূচিতে অংশ নেন রাকিব। এসময় আসামিরা পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রাকিবের ওপর আক্রমণ করে গুরুতর জখম করে। পরে তিনি আফতাবনগর নাগরিক স্পেশালাইজড হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। মামলার আসামিরা হলেন-রামপুরা থানার ৯৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী মো. সাব্বির হোসেন। ১৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ইউনিট সভাপতি এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের অর্থ যোগানদাতা মো. নজরুল ইসলাম। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ কর্মী ওবাইদুল্লাহ, মো. নুরা আকাশ, আনোয়ার হোসেন, মো. তানিম হোসেন, সফিউল্লাহ, মো. কাউসার, মো. কামরান।

মামলাটি তদন্ত করেন পিবিআইর উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. কবির হোসেন। গত ২৫ মে তিনি আদালতে চার্জশিট জমা দেন। তদন্তকালে এজাহারনামীয় আসামি ওবাইদুল্লাহর কোনো তথ্য না পাওয়ায় চার্জশিটে তার নাম বাদ দিয়েছে পিবিআই। তবে পিবিআই’র তদন্তে নতুন করে আরও চার আসামির নাম উঠে এসেছে। তারা হলেন-খিলগাঁও থানা আওয়ামী লীগের কর্মী আরিফুল ইসলাম সাকিব ওরফে মোল্লা সাকিব, রামপুরা থানা ছাত্রলীগের সহ-সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মামুন, মাদক ব্যবসায়ী ও রামপুরা থানা আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী মনির হোসেন তোতা মিয়া, রামপুরা থানা ৯৮ নম্বর ওয়ার্ড শ্রমিকলীগের ইউনিট সভাপতি সিরাজুল ইসলাম।

পিবিআই সূত্র বলছে, মামলাটি তদন্তকালে জানা যায় বাদী রাকিব একজন বিশুদ্ধ ফিল্টার পানির ব্যবসায়ী। তিনি রামপুরা কাঁচাবাজার এলাকাসহ আশপাশের এলাকাতে বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও অফিসে খাবার পানি সরবরাহ করে থাকেন। বিগত সময়ে আওয়ামী লীগ নেতা সাব্বির হোসেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল রামপুরা এ ব্লক-এর কাঁচাবাজার। সেখানে কেউ ব্যবসা করতে হলে সাব্বির হোসেনকে চাঁদা দিয়ে ব্যবসা করতে হতো। রাকিবের কাছ থেকে তারা জোর করে চাঁদা আদায় করত। চাঁদা দিতে না চাইলে বিভিন্ন হুমকি ধমকিও দিত। এর জের ধরেই রাকিবের ওপর হামলা করা হয়।