

জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব কেএম আলী নেওয়াজ যুগান্তরকে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের মতামত জানিয়েছে। তাদের মতামত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কমিশনের কাছে উপস্থাপন করা হবে। কমিশন যে সিদ্ধান্ত দেবে, ইসি সচিবালয় সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। এর বেশি মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
আরও জানা যায়, রাজনৈতিক দল ও অ্যাডভাইজরি কমিটির সুপারিশ গুরুত্ব দিয়ে ‘প্রক্সি ভোটিং’ পদ্ধতি থেকে সরে এসেছে ইসি। কমিশন ‘আইটিভিত্তিক পোস্টাল ব্যালট’ পদ্ধতি চালুর দিকে ঝুঁকছে। এ পদ্ধতিতে প্রবাসে থাকা বাংলাদেশি ভোটার অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করবেন এবং পোস্টাল ব্যালটে তার ভোট দিতে পারবেন। ‘আইটিভিত্তিক পোস্টাল ব্যালট’ ভোটিং পদ্ধতি নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ডাক বিভাগ এবং আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ইসির কর্মকর্তারা। ওই বৈঠকে জানানো হয়, এ পদ্ধতিতে একজন ভোটারের ভোট দিতে ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকা খরচ হবে। পাশাপাশি ‘আইটিভিত্তিক পোস্টাল ব্যালট’ পদ্ধতি কার্যকর করতে হলে আরপিও এবং নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালায় সংশোধনীর প্রয়োজন হবে, এর খসড়াও তৈরি হচ্ছে।
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে আলোচনা চলছে। যদিও নির্বাচন কমিশন এখন পর্যন্ত ভোটের নির্দিষ্ট দিন বা মাসের কথা উল্লেখ করেনি। তবে নির্বাচন যখনই হোক না কেন, সেখানে প্রবাসীরা যাতে ভোট দিতে পারেন, সেই চেষ্টা করছে কমিশন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কমবেশি দেড় কোটি প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছেন। তাদের বড় অংশই ভোটার। আইনে সুযোগ থাকলেও বাস্তবে জাতীয় সংসদ এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তারা ভোট দিতে পারেননি। ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার ওপর জোর দিয়েছে। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রবাসীদের ভোটাধিকার দিতে পোস্টাল ব্যালট বা ই-ভোটিং ব্যবস্থার সুপারিশ করে।
ইসি সূত্র জানায়, প্রবাসীদের ভোটাধিকার দিতে অনলাইন, পোস্টাল ব্যালট ও প্রক্সি ভোটিং-এ তিন পদ্ধতি নিয়ে কাজ শুরু করে ইসি। এ তিন পদ্ধতির ইতিবাচক ও চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় প্রক্সি ভোটিং পদ্ধতিকে সবচেয়ে সহজ ও কার্যকর বলে বিবেচনা করে আসছে ইসি। ওই পদ্ধতির বিষয়ে ১৭ মার্চ ইসিতে এক অনুষ্ঠান শেষে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘বড় পরিসরে প্রবাসীদের ভোট দেওয়াতে যদি চাই, তাহলে প্রক্সি ভোটিং ছাড়া আর কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। কারণ, বাকি যে দুটো বিকল্প রয়েছে, এগুলো পাইলটিং পর্যায়ে যাওয়া যাবে, লার্জ স্কেলে ডেপ্লয় হয়তো করা যাবে না।’ এ বিষয়ে ২৭ এপ্রিল রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে সেমিনার করে ইসি। ওই সেমিনারে রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন ধরনের মতামত তুলে ধরে। ইসি তাদের লিখিত মতামত দেওয়ার অনুরোধ জানায়।
অনলাইনভিত্তিক পোস্টাল ব্যালট পদ্ধতিতে ঝুঁকছে ইসি : ইসি সূত্র জানায়, বিএনপি, জামায়াতসহ ২৪টি রাজনৈতিক দল ইসিকে তাদের মতামত জানিয়েছে। এর মধ্যে ২২টি দল লিখিত এবং একটি দল মৌখিক মতামত জানিয়েছে। আরেকটি দল ইসির অনুরোধে সাড়া দিলেও কোনো পদ্ধতি সমর্থন বা অসমর্থনের কথা উল্লেখ করেনি। এ হিসাবে দলটি তিনটি পদ্ধতির পক্ষে মত দিয়েছে বলে ধরে নিয়েছেন ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কোনো মতামত দেয়নি।
মতামত দেওয়া দলগুলোর মধ্যে বিএনপি শুধু পোস্টাল ব্যালটে ভোটের সুপারিশ করেছে। জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি)-সহ কয়েকটি দল ‘অনলাইন’ ও ‘পোস্টাল ব্যালট’ পদ্ধতির পক্ষে সুপারিশ করেছে। এছাড়া লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি সীমিত পরিসরে পোস্টাল ব্যালট চালুর মত দিয়েছে। নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি তিন পদ্ধতির পক্ষেই মত দিয়েছে।
সূত্র জানায়, ২৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ১৮টি ‘অনলাইন’, ১৫টি ‘পোস্টাল’ এবং ৮টি ‘প্রক্সি ভোটিং’ পদ্ধতির পক্ষে মত দিয়েছে। রাজনৈতিক দলের সুপারিশ এবং অ্যাডভাইজরি কমিটির মতামতের ভিত্তিতে আইটিভিত্তিক পোস্টাল ব্যালট পদ্ধতির দিকে ঝুঁকছে ইসি। একাধিক কর্মকর্তা জানান, পোস্টাল ব্যালটের পাশাপাশি সীমিত পরিসরে অনলাইন পদ্ধতি পাইলটিং করার বিষয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে।
কেমন হবে পোস্টাল ব্যালট পদ্ধতি : ইসি সূত্র জানায়, আসন্ন নির্বাচনে ভোট দিতে ইচ্ছুক প্রবাসী বাংলাদেশিরা অনলাইনে আবেদন করবেন। তার আবেদনের ভিত্তিতে তিনি যে আসনের ভোটার, সেখানের তালিকা থেকে তার নাম বাদ দেওয়া হবে এবং তাকে প্রবাসী ভোটার তালিকায় যুক্ত করা হবে। পোস্টাল ব্যালটে তিনি তার ভোট দেবেন। ইসির কর্মকর্তারা জানান, ভোটগ্রহণের নির্ধারিত দিনের আগেই পোস্টাল ব্যালটে ভোট নেওয়া হবে এবং সংশ্লিষ্ট আসনে ওই ভোট গণনা করা হবে। কোনো ব্যক্তি অনলাইনে নিবন্ধন করলে তিনি ওই নির্বাচনে আগমুহূর্তে দেশে এলেও ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারবেন না। একই ব্যক্তি দুইবার যাতে ভোট দিতে না পারেন, সেজন্য এ পদ্ধতি নেওয়া হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
ইসির কর্মকর্তারা জানান, সরকারি চাকরিজীবী, আইনগত হেফাজতে আটক ব্যক্তি এবং প্রবাসীদের পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার সুযোগ বিদ্যমান আইনে রয়েছে। কিন্তু ওই পদ্ধতি তেমন কার্যকর নয়।
পোস্টাল ব্যালটে খরচ বাড়বে : সূত্র জানায়, প্রবাসীদের দ্রুত পোস্টাল ব্যালট পাঠানো এবং তা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে ২৪ জুন নির্বাচন কমিশনে একটি বৈঠক করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ডাক বিভাগ, বেসরকারি আন্তর্জাতিক কুরিয়ার প্রতিষ্ঠান ফিডেক্স ও ডিএইচএল-এর প্রতিনিধিরা অংশ নেন। ওই বৈঠকে ডাক বিভাগের মহাপরিচালক জানান, ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়নের সদস্য হওয়ায় বিশ্বব্যাপী তাদের সার্ভিস রয়েছে। বিষয়টি বাংলাদেশ বিমানের সময়সূচির ওপর নির্ভরশীল। তবে বিশ্বের সব দেশে পোস্টাল ব্যালট পাঠানো সম্ভব হবে না। তিনি জানান, ডাক বিভাগের মাধ্যমে পোস্টাল ব্যালট পাঠানো ও ফেরত আনতে জনপ্রতি ৪০০-৫৫০ টাকা খরচ হতে পারে। অপরদিকে ফিডেক্স ও ডিএইচএল প্রতিনিধি জানিয়েছেন, তারা পোস্টাল ব্যালটের গোপনীয়তা রক্ষা করে তা ফেরত আনতে পারবেন। এজন্য ১০-১২ দিন সময়ের প্রয়োজন হবে। জনপ্রতি আনুমানিক খরচ হবে পাঁচ হাজার টাকা।