
ধানমন্ডি সাতমসজিদ সড়কসংলগ্ন আবাহনী মাঠের জায়গা সরকারের। এটি অভিজাত ধানমন্ডির শিশু-কিশোরদের খেলার মাঠ হিসাবে গড়ে তোলা হয়েছিল। তবে রাঘববোয়ালদের থাবায় ৩০ বিঘার বেশি (৬০৭ কাঠা) আয়তনের এই মাঠটি বার্ষিক মাত্র ৫০ হাজার টাকা সালামির বিনিময়ে ইজারা নিয়েছে আবাহনী লিমিটেড। আবাহনীর নামে ৯৯ বছরের জন্য মাঠটি ইজারা দেওয়া হয়েছে। অথচ এই এলাকার জমির বাজার মূল্য সর্বনিু ২ কোটি ধরে হিসাব করলেও ওই জায়গার মূল্য ১ হাজার ২১৪ কোটি টাকা হবে। জনঘনত্বের এই শহরে নগরের প্রাণকেন্দ্রের একটি খেলার মাঠ কোনো একটি গোষ্ঠীর নামে ইজারা দিয়ে দেওয়া আত্মঘাতীমূলক কাজ বলে মনে করছেন নগর বিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্টরা।
তাদের মতে, একটি খেলার মাঠ কোনো ক্লাব বা প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দেওয়া যেতে পারে না। আগের সরকার স্বার্থান্বেষী মহলের সঙ্গে যোগসাজশ করে এটি করেছে। হাজার কোটি টাকারও বেশি মূল্যের এই মাঠটি নামমাত্র সালামিতে কোনো ক্লাবের নামে ইজারা থাকতে পারে না। এই বরাদ্দ বাতিল করতে হবে।
এ বিষয়ে নগর বিশেষজ্ঞ এবং স্থপতি ইকবাল হাবিব যুগান্তরকে বলেন, উন্মুক্ত স্থান বা মাঠ মানুষের নাগরিক অধিকার। ধানমন্ডি মাঠটি ওই এলাকার সব জনগণের। একটি ক্লাব বা প্রতিষ্ঠানের নামে ইজারা দেওয়া তৎকালীন সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত হয়েছে। ধানমন্ডিবাসীর মাঠের অধিকার ফিরিয়ে দিতে সরকার ওই মাঠটি আবাহনী লিমিটেডের কাছ থেকে ফিরিয়ে নিতে পারে।
তিনি জানান, একটি মাঠ বা গণপরিসর কোনো ক্লাব বা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে দেওয়া উচিত নয়। এলাকাবাসীর সমন্বয়ে যৌথ পরিচালনা কমিটি করতে হবে। আর মাঠের সার্বিক ব্যবস্থাপনা ট্যাক্সের টাকায় সিটি করপোরেশন করবে। এ সংক্রান্ত নীতিমালাও সরকার অনুমোদন করেছে। বর্তমান সরকারের এ বিষয়ে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
এ প্রসঙ্গে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার যুগান্তরকে বলেন, ধানমন্ডি মাঠটি আবাহনী লিমিটেডের নামে ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয়েছে। এজন্য তারা সেখানে বিভিন্ন অবকাঠামো করছে। তবে কিছু শর্ত দিয়ে সরকার ইজারা দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ইজারার কোনো শর্ত ভাঙছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হবে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ষাটের দশকে গড়ে ওঠা ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী, মাঠটি পার্ক হিসাবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তাই পার্কের আদলে অবকাঠামোও তৈরি করা হয়েছিল। পরে ১৯৭০ সালে ওই মাঠের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয় তৎকালীন ঢাকা পৌরসভাকে। আবাহনী ক্রীড়া চক্র ওই মাঠের জমিতে একটি ক্লাব তৈরি করে। ওই ভবনের আঙিনাসহ ক্লাবের দখলে থাকা জমির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩১ দশমিক ২১ কাঠা। ১৯৭২ সাল থেকে ক্লাবটি মাঠের একটি অংশ খেলার কাজে ব্যবহার করতে থাকে। এসব কারণে সামাজিকভাবে ওই মাঠটি ‘আবাহনী মাঠ’ নামে পরিচিতি পায়।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ১৯৯৬ সালের ৫ আগস্ট আবাহনী লিমিটেডের পক্ষে কর্নেল (অব.) কাজী শাহেদ আহমেদ মাঠের ৯ দশমিক ৭৫৯ একর জমি আবাহনী লিমিটেডের অনুকূলে ৯৯ বছরের জন্য ইজারা চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেন। এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৮ সালের ২১ জুলাই গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি সারসংক্ষেপ পেশ করে। এরপর ১৭ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ওই মাঠের সামান্য অংশ বাদে সিংহভাগ জায়গাই আবাহনী লিমিটেডের নামে ইজারা দেন। এরপর ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর মাঠের বাকি ০.৮৯০০ একর জমি আবাহনী লিমিটেডের নামে একই শর্তে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, মোট ১০ দশমিক ৬৪৯ একরের মাঠটিই দখলে নেয় আবাহনী।
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নথিপত্র থেকে জানা যায়, ইজারার সময় চারটি শর্ত দেওয়া হয়। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-১. আবাহনী লিমিটেড ওই মাঠটিকে ক্রীড়া কর্মকাণ্ড পরিচালনা, ক্রীড়া অনুশীলন এবং খেলাধুলার মাঠ হিসাবেই ব্যবহার করবে ২. মাঠটির পাবলিক পার্কের বৈশিষ্ট্যের কোনো পরিবর্তন করা যাবে না ৩. ওই জায়গায় বাণিজ্যিক স্থাপনা বা মার্কেট নির্মাণ করা যাবে না ৪. মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া খেলাধুলা ও সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত স্থাপনা ব্যতীত কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না।
মন্ত্রণালয় ও গণপূর্ত অধিদপ্তর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জনগণের খেলার মাঠ কোনো ক্লাবের নামে এত বছরের জন্য ইজারা দেওয়া সঠিক হয়নি। আর শর্তগুলোয় স্ববিরোধী অবস্থান রয়েছে। এ দুর্বলতার সুযোগে আবাহনী লিমিটেড জনগণের মাঠটি গিলে ফেলছে। সেখানে গড়ে তুলছে বহুতলবিশিষ্ট অট্টালিকা। মন্ত্রণালয়কে জনগণের এই মাঠটি উদ্ধারে ভূমিকা রাখা উচিত বলে মনে করছেন তারা। কেননা, ওই জায়গায় তারা ক্লাবের ব্যানারে বাণিজ্যিক ও অসামাজিক কার্যক্রমের টেকসই স্থাপনা গড়ে তুলছেন। এটা রুখে দিত হবে। ৫ আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে এমন প্রত্যাশা তাদের। এজন্য ইজারা শর্ত বিশ্লেষণ করলে অনেক ত্রুটি খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন তারা। ওই সূত্রে ইজারা বাতিল করে দেওয়া যাবে। এজন্য সরকার সংশ্লিষ্টদের তৎপর হতে হবে।
ভুক্তভোগীরা জানান, আবাহনী মাঠ নামে পরিচিত পাওয়া ধানমন্ডি সাতমসজিদ রোডসংলগ্ন (১২/এ (নতুন) এবং ১৩/এ (পুরাতন) এর মধ্যবর্তী স্থানের মাঠটি শুধু ধানমন্ডি নয়, ঢাকার বড় একটি অংশের মানুষের বিনোদনের জায়গা ছিল। শিশুদের খেলাধুলার জন্য মাঠটি উন্মুক্ত ছিল। সেসব কিছু এখন শুধুই স্মৃতি। আওয়ামী লীগের সময় ওই মাঠে কাজ শুরু হয় কমপ্লেক্স ভবনের। বসেছে জুয়ার আসর, ক্যাসিনো। কোটি টাকা দিয়ে সেই ক্যাসিনোর সদস্যপদ নিয়েছেন অনেকে। আর এসব টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ক্লাবসংশ্লিষ্ট রাঘববোয়ালরা।
তারা আরও জানান, আবাহনী মাঠকে শুধু শেখ কামাল ক্লাবের নামে ক্যাসিনো বানিয়ে রেখেছিলেন সালমান এফ রহমান। সেখানে শুধু অর্থের বিনিময়ে খেলার সুযোগ দেওয়া হতো। স্থানীয় জনসাধারণের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। মাঠের অর্ধেক দখল করে সীমানা প্রাচীর তুলে গড়ে তোলা হচ্ছে সুপার কমপ্লেক্স। দুইতলা বিশিষ্ট সুপার কমপ্লেক্সে সুইমিং পুল, ব্যায়ামাগার, বাস্কেটবল, ক্যাসিনো এবং ২০টি দোকান ঘর নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। মাঠজুড়ে অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের আয়োজন ৫ আগস্টের পর থেকে থমকে রয়েছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, আবহানী মাঠের অর্ধেকটার বেশিজুড়ে স্থাপনার জন্য লোহার জালের ব্যারিকেড। মাঠের একপাশে প্রশাসনিক ভবন এবং অন্য পাশে স্টাফদের বাসা। সালমান এফ রহমান কাজটির টেন্ডার দিয়েছেন একটি চীনা প্রতিষ্ঠানকে। বর্তমানে স্থাপনাটি পাহারা দিতে আবাহনী ক্লাবের দায়িত্বপ্রাপ্তরা কয়েকজন সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগ দিয়েছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, আবাহনী মাঠে খেলার জন্য সদস্য হতে লাগত ১ কোটি টাকা। সালমান এফ রহমান সুপার কমপ্লেক্স তৈরির কাজ শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে সদস্যপদ বিক্রি করে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা আদায় করেন। শেখ কামালের জন্মদিন বা মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আবাহনীর সদস্যপদ দেওয়া হতো অর্থাৎ তাদের প্রকাশিত সুবিনিয়র বিক্রি করা হতো। একেকটি সুবিনিয়র বিক্রি বাবদ আদায় করা হয়েছে ১ কোটি টাকা করে। এর বিনিময়ে তারা মাঠে আজীবন খেলার সুবিধা পেত। সুপার কমপ্লেক্সের ভেতরের বাস্কেটবল, সুইমিংপুল আর ক্রিকেট খেলার মাঠ ব্যাহার করার জন্য এলাকাবাসীর কাছ থেকে সবশেষ গত ৫ বছরে এসব টাকা আদায় করা হয়েছে।
আরও জানা যায়, ধানমন্ডি মাঠ অবরুদ্ধ করে মাঠের ফটকে পাহারাদার বসিয়েছিল ক্লাব কর্তৃপক্ষ। আদালত এই মাঠ সবার জন্য উন্মুক্ত রাখার জন্য রাজউক ও সিটি করপোরেশনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সিটি কপোরেশন, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্টরা সব সময় নির্বিকারই থেকেছে। তাদের নীরবতা দখলদারদের সমর্থন দিয়েছে। তারা আরও পোক্ত হয়ে বসেছে। ওই মাঠের স্থায়ী সব অবকাঠামো তৈরির অনুমোদন দিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। একই ধারা অনুসরণ করে সবকিছুর বৈধতা দিয়েছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি গণপূর্ত অধিদপ্তরও ওই মাঠে ইজারার শর্ত ভঙ্গ হচ্ছে কিনা, তা যাচাই করে দেখছে না। এই সুযোগে তারা বেপরোয়া হয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
ধানমন্ডি মাঠে (আবাহনী) স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ ও সবার প্রবেশের অধিকার দাবিতে ২০১৪ সালের ১১ এপ্রিল ৫০টি সংগঠনের সমন্বয়ে আন্দোলন করেন সচেতন নাগরিক সমাজ। এ সময় আন্দোলনকারীরা মাঠে ঢুকে পড়েন। এ ঘটনায় ‘ধানমন্ডি ক্লাব কর্তৃপক্ষ’ চারজনের নামসহ অজ্ঞাত ২০০ জনকে আসামি করে অবৈধ প্রবেশের অভিযোগে মামলা করেন।
এ বিষয়ে ২০১১ সালের ১৫ মার্চ হাইকোর্ট মাঠ রক্ষায় চূড়ান্ত আদেশ দেন। হাইকোর্ট অপ্রয়োজনীয় সব অবৈধ স্থাপনা ১৫ দিনের মধ্যে অপসারণ করে মাঠ সবার জন্য উন্মুক্ত রাখার জন্য ঢাকা সিটি করপোরেশন, রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষকে আদেশ দেন। হাইকোর্টের এই রায় বাস্তবায়নে সক্ষমতা নেই জানিয়ে তৎকালীন ঢাকা সিটি করপোরেশন তখন আপিল করে।