Image description

ট্রেনের টিকিটে অনিয়ম ঠেকাতে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। যাত্রী হয়রানি, টিকিট কালোবাজারির মতো অনিয়ম রয়েই গেছে। এসব অনিয়মের অভিযোগ পেয়ে সরজমিন অভিযানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ২৮শে মে রাজধানীর দুই স্টেশনসহ দেশের মোট আটটি স্টেশনে অভিযান পরিচালনা করে সংস্থাটির এনফোর্সমেন্ট ইউনিট।  একই সময় ট্রেনের টিকিট বিক্রয়কারী অনলাইন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান সহজ ডটকমেও হানা দেয় দুদক। এ সময় টিকিট বিক্রিতে যাত্রী হয়রানিসহ নানা অনিয়মের তথ্য ও প্রমাণ পায় দুদক। সংস্থাটির অভিযান পরিচালনাকারী দলের সদস্যরা এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনও দিয়েছেন কমিশনে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদক এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, অভিযানকালে ব্যাপক অনিয়ম পাওয়া যায়। বিশেষ করে সিলেট ও চট্টগ্রামে। আমরা কমিশনের বিস্তারিত প্রতিবেদন তুলে ধরেছি। কমিশন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। 
দুদক সূত্রে জানা গেছে, ঈদে ট্রেনের টিকিট কালোবাজারির একাধিক অভিযোগ পায় সংস্থাটি। সেই অভিযোগের অংশ হিসেবে ২৭শে মে সহজ ডট কমের কার্যালয়ে যায় সংস্থাটির এনফোর্সমেন্ট ইউনিট। এ সময় ঢাকা-সিলেটগামী পারাবত এক্সপ্রেস (৭০৯) ট্রেন-এর ৬ই মে’র টিকিট অনলাইনে বিক্রয় সংক্রান্ত কার্যক্রম সরজমিন পর্যবেক্ষণ করা হয়। পরবর্তীতে সহজ ডট কম-এর রেলসংশ্লিষ্ট এডমিন সার্ভার পর্যবেক্ষণ করা হয়। এ সময় দেখা যায়, ভিআইপি কোটার জন্য একটি নির্দিষ্টসংখ্যক সিট সিস্টেমে ইমার্জেন্সি কোটা করে ব্লক রাখা হয়। নির্ধারিত সময়ে ট্রেনের টিকিট উন্মুক্ত হওয়ার সময় ভিআইপি কোটার বাইরেও অনুরোধের টিকিটগুলো কম্পিউটার সিস্টেমে ব্লক করে রাখার সুযোগ রয়েছে বলে দুদক এনফোর্সমেন্ট টিমের কাছে প্রমাণ পাওয়া যায়। 

পরদিন অর্থাৎ ২৮শে মে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে অভিযানে যায় দুদক টিম। এ সময় স্টেশনে অবস্থানরত যাত্রী ও অন্যান্যদের জন্য প্রয়োজনীয় বিশ্রামাগারের অপ্রতুলতা, অপরিচ্ছন্নতা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক অনিয়ম দেখে অভিযান পরিচালনাকারী দলটি। এ ছাড়া স্টেশনে অবস্থানরত ও যাত্রারত যাত্রীদের জন্য খাবার পানি সরবরাহের কলগুলো বন্ধ পাওয়া যায়। ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনে ইজারা পদ্ধতিতে পাবলিক টয়লেট স্থাপন করা হয়েছে যেখানে অতিরিক্ত মূল্য প্রদান করতে হয় বলে যাত্রীরা অভিযোগ করেন। অনবোর্ড ট্রেন (বনলতা এক্সপ্রেস)-এর যাত্রীসেবা ও অন্যান্য সুবিধাদি পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, ট্রেনে প্রয়োজনীয় সংখ্যক এটেন্ডেটের অনুপস্থিতি রয়েছে এবং বরাদ্দকৃত টয়লেট টিস্যু ও সাবান দেয়া হয়নি। এ ছাড়া খাবার গাড়ি পরিদর্শনে খাবারের মান অনুযায়ী মূল্য অযৌক্তিক ও মাত্রাতিরিক্ত বলে প্রমাণ পায় দুদক টিম। এ ছাড়াও অভিযানকালে রেলওয়ে ডিজেল ওয়ার্কশপে বাজারমূল্যের থেকে অতিরিক্ত মূল্যে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ কেনার প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়। 

এদিন অভিযান পরিচালনা করা হয় রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনেও। যাত্রীদের সেবা প্রদানে হয়রানি এবং টিকিট কালোবাজারিসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ আসে দুদকে। আভিযানিক টিমের সদস্যরা প্রথমে পরিচয় গোপন করে গ্রাহক সেজে রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের টিকিট কাউন্টার, দায়িত্বরত আরএনবির সদস্য, আশপাশের দোকান এবং বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে টিকিট পাওয়া নিয়ে কথা বলে। পরবর্তীতে অভিযোগের বিষয়ে জানতে রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন ম্যানেজার, রাজশাহী রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের আরএনবির দলনেতা, সহজ ডট কমের রাজশাহী প্রতিনিধি, বুকিং সহকারী এবং ক্লিনিং ইনচার্জ ও পরিচ্ছন্নতা কাজে নিয়োজিত ক্লিনারদের সঙ্গে কথা বলেন দুদক কর্মকর্তারা।

সিলেট রেলওয়ে স্টেশনে অভিযান পরিচালনাকালে এনফোর্সমেন্ট টিম প্রথমে ছদ্মবেশে ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি হচ্ছে কিনা তা যাচাই করেন। তাছাড়া যাত্রী সেবায় নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহ করেন। অভিযানকালে দেখা যায় যে, সিলেট থেকে ঢাকাগামী আন্তঃনগর (কালনী, জয়ন্তিকা, পারাবত, উপবন) এবং ঢাকা হতে সিলেটগামী আন্তঃনগর (পারাবত, জয়ন্তিকা,কালনী, উপবন) এবং সিলেট হতে চট্টগ্রামগামী আন্তঃনগর (পাহাড়িকা, উদয়ন) ও চট্টগ্রাম হতে সিলেটগামী ট্রেনে যাত্রী সেবার জন্য উক্ত ট্রেনসমূহে (সাবান, টিস্যু, তোয়ালে, অ্যারোসল, ফিনাইল, হারপিক, ডাস্টার, ঝাড়ু, হাত ব্রাশ, কমোড ব্রাশ, ডাস্টার ক্লথ, গ্লাস ক্লিনার, ডিটারজেন্ট, মগ, ব্যালচা, বালতি, বদনা, ঝুড়ি ইত্যাদি) প্রায় ১৮ রকমের সামগ্রীসহ দু’জন ক্লিনার থাকার নিয়ম থাকলেও বাস্তবে একজন ক্লিনারের মাধ্যমে কেবলমাত্র এসি বগিতে সাবান ও টিস্যু ছাড়া অন্য কোনো সামগ্রী সরবরাহ করা হয় না। অভিযানকালে সাবান ও টিস্যু ব্যতীত আর কোনো সামগ্রী পাওয়া যায়নি। এভাবে প্রতিমাসে প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে এবং প্রতিবছর ৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা অবৈধভাবে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করে।

অভিযানকালে আরও দেখা যায় যে, বাংলাদেশ রেলওয়ে অনবোর্ড ট্রেনের যাত্রী সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে লোক নিয়োগ করে থাকে। যাকে অ্যাটেনডেন্ট বলা হয়। কালনী এবং পারাবত ট্রেনে প্রগতি এন্টারপ্রাইজ নামীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অনবোর্ড ট্রেনে যাত্রী সেবা দেয়া হয়। এসব ট্রেনের অ্যাটেনডেন্টদের মাসিক বেতন ১৬ হাজার টাকা। কিন্তু অভিযানকালে অ্যাটেনডেন্টদের অনেকেই জানান, বাস্তবে তাদের কোনো বেতন দেয়া হয় না বরং তাদের কাছ হতে উল্টো প্রতিমাসে কয়েক হাজার টাকা নিয়ে নেয়া হয়। না হলে চাকরিচ্যুত করা হয়। চাকরিতে যোগদানের সময় তাদের কাছ থেকে জামানত বাবদ অফেরতযোগ্য দুই লাখ টাকা করে নিয়ে নেয়া হয় এসব টাকা বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের হিসাবের মাধ্যমে লেনদেন করা হয়। এক্ষেত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তারা অনেকটা সিঙ্গাপুরের মডেল ব্যবহার করে থাকে। এভাবে অনবোর্ড একটা ট্রেনের অ্যাটেনডেন্টদের নিকট হতেই কেবলমাত্র ৫৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। এসব ট্রেনের অ্যাটেনডেন্টরা এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকেরা আরও জানান, সেই টাকা বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তাকেও দিতে হয়। ফলে তারা বাধ্য হয়ে বিনা টিকিটে যাত্রী যাতায়াতের ব্যবস্থা করে এবং যাত্রীদের কাছ থেকে অবৈধভাবে টাকা আদায় করতে বাধ্য করে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে অভিনব কায়দায় এসব টাকা রেলওয়ে কর্তাদের নিকট পৌঁছানো হয়। 
অভিযানকালে আরও দেখা যায় যে, পুরাতন প্ল্যাটফরম ভেঙে আনুমানিক সাড়ে তিন টন রড পাওয়া যায়। উক্ত রড আনুমানিক এক লাখ ১৭ হাজার টাকায় বিক্রি করে তা সরকারি ফান্ডে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করা হয়েছে। অভিযানকালে এক ও দুই নং-প্ল্যাটফরমে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে নির্মাণকাজ করারও প্রাথমিকভাবে সত্যতা পাওয়া যায়। তাছাড়া রেলওয়ে স্টাফ কোয়ার্টারে বহিরাগতদের ভাড়া দেয়ার অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

রংপুর রেলওয়ে স্টেশনে অভিযান পরিচালনাকালে এনফোর্সমেন্ট টিম ছদ্মবেশে রেলওয়ে স্টেশনের আশপাশে অবস্থান নিয়ে কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে। এ সময় স্টেশন এলাকায় অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্নতাসহ ৪টি ওয়েটিং রুমের মধ্যে ৩টি ওয়েটিং রুম তালাবদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। ওয়েটিংরুম খুলে রাখার ব্যবস্থা করা, বাথরুমসহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ব্যবস্থার উন্নতির জন্য স্টেশন মাস্টারকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। 

চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে অভিযান পরিচালনার সময় এনফোর্সমেন্ট টিমের সদস্যরা ছদ্মবেশে টিকিট সংগ্রহের চেষ্টা করলে অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে টিকিট বিক্রয়ের সত্যতা পায়। প্রাথমিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, স্টেশনে দায়িত্বরত আরএনবির সদস্যরা বুকিং সহকারীদের সঙ্গে যোগসাজশে টিকিট কালোবাজারির কাজগুলো করে। এ ছাড়া দুদক টিম ঢাকাগামী মহানগর এক্সপ্রেস ট্রেনের বগিগুলো সরজমিন পরিদর্শন করে। এ সময় অতিরিক্ত টাকা আদায় করে যাত্রীদের টিকিট ছাড়াই বগিতে অবস্থান করার সুযোগ দেয়াসহ নানা অনিয়মের সত্যতা পাওয়া যায়। 

ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশনে অভিযানকালে এনফোর্সমেন্ট ইউনিট ছদ্মবেশে তিন ঘণ্টা যাবতীয় কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে। পরবর্তীতে স্টেশন বুকিং সহকারী সোহেল রানার প্যান্টের পকেটে তার মায়ের এনআইডি দিয়ে নেয়া টিকিট পাওয়া যায়। যা তিনি জনৈক এএসপির জন্য ক্রয় করেছেন মর্মে উল্লেখ করলেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললে সে যোগাযোগ করতে পারেননি। বুকিং সহকারী রাজীব সরকারের মোবাইলে তিনটি টিকিটের ছবি ও দু’টি টিকিটের কপি পাওয়া  যায়।  যার একটিও তার নয় এবং এই টিকিটগুলো কখন, কার জন্য, কী উদ্দেশ্যে ক্রয় করেছেন তার কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। যা মূলত কালবাজারে অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রয় করে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে রাখা হয়েছিল। 

দিনাজপুর পার্বতীপুর রেলওয়ে স্টেশনে এনফোর্সমেন্ট টিম রেলওয়ে স্টেশনে ছদ্মবেশে পর্যবেক্ষণ করে। পরবর্তীতে টিকিট বুকিং ও বিশ্রামাগার পরিদর্শন করে কিছু বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে। দালালদের দৌরাত্ম্য থাকার বিষয়ে অভিযোগ পাওয়া গেলে অভিযানকালে  স্টেশনের কর্মকর্তাদের সতর্ক থাকার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
জামালপুর রেলওয়ে স্টেশনে অভিযানকালে টিম প্রথমে যাত্রীবেশে জামালপুর রেলস্টেশনে প্রবেশ করে এবং  রেলওয়ের সামগ্রিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেন। সামগ্রিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণকালে বেশ কিছু অনিয়ম দেখতে পায় দুদক টিম। দুদক কর্মকর্তারা সেবাপ্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন এবং তারা কোনো হয়রানির শিকার হচ্ছে কিনা তা যাচাই করেন। 
এ বিষয়ে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আকতারুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, অভিযানের পর কমিশন এখন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। বেশ কিছু অনিয়ম দুদক এনফোর্সমেন্ট ইউনিট সরজমিনই দেখতে পায়। সেগুলো নিয়ে আরও বিষদ আকারে কাজ চলমান রয়েছে।