
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয় থেকে গত ৬ মে সংস্থাটির ৩৫টি জেলা কার্যালয়ে হঠাৎ নোটিশ দিয়ে পরদিন অভিযানের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয়। তখনো প্রধান কার্যালয়ের শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তা ছাড়া কেউই জানতেন না কোথায় অভিযান হবে। তবে প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশনামতে দুদকের জেলা অফিসগুলো অভিযানের সব প্রস্তুতি নিয়ে রাখে। পরদিন ৭ মে সকালে ডিজিটাল নথির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ে পাঠানো হয় অভিযানে বিস্তারিত তথ্য। যেই পরিকল্পনা সেই কাজ। একযোগে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ৩৫টি জেলা কার্যালয়ে হানা দেয় দুদকের এনফোর্সমেন্ট দল। এর আগে একই কায়দায় গত ২৯ এপ্রিল সকালে দেশব্যাপী স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) প্রধান কার্যালয়সহ ৩৬টি কার্যালয়ে অভিযান চালায় দুদক। তারও আগে গত ১৬ এপ্রিল একযোগে অভিযান পরিচালনা করা হয় দেশের ৩৫টি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে। শুধু এ তিনটি সিরিজ অভিযানই নয়, দুদক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের নেতৃত্বে নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র সাড়ে চার মাসে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডসহ (বিসিবি) ৩৫৯টি অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন, যেসব অভিযানের প্রায় সবই হয়েছে সফল।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১১ ডিসেম্বর মোমেন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পরই সংস্থাটির অভিযানে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এরপরই সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, জনগুরুত্বপূর্ণ ও সেবা খাতের বিভিন্ন দপ্তরে হানা দেওয়া শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন। গত চার মাসে দুদক যেসব প্রতিষ্ঠান, মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে অভিযান পরিচালনা করেছে তার মধ্যে রয়েছে—বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড, নগদ, সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন, সিটি করপোরেশনসমূহ, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন, বাংলাদেশ বেতার, আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, ডিপিডিসি, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়, তিতাস, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, নির্বাচন কমিশন ও উপজেলা নির্বাচন অফিস, এলজিইডি, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, রামগড় স্থলবন্দর, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, সরকারি আবাসন পরিদপ্তর, সমবায় অধিদপ্তর, সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন, বিএসএমএমইউ, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন, জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস, বাংলাদেশ ডাক বিভাগ, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ, বাংলা একাডেমি, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর, রাজউক, বন অধিদপ্তর ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র অধিদপ্তর।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দুর্নীতি দমন কমিশনের হটলাইন নম্বরে ৭ হাজার ১২৭টি অভিযোগ আসে। সেখান থেকে বাছাই করে দুদকের তপশিলভুক্ত ৪২৪টি অভিযোগ রেকর্ডভুক্ত করে এনফোর্সমেন্টে পাঠানো হয়। এ ছাড়া দৈনিক ও সাম্প্রতিক সেল থেকে একই সময়ে ১৩টি অভিযোগের তথ্য পায় এনফোর্সমেন্ট টিম। আর ইমেইল, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং অন্যান্য সোর্স থেকে ২৭৩টি অভিযোগের তথ্য মেলে। সেখান থেকে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সাড়ে চার মাসেই ৩৫৯টি দপ্তরে অভিযান পরিচালনা করে দুদক। এ ছাড়া ব্যবস্থা নিতে বিভিন্ন দপ্তরে ৩৪৪টি চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে মর্মে দুদকে ফিডব্যাক চিঠি এসেছে ৪৮টি। একই সঙ্গে ৩টি ফাঁদ মামলা পরিচালনা করে ঘুষের টাকাসহ হাতেনাতে আটক করা হয়েছে বেশ কয়েকজনকে। এসব অভিযান থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে সরাসরি ১৪টি মামলা করেছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি। আর অভিযানের তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে ৫৬টি পৃথক অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে। একই সঙ্গে প্রশাসনিক ও অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ৭৭টি চিঠি দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ১২৬টি অভিযোগের পরিসমাপ্তি করা হয়েছে।
এদিকে, দুর্নীতি দমন কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে সংস্থাটি অভিযান চালিয়েছিল ৫২৪টি। সে বছর বিভিন্ন দপ্তরে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ৬৩২টি চিঠি দেয় দুদক। ফাঁদ মামলা পরিচালিত হয় মাত্র ২টি, আর অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করা হয় ৬৮টি অভিযোগ। প্রশাসনিক ও অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দেওয়া হয়েছিল ১৮৩টি চিঠি। এ ছাড়া পরিসমাপ্তি করা হয়েছিল ২৯৫টি অভিযোগ।
সিরিজ অভিযানে সাফল্য বেশি: গত ৭ মে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের ৩৫টি জেলা কার্যালয়ে একযোগে অভিযান পরিচালনা করে দুদকের এনফোর্সমেন্ট দল। এই অভিযানে যশোরে তিন দালালকে হাতেনাতে আটক করে দুদক। এরপর মোবাইল কোর্টে দুই দালালকে অর্থদণ্ড এবং অন্য একজনকে অর্থদণ্ডসহ তিন দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। শেরপুরে ছদ্মবেশে অভিযানের সময় বিআরটিএ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দালালদের যোগসাজশের প্রমাণ পায় দুদক। এই অফিসে দালালদের টাকা দিলে পরীক্ষায় পাস, আর না দিলে ফেল করিয়ে দেওয়ার প্রমাণ পায় দুদক। নীলফামারীতে দুই দালালকে হাতেনাতে আটক করে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। বরিশালে ছদ্মবেশে থাকা দুদক কর্মকর্তার কাছে সাড়ে ৩ হাজার টাকার সরকারি ফির লাইসেন্সে সাড়ে ১০ হাজার টাকা দাবি করা হয়। পরে তাকে হাতেনাতে আটক করে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। বাগেরহাটে পরীক্ষার খাতা পর্যালোচনায় ফেল করা প্রার্থীদের টাকার বিনিময়ে পাস করানোর প্রমাণ পায় দুদক। গোপালগঞ্জ অভিযানকালে লাইসেন্স ও ফিটনেস সনদ ইস্যুতে ঘুষ লেনদেন, রেজিস্ট্রার খাতায় সিরিয়াল নম্বর ফাঁকা রেখে দুর্নীতির সুযোগ রাখা, দালালের মাধ্যমে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, দীর্ঘদিন একই কর্মস্থলে থেকে কর্মকর্তাদের অনিয়মে জড়িত থাকার প্রমাণ পায় দুদক। ঠাকুরগাঁওয়ে ব্যবহারিক পরীক্ষায় অংশ না নিয়েও পাস করানোর অভিযোগ পায় দুদক। দিনাজপুর চার দালালকে আটক করে করা হয়, যাদের দুজনকে ৪ দিন করে বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং বাকি দুজনকে সতর্ক করা হয়। একইরকমভাবে অভিযান চালানো বিআরটিএর প্রায় সব কার্যালয়েই দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রমাণ পায় দুদক।
দুর্নীতির আখড়া সাব-রেজিস্ট্রি অফিস: গত ১৬ এপ্রিল রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ৩৫টি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে একযোগে অভিযান চালায় দুর্নীতি দমন কমিশন। অভিযানে দিনাজপুরের চিরিরবন্দর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে একজন নকলনবিশের কাছ থেকে ঘুষের ২৪ হাজার টাকা ও অফিস সহকারীর কাছ থেকে ১১ হাজার ৫০০ টাকা উদ্ধার করা হয়। পরে নকলনবিশকে সাময়িক বরখাস্ত এবং অফিস সহকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে দুদককে আশ্বস্ত করেন জেলা রেজিস্ট্রার।
কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের নাইট গার্ড হিসেবে কর্মরত এক ব্যক্তির কাছে ৪০ হাজার টাকা পায় দুদকের অভিযানিক দল। গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে জমির দলিলের নকল উত্তোলনে সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে দলিলপ্রতি অতিরিক্ত ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত বেশি নেওয়ার প্রমাণ পায় দুদক। এ ছাড়া মোহরার শিখা রানী মণ্ডল ও মোহরার মেশকাতুর রহমানের বিরুদ্ধে দলিলপ্রতি অতিরিক্ত ১ হাজার ৯০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা নেওয়ার প্রমাণ মেলে। সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে ভূমি রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে প্রতি শতকে ১ হাজার টাকা ঘুষ নেওয়ার প্রমাণ পায় দুদক। যশোর সদর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে অফিস সহকারীর ড্রয়ার থেকে ৫ হাজার ১০০ টাকা জব্দ করে দুদক। এ ছাড়া অভিযান চালানো প্রায় প্রতিটি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে নানা ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রমাণ পায় দুর্নীতি দমন কমিশনের এনফোর্সমেন্ট দল।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের কমিশনার (অনুসন্ধান) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হাফিজ আহ্সান ফরিদ কালবেলাকে বলেন, ‘আমাদের প্রায় সব অভিযানই মাঠপর্যায়ে আপামর জনসাধারণের দৈনন্দিন সেবামূলক সরকারি ও আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত। এসব সেবামূলক খাতে সরকার প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে এবং অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়ে নিয়োগ দিয়েছে। এসব সেবা যাতে জনগণ সময়মতো, কোনোরূপ হয়রানি এবং অতিরিক্ত ব্যয় ছাড়া পেতে পারে সেজন্যই আমাদের এ অভিযানগুলো। এর মাধ্যমে আমরা সব সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানকে মানুষের কাছে তাদের দায়বদ্ধতা স্মরণ করিয়ে দিতে চাচ্ছি এবং সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম পেমেন্টে সর্বোচ্চ সেবা প্রদান চলমান রাখার জন্য আচরণগত পরিবর্তনের আহ্বান জানাচ্ছি।’
দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে দুদকের এই কমিশনার বলেন, ‘দুর্নীতিবাজদের কোনো ছাড় বা শিথিলতার সুযোগ নেই, সে যে-ই হোক না কেন। দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং বিচারে সাধ্যমতো চেষ্টা করে যেতে দুদক প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দেশবাসীর কাছে দায়বদ্ধ। এ দায়বদ্ধতা কোনো তাত্ত্বিক বিষয় নয়। এটা বাস্তব এবং প্রায়োগিক। তবে দেশবাসীর সহযোগিতা ছাড়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে কোনো ধরনের সাফল্য সম্ভব নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইউটিউব রিপোর্টে দেখলাম একটা ছোট মুদি দোকানে নিচু করে ঝোলানো সিলিং ফ্যানের বাতাসের প্রেশার নিচে স্থাপিত ডিজিটাল স্কেলের প্লেটের ওপর ফেলে ওজনে কম দেওয়া হচ্ছে। এই আপাততুচ্ছ কিন্তু খুবই লজ্জাজনক প্রক্রিয়া আমাদের বলে দিচ্ছে—দেশের দুর্নীতি এখন আর রাজনৈতিক নেতাকর্মী, মাস্তান আর সরকারি কার্যালয়ে সীমাবদ্ধ নেই, এর ব্যাপ্তি ব্যাপক ও ভয়াবহ। এজন্য আমরা দেশবাসীকে আন্তরিকতার সঙ্গে সব ছোট-বড় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি প্রতিরোধের আহ্বান জানাই।’