
দায়িত্বে অবহেলা ও শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে বিভাগীয় মামলা না করেই সরকারি কর্মচারীদের যেকোনো সময় চাকরিচ্যুত করতে পারবে সরকার । সর্বোচ্চ ২৫ কার্যদিবসের মধ্যে অভিযোগ নিষ্পত্তি করে এই পদক্ষেপ নেওয়া যাবে । জনপ্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকারি চাকরি আইন সংশোধন করে এমন বিধান যুক্ত করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার । সরকারি চাকরি আইন সংশোধনে গত এপ্রিলের মাঝামাঝি খসড়া করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় । এ নিয়ে খবর প্রকাশের পর আলোচনা - সমালোচনা হয় । পরে সরকারের চারজন উপদেষ্টার নির্দেশনায় নতুন খসড়া চূড়ান্ত করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় । চূড়ান্ত খসড়ায় বলা হয়েছে , শৃঙ্খলাভঙ্গ ও দায়িত্বে অবহেলার কারণে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীকে নোটিশ দেওয়া হবে । নোটিশ পাওয়ার সাত কার্যদিবসের মধ্যে তার জবাব দিতে হবে ।
নোটিশের জবাব পাওয়ার দিন থেকে ২০-২৫ কার্যদিবসের মধ্যে অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে হবে । এ ক্ষেত্রে বিভাগীয় মামলার প্রয়োজন হবে না । কেউ সাত কার্যদিবসের মধ্যে নোটিশের জবাব না দিলে ওই কর্মকর্তার অনুপস্থিতিতেই অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হবে । শৃঙ্খলাভঙ্গ , অসদাচরণ ও দায়িত্বে অবহেলার কারণে এখনো সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে । তবে বর্তমান আইন ও বিধিবিধান অনুযায়ী বিভাগীয় মামলা দিয়ে এসব অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে অনেক সময় দুই বছরের বেশি সময় লেগে যায় । অভিযোগ নিষ্পত্তির পর রাষ্ট্রপতির কাছে আপিল ছাড়াও প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালে মামলা করার সুযোগ পান সরকারি কর্মচারীরা । গণ - অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পেশাগত দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন করেন ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তারা ।
সচিবালয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দপ্তর ঘেরাও , হট্টগোল তৈরি ও নজিরবিহীন শোডাউন করেন তাঁরা । অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কিছু কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে , অনেককে ওএসডি করেছে । ৫ আগস্টের পর পুলিশের বিভিন্ন স্তরের ১৮০ জন এখনো কাজে যোগ দেননি । অনেকে অনুমতি না নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন । সরকারি চাকরি আইন অনুযায়ী , কারও চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হলে সরকার কারণ দর্শানোর নোটিশ না সরকার কারণ দর্শানোর নোটিশ না দিয়েই চাকরি থেকে অবসরে পাঠাতে পারে । সে ক্ষেত্রে ওই কর্মকর্তা পুরো পেনশন পান । আর বিভাগীয় মামলার মাধ্যমে কাউকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠালে চাকরিকাল অনুযায়ী পেনশন সুবিধা পান তিনি । তবে চাকরি থেকে বরখাস্ত বা অপসারণ করলে কোনো অবসর সুবিধা পাওয়া যায় না । নতুন আইন কার্যকর হলে বিভাগীয় মামলা ছাড়াই যাঁদের চাকরিকাল ২৫ বছরের কম , তাঁদেরও সহজে চাকরিচ্যুত করা যাবে । এ ক্ষেত্রে তাঁরা অবসর সুবিধা পাবেন কি না , সে বিষয়ে খসড়ায় কিছু বলা হয়নি । সরকারি চাকরি আইন সংশোধন করে ২০১৮ সালে বাতিল হওয়া সরকারি কর্মচারী ( বিশেষ বিধান ) অধ্যাদেশ , ১৯৭৯ - এর কিছু ধারা যুক্ত করতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় । এরপর ওই অধ্যাদেশের চারটি ধারা যোগ করে খসড়া করা হয় ।
সূত্র জানায় , খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার , আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল , পরিবেশ , বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানের সঙ্গে গত শুক্রবার বৈঠক করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড . শেখ আব্দুর রশীদ ও জনপ্রশাসনসচিব মো . মোখলেস উর রহমান । ওই সভায় এই চার উপদেষ্টা সরকারি চাকরি আইনে কী কী সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে , সেসব বিষয়ে অবহিত হন । কিছু কিছু বিষয়ে তাঁরা লিখিত মতামত দেন । জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় চারজন উপদেষ্টার মতামতের আলোকে নতুন করে খসড়া চূড়ান্ত করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছে । এখন এটি পাসের জন্য উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে তোলা হবে । নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা বলেন , সরকারি কর্মচারীদের দলবদ্ধ আন্দোলন , সভা - সমাবেশ , কর্মবিরতি , অবস্থান কর্মসূচির পথ বন্ধ করতে আইনে নতুন বিধান যোগ করা হচ্ছে বলে তাঁরা মনে করেন । কোনো কর্মচারীকে সভা - সমাবেশ বা কর্মবিরতির মতো কর্মসূচিতে যোগ দিতে প্ররোচনা দিলেও একই সাজা দেওয়া হবে ।
খসড়ায় বলা হয়েছে , কোনো কর্মচারী যদি এমন কোনো কাজে লিপ্ত হয় , যার কারণে অন্য কোনো সরকারি কর্মচারীর মধ্যে আনুগত্য সৃষ্টি হয় , শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয় , কর্তব্য পালনে বাধার সৃষ্টি হয় , তবে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে । ছুটি না নিয়ে বা যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলে এবং অন্য কর্মচারীকে কাজে অনুপস্থিত থাকতে প্ররোচিত করলে ; অন্যদের কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে ও কোনো কর্মচারীকে তাঁর কর্তব্য পালন না করতে উসকানি দিলে তা - ও অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে । এ জন্য চাকরি থেকে বরখাস্ত , অব্যাহতি এবং পদের অবনমন বা বেতন কমানোর সাজা দেওয়া যাবে । নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান , সরকারি চাকরি আইনের খসড়া পাসের জন্য এর আগে একবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে পাঠানো হয়েছিল । তখন উপদেষ্টা পরিষদ তা অনুমোদন না দিয়ে আরও পর্যালোচনার নির্দেশনা দেয় । নতুন আইন প্রণয়ন বা কোনো আইন সংশোধনের আগে খসড়া প্রকাশ করে সংশ্লিষ্টদের মতামত নেওয়া হলেও সরকারি চাকরি আইনের খসড়ার ওপর মতামত নেওয়া হয়নি । অপর এক কর্মকর্তা বলেন , আগে যে খসড়া করা হয়েছিল , সেখানে কর্মচারীদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ রাখা ছিল না । নতুন খসড়ায় অনেক বিষয় নমনীয় করা হয়েছে । কারণ , আইন সংশোধনের পর আন্দোলন হোক , সরকার তা চায় না ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক সচিব আবু আলম মো . শহীদ খান গতকাল আজকের পত্রিকাকে বলেন , সরকারি কর্মচারী ( বিশেষ বিধান ) অধ্যাদেশ ছিল একটি কালাকানুন । ওই ধরনের কোনো আইন এখন করলে সেটিও কালাকানুন হবে । এই সরকারের প্রধান একটি অঙ্গীকার ছিল সব জঙ্গি আইন ও কালাকানুন বাতিল করবে । বিশেষ ক্ষমতা আইন , ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল হয়নি । তারা এখন আরেকটা কালাকানুন করার পথে হাঁটছে , যেটা সংবিধানবিরোধী । গণ - অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে সরকারি কর্মচারীদের আন্দোলন দমানো , কথায় কথায় কলমবিরতি বন্ধ করা এবং ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে যারা জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করছে , তাদের দমাতে আইন সংশোধন করছে বলে মনে করেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া । তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন , স্বাভাবিক কোনো কাজের জন্য যেন এই বিধান প্রয়োগ না করা হয় । ২৫ কর্মদিবসের মধ্যে অভিযোগ নিষ্পত্তি করলে সমস্যা নেই , যদি তদন্তের বিধান রাখা হয় । অভিযুক্তকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে ।