Image description

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান ও তদন্ত সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে গলদঘর্ম হচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বর্তমানে এই পরিবারের বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধানকাজ চলছে। অনুসন্ধানে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির নতুন নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে। ফলে অভিযোগের পাল্লা দিন দিন ভারী হয়ে বাড়ছে মামলার সংখ্যাও।

আর এসব অনুসন্ধান ও তদন্ত সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত টিম। এ ছাড়া বিদেশে পলাতক প্রভাবশালী এই পরিবারের সদস্যদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করতে কমিশন সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। দুদক সূত্র কালের কণ্ঠকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।

দুদক সূত্র জানায়, ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান সম্পন্ন করতে দিনরাত পরিশ্রম করছে দুদকের তদন্ত টিম।

কাজের পরিধির ব্যাপকতায় সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার ও শনিবার অনুসন্ধান ও তদন্ত টিমকে কাজ করতে হচ্ছে। এই পরিবারের সদস্যদের সম্পদের তথ্য চেয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকুয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া তাঁদের দেশে ফেরাতে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারিসহ দুদক সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

বিচারের মুখে যেসব মামলায় 

শেখ হাসিনা এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ৬০ কাঠা প্লট বরাদ্দে জালিয়াতির অভিযোগে করা ছয় মামলায় শেখ হাসিনাসহ ২৩ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

এরই মধ্যে এসব মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে নিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে পলাতক শেখ হাসিনা, তাঁর পরিবারের সদস্যসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রতিবেদন জমা পড়লে আদালত গেজেট বিজ্ঞপ্তি ও সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ দেবেন। আর এই দুটি আইনি ধাপ শেষ হলে হাসিনা এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হবে। পরবর্তী সময়ে সাক্ষ্যগ্রহণ, আত্মপক্ষ সমর্থন, যুক্তিতর্ক ও রায়ের মধ্য দিয়ে মামলার বিচারকাজ শেষ হবে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।

গত ২৪ মার্চ এসব মামলায় ২৩ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে দুদক। চার্জশিটভুক্ত শেখ হাসিনা পরিবারের সদস্যরা হলেন শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ (পুতুল), বোন শেখ রেহানা, শেখ রেহানার মেয়ে ও যুক্তরাজ্যের সাবেক নগরমন্ত্রী টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক, ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক এবং আরেক মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক।

গত ২৬ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ছয়টি প্লট বরাদ্দে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। পরে চলতি বছরের গত ১২, ১৩ ও ১৪ জানুয়ারি তাঁদের বিরুদ্ধে পৃথক ছয়টি মামলা করা হয়।

শিগগিরই আরেক মামলায় চার্জশিট 

যুক্তরাজ্যের সাবেক নগরমন্ত্রী ও ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোনের মেয়ে টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিকের বিরুদ্ধে করা গুলশানের একটি ফ্ল্যাট ঘুষ নেওয়ার মামলার তদন্ত কার্যক্রম দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। মামলার তদন্তে এরই মধ্যে টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিকের বাংলাদেশের দুই ঠিকানায় এবং লন্ডনের বাড়ির ঠিকানায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে ১৪ মে সকাল ১০টায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হওয়ার জন্য বলা হয়েছে। এর আগে গত ১৫ এপ্রিল টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিকসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়। অন্য আসামিরা হলেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সাবেক সহকারী আইন উপদেষ্টা শাহ মো. খসরুজ্জামান এবং সাবেক সহকারী আইন উপদেষ্টা-১ সরদার মোশারফ হোসেন। এ ছাড়া আছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. নাসিমের ভাই ও রাজউকের সাবেক আইন উপদেষ্টা ড. মো. সেলিম। ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম এরই মধ্যে মৃত্যুবরণ করায় তাঁকে মামলায় আসামি করা হয়নি। মামলায় অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, অপরাধমূলক অসদাচরণ ও অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গের মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার করে কোনো টাকা পরিশোধ না করেই অবৈধ পারিতোষিক (ঘুষ) হিসেবে ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা নিয়ে একটি ফ্ল্যাট (ফ্ল্যাট নম্বর বি/২০১, বাড়ি নম্বর ৫এ ও ৫বি পুরাতন, বর্তমানে ১১৫, ১১বি নতুন, রোড নম্বর ৭১, গুলশান-২, ঢাকা-১২১২) গ্রহণের অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলাটির তদন্ত কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে রয়েছে। শিগগিরই এ মামলায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হবে।

যেসব পুকুরচুরির অনুসন্ধান চলছে

দুদকের একাধিক অনুসন্ধান ও তদন্ত টিম গঠন করে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা মামলার অনুসন্ধান ও তদন্ত চলছে। বর্তমানে অন্তত আটটি পুকুরচুরির অনুসন্ধান করছে কমিশন। এসব অভিযোগের অর্থ আত্মসাতের পরিমাণ হাজার হাজার কোটি টাকা। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গত ১৫ বছরে দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরের উন্নয়নকাজের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ; রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় করে শেখ হাসিনার বিদেশভ্রমণ এবং জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থী চুক্তির বিনিময়ে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনের অভিযোগ,  রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ ৯টি প্রকল্প থেকে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে।

আর শেখ হাসিনা এবং তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচারের অভিযোগ; দেশজুড়ে শেখ মুজিবের জন্মশতবার্ষিকী মুজিববর্ষ পালন ও শেখ মুজিবের ১০ হাজারের বেশি ম্যুরাল ও ভাস্কর্য নির্মাণের নামে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ; এক দশক আগে নিষ্পত্তি হওয়া বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলা পুনরায় তদন্তের সিদ্ধান্ত; ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতার অপব্যবহার ও জাল-জালিয়াতি করে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে দিনের ভোট রাতে করার অভিযোগ এবং বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উেক্ষপণের ফলে রাষ্ট্রের হাজার কোটি টাকার বেশি লোকসানের অভিযোগের অনুসন্ধানও চলছে।

এ ছাড়া ক্ষমতার পালাবদলে দায়মুক্তি পাওয়া নাইকো দুর্নীতি মামলা; মিগ-২৯ বিমান ক্রয় দুর্নীতি মামলা; কোরিয়ান ফ্রিগেট ক্রয় দুর্নীতি মামলা; মেঘনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্র দুর্নীতি মামলা; খুলনায় ভাসমান বিদ্যুৎকেন্দ্র দুর্নীতি মামলা; বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার নির্মাণে দুর্নীতির তিন মামলা এবং বেপজা পরামর্শক নিয়োগ দুর্নীতি মামলা বর্তমান কমিশন পুনরায় আইনানুগ পর্যালোচনা করছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, দুদকের এমন কাজের গতি প্রত্যাশিত ছিল। একদিকে দুর্নীতিবাজদের সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্তের ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যদিকে অপরাধীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

তিনি বলেন, দুদকের কাজের গতি বেড়েছে, এটা ইতিবাচক। তবে এটা যেন শুধু যারা ক্ষমতায় নেই তাদের ক্ষেত্রে না হয়। ক্ষমতাশালীদের দুর্নীতির দিকেও দুদককে সমানভাবে নজর দিতে হবে, এটাই সবার প্রত্যাশা।

দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে একটি মামলায় আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করা হয়েছে। আরেকটি মামলার তদন্তও অগ্রসর হচ্ছে। এ ছাড়া আরো বেশ কয়েকটি অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। অনুসন্ধান শেষে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করলে কমিশন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মীর আহমেদ আলী সালাম কালের কণ্ঠকে বলেন, প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির ছয় মামলায় আদালত চার্জশিট আমলে নিয়েছেন। তবে শেখ হাসিনাসহ অন্য আসামিরা পলাতক থাকায় তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য করা হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়া সাপেক্ষে আদালত পলাতক আসামিদের আদালতে হাজিরে গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেবেন। এ প্রক্রিয়া শেষে আদালত আসামির সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ দেবেন। এ বিষয়ে প্রতিবেদন এলে আসামির অনুপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হবে। এ ক্ষেত্রে পলাতক আসামি কোনো আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবেন না।