
সামরিক বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় সাবেক ১৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত ও অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন ( দুদক ) । এ জন্য ১১ টি টিম গঠন করা হয়েছে । প্রতিটি টিমে সর্বনিম্ন দুজন থেকে চারজন কর্মকর্তা রয়েছেন । এই ১৩ সাবেক সেনা কর্মকর্তার মধ্যে দুজনের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে মামলা হয়েছে , দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পাঁচজনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে এবং চারজনের স্থাবর - অস্থাবর সম্পদ ক্রোক করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত । একজনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে । এসব কর্মকর্তা বিগত সরকারের আমলে সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন ।
সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান সম্পর্কে জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতিরোধ সেলের মহাপরিচালক মো . আক্তার হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ অনুসন্ধান সম্পন্ন হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সে বিষয়ে কমিশনে সুপারিশ করবেন । এরপর কমিশন সেই সুপারিশের আলোকে ব্যবস্থা নেবে । ” ১৩ সেনা কর্মকর্তার মধ্যে রয়েছেন রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল ( অব . ) মো . ছিদ্দিকুর রহমান । দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর ও তাঁর স্ত্রী গাজী রেবেকা রওশনের বিও হিসাব , শেয়ার , ব্যাংক হিসাব ও সঞ্চয়পত্র ক্রোকের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত । গতকাল সোমবার ঢাকার মহানগর দায়রা জজ ও সিনিয়র বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো . জাকির হোসেন এই আদেশ দেন ।
গত ১৭ এপ্রিল এই দম্পতির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় । ছিদ্দিকুর রহমানের বিরুদ্ধে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে । একই আদালত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের ( বিজিবি ) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল ( অব . ) মোহাম্মদ সাফিনুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী সোমা ইসলামের সাতটি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের নির্দেশ দিয়েছেন । সাফিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার , অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে । গত ১৩ মার্চ তাঁদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত ।
দুদকের সূত্র জানায় , সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধেও তদন্ত শুরু হয়েছে । তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ , তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন এবং মালয়েশিয়া , সিঙ্গাপুর ও দুবাইয়ে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার করে ব্যবসা পরিচালনা ও বাড়ি কিনেছেন । এ ছাড়া ফেনী -৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী , তাঁর মেয়ে তাসনিয়া মাসুদসহ চারজনের বিরুদ্ধে ১১ মার্চ মামলা করে দুদক । তাঁদের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়াগামী প্রবাসী শ্রমিকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা অতিরিক্ত আদায় করার অভিযোগ রয়েছে ।
বিগত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে সাবেক সামরিক সচিব ও ঝিনাইদহ -৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মেজর জেনারেল ( অব . ) সালাউদ্দিন মিয়াজীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান করছে দুদক । অভিযোগ রয়েছে , তিনি ভূমিহীনদের জমি দখল করে ৪০০ বিঘা জমিতে পার্ক নির্মাণ করেছেন ।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি তাঁকে তাঁর রিসোর্ট থেকে গ্রেপ্তার করা হয় । একই দিনে তাঁর বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক । ৩০ এপ্রিল তিনি জামিনে মুক্তি পান । জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার ( এনএসআই ) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল ( অব . ) টি এম জোবায়েরের বিরুদ্ধেও তদন্ত চলছে । অভিযোগ রয়েছে , তিনি লন্ডনে ২৯ লাখ ৪৫ হাজার পাউন্ডে বাড়ি কিনেছেন , বিদেশে অর্থ পাচার , মোটা অঙ্কের ঘুষ গ্রহণ এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন । তাঁর ও তাঁর স্ত্রী ফাহমিনা মাসুদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে । আদালতের আদেশে ২১ এপ্রিল জোবায়েরের পাঁচটি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয় ।
শেখ হাসিনার সাবেক নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল ( অব . ) তারিক আহমেদ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে তিনটি বিমানবন্দরের চারটি প্রকল্পে ৮১২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুদক গত ২৭ জানুয়ারি চারটি মামলা করেছে । মামলাগুলোতে মোট ১৯ জনকে আসামি করা হয় । তারিক আহমেদ সিদ্দিক ও তাঁর পরিবারের ১৩ টি ব্যাংক হিসাবও অবরুদ্ধ করা হয়েছে ।
স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের ( এসএসএফ ) সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো . মুজিবুর রহমান ও তাঁর স্ত্রীর নামে একাধিক ফ্ল্যাট ও প্লট রয়েছে — এমন অভিযোগের তদন্ত করছে দুদক । দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৭ মে এয়ার মার্শাল ( অবসরপ্রাপ্ত ) শেখ আবদুল হান্নানের কয়েকটি ফ্ল্যাট ও জমি ক্রোক করার আদেশ দেন আদালত । তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার , রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় , ঘুষ গ্রহণ , নিয়োগ- বাণিজ্য এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে ।
ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের ( এনটিএমসি ) সাবেক মহাপরিচালক বরখাস্ত করা মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানের একটি বাগানবাড়ি , চারটি বাড়ি , তিনটি ফ্ল্যাট ও বিভিন্ন কৃষিজমি জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত । তাঁর নামে থাকা নয়টি ব্যাংক হিসাবও অবরুদ্ধ করা হয়েছে । রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার , দুর্নীতি ও ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে প্রায় ৪০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২৩ জানুয়ারি জিয়াউল আহসান ও তাঁর স্ত্রী নুসরাত জাহানের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক । বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন । ই - পাসপোর্ট ও স্বয়ংক্রিয় বর্ডার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাদাত হোসেন এবং উপপ্রকল্প পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ হোসেনের বিরুদ্ধে সহস্রাধিক কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগের অনুসন্ধান করছে দুদক ।