
দালাল না ধরে অনলাইনের মাধ্যমে ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ ১৮টি সেবা পাওয়ার ব্যবস্থা করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। অনলাইনে সহজে সেবা পাওয়ার ব্যবস্থা করলেও বিআরটিএ কর্মকর্তাদের ইন্ধন ও ইশারায় দালালদের চক্র গড়ে উঠেছে বিআরটিএর বিভিন্ন কার্যালয়ে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, দালালচক্রের কাছে ঘুষ না দিলে গ্রাহকরা সেবা পাচ্ছে না। গ্রাহকদের পদে পদে হয়রানির মুখে পড়তে হচ্ছে।
বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগে বিআরটিএর ৩৫ কার্যালয়ে গত ৭ মে অভিযান চালায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযানকালে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে পরীক্ষায় ফেল করলেও অনৈতিক সুবিধার মাধ্যমে পাস দেখানো, ব্যাবহারিক পরীক্ষায় পাস করতে ঘুষ লেনদেন, বিনা নোটিশে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অফিসে উপস্থিত না থাকা, দালাল দিয়ে কার্যালয়ে সেবাদানের প্রমাণ পান অভিযানকারীরা। অভিযানে দুরবস্থা দেখা গেছে যশোর, শেরপুর, নীলফামারী, বরিশাল, বাগেরহাট, টাঙ্গাইল, গোপালগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুরে। এসব জেলায় বিভিন্ন অনিয়ম ধরা পড়ে।
এসব জেলা ছাড়াও চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও বরিশালে কালের কণ্ঠের সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকরা গিয়ে গ্রাহক সেবার দুরবস্থা দেখেছেন।
চট্টগ্রাম বিআরটিএ—ঘুষ না দিলে পদে পদে হয়রানি : বিআরটিএর চট্টগ্রাম কার্যালয়ে কমপক্ষে ৩০ দালালের চক্র আছে। সরকার নির্ধারিত ফির বাইরে অনেকের কাছ থেকে ফিটনেস বাবদ এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা, রুট পারমিট বাবদ দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকা এবং মালিকানা বদলি বাবদ দু-তিন হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে। আর ড্রাইভিং লাইসেন্স নতুন ও নবায়নের ক্ষেত্রে নির্ধারিত ফির বাইরে দুই হাজার থেকে চার হাজার টাকা আদায় করা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক নূপুর দেব গতকাল জানান, গত কয়েক দিন বিআরটিএর চট্টগ্রাম কার্যালয়ে গেলে গ্রাহকরা নানা হয়রানির কথা শোনায়। ট্রাকচালক মোহাম্মদ শফিক জানান, গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর ড্রাইভিং লাইসেন্সের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর থেকে তিনি বেকার হয়ে আছেন। গাড়ি চালাতে না পারায় পরিবার নিয়ে খুব কষ্টে আছেন। ওয়াহিদ নামের এক ব্যক্তিকে প্রায় চার হাজার টাকা দিয়েছিলেন লাইসেন্স নবায়নের জন্য। দেড় মাস আগে ফিল্ড টেস্ট দিলেও কোনো ফল হচ্ছে না।
নগরের পতেঙ্গা থেকে আসা অটোরিকশাচালক মোহাম্মদ নাজিম বলেন, ‘হালকা শ্রেণির লাইসেন্স করতে দালালকে ছয় হাজার টাকা দিয়েছি। দুই বছর ধরে লাইসেন্স পাচ্ছি না। ডকুমেন্টে সময় বাড়ানোর জন্য এসেছি। অফিসে এসে ২০০ টাকা দিতে হয়েছে।’ ফিটনেস ও ট্যাক্স টোকেন সনদের জন্য গাড়ি লাইনে রেখে পাশে অপেক্ষমাণ চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলা থেকে অটোরিকশা নিয়ে আসা খায়রুল আমীন বলেন, বোয়ালখালীর ইমন নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে ফিটনেস ও ট্যাক্স টোকেন বাবদ সাড়ে ১১ হাজার টাকা (আয়কর ছাড়া) খরচ হয়। রুট পারমিটসহ হলে আরো সাড়ে তিন হাজার টাকা লাগবে। টাকা দিলেও কাজ হচ্ছে না। বিআরটিএ চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মো. মাসুদ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ফোনে বলা যাবে না। অফিসে আসেন। সামনাসামনি সব বলব। এখন নেগেটিভ কিছু লিখিয়েন না। কখন আসবেন বলেন।’ এ ছাড়া একই বিষয়ে জানতে বিআরটিএতে অবস্থানকালে একাধিক কর্মকর্তার বক্তব্য জানতে চাইলে তাঁরাও অপারগতা জানান।
রাজশাহী থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক রফিকুল ইসলাম জানান, বিআরটিএ রাজশাহী কার্যালয়ে দালাল ছাড়া সেবা সহজে পাওয়া কঠিন। ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির মালিকানা পরিবর্তন, রেজিস্ট্রেশন, ফিটনেস নবায়নসহ সব ধরনের সেবায় গ্রাহককে বাড়তি অর্থ গুনতে হয় । এ অর্থ সরাসরি নেন না কোনো কর্মকর্তা। দালালদের হাত ঘুরে ঘুষের টাকা যায় কর্মকর্তাদের পকেটে। বিআরটিএ রাজশাহী অফিসের সামনে তিনটি কম্পিউটারের দোকান ঘিরে এবং অফিসের ভেতরেও ঘোরাঘুরি করেন দালালরা। তাঁদের ম্যানেজ না করলে কোনো কাজের ফাইলই স্বাভাবিক গতিতে এগোয় না। গত ৭ মে এবং আরো কয়েক দিন রাজশাহী বিআরটিএতে গেলে নানা হয়রানির কথা জানান গ্রাহকরা। গ্রাহক পিন্টু আলী বলেন, ‘চার মাস আগে আবেদন করেছিলাম, কিন্তু নানা ঝামেলা ধরে আমাকে দিনের পর দিন ঘুরানো হচ্ছিল। পরে এক দালাল ধরে ১৫ দিনের মধ্যে লাইসেন্স পাওয়ার জন্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর আর কোনো ঝামেলা হয়নি। আমি ড্রাইভিংয়ের কার্ডও পেয়েছি হাতে।’ গত ৭ মে ওই কার্যালয়ে কার্ড নিতে আসা আব্দুর রহিম নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমার এক পরিচিত লোকের মাধ্যমে ড্রাইভিং লাইসেন্সের কাজ করতে নির্ধারিত ফির চেয়ে দেড় হাজার টাকা বেশি দিয়েছিলাম। সে কারণে কোনো ঝামেলা হয়নি।’ অফিসের পিয়ন মোহাম্মদ আলীকে খোঁজাখুঁজি করছিল কেউ কেউ। তাদের একজন হলেন আসলাম উদ্দিন (ছদ্মনাম)। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তিনি জানান, তাঁর বাড়ি বিআরটিএ অফিসের পাশেই নওদাপাড়ায়। পরিচিত কিছু লোকের কাজ করে দেন। তাঁরাই অন্যদের নিয়ে আসেন বিআরটিএর কাজ করার জন্য। যে যে রকম পারে সেভাবে খুশি হয়ে টাকা দেয়। গ্রাহক মঞ্জুর রহমান জানান, তিনি তাঁর প্রাইভেট কারের মালিকানা পরিবর্তনের জন্য কাগজপত্র জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু নানা ভুল ধরে তাঁকে দু-তিন দিন ধরে হয়রানি করা হয়। পরে এক দালালের মাধ্যমে দুই হাজার টাকা দিলে পরিত্রাণ পান।
স্মার্ট কার্ড বিতরণের ইনচার্জ শাহ নেওয়াজ ডেভিড বলেন, ‘আগে অনলাইন না থাকায় প্রচুর ভিড় হতো। এখন আপনি সারা দিনে একসঙ্গে ১০০ লোকও পাবেন না। সেবাপ্রার্থীরা মোবাইলে মেসেজের মাধ্যমে নির্দিষ্ট দিনে এসে ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ অন্যান্য কাজের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে যেতে পারে। তবে অনেকেই নিজে না করে দালাল ধরে। এখানে আমাদের কিছু করার নাই।’ বিআরটিএর রাজশাহী অফিসের মোটরযান পরিদর্শক ও ভারপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমাদের অফিসে ঘুষ লেনদেনের কোনো সুযোগ নেই। নিয়ম অনুযায়ী সার্ভারের মাধ্যমে সব সেবাপ্রার্থী অনলাইনে আবেদন জমা দিলে সে অনুযায়ী কাজ হয়।’
বরিশাল বিআরটিএতে প্রকাশ্যেই ঘুষ লেনদেন : কালের কণ্ঠের সংবাদদাতা আজিম হোসেন জানান, বিআরটিএ বরিশাল কার্যালয়ে সেবাগ্রহীতারা দালালদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। দালাল না ধরলে সেবা আটকে থাকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। যেমন ঝালকাঠি জেলার মোস্তফা কামালের কাছ থেকে একটি ১৫০ সিসি মোটরসাইকেল কিনেছিলেন বরিশাল নগরীর সোহেল রানা। এটির মালিকানা পরিবর্তন করতে রানা বিআরটিএ বরিশাল কার্যালয়ে ঘোরেন এক মাস। মালিকানা পরিবর্তনের কাজ করিয়ে দেবেন বলে দায়িত্ব নিয়েছিলেন ওই কার্যালয়ের অফিস সহকারী ফায়জুল হক তালুকদার। পরে ফায়জুল থেকে দায়িত্ব নেন জাহিদ হোসেন। জাহিদ বরিশালে বিআরটিএর দালাল বলেই পরিচিত। রানা পরে জাহিদকে আট হাজার টাকা দিলে মালিকানা পরিবর্তনের আবেদনটি নেওয়া হয়। ওই মোটরসাইকেলের মালিকানা পরিবর্তনে সরকার পাবে তিন হাজার ৭৯৫ টাকা। বাকি টাকা নেবেন দালাল জাহিদ ও বিআরটিএর একাধিক কর্মকর্তা।
গত ৭ মে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নিচতলায় বরিশাল বিআরটিএ কার্যালয়ে গেলে পুরো প্রাঙ্গণেই দালাল জাহিদের প্রভাব চোখে পড়ে। যানবাহনের মালিকানা পরিবর্তন শাখার কক্ষে তিনি চেয়ারে বসে ছিলেন। তাঁর পাশেই ছিলেন অফিস সহকারী ফায়জুল। যারা মালিকানা পরিবর্তন করতে এসেছিল তাদের সবাই ফায়জুল নিয়ে একই কথা বলছিল। যাদের আবেদন নেওয়া হচ্ছিল তাদের কাছ থেকে ফায়জুলের সহযোগিতায় জাহিদও ওই কক্ষে বসেই প্রকাশ্যে টাকা নিচ্ছিলেন। ‘আপনি এখানে প্রকাশ্যে টাকা নিচ্ছেন কেন’—জাহিদকে এই প্রশ্ন করা হলে তিনি রেগে যান। পরে সাংবাদিক পরিচয় জেনে বললেন, ‘আমি পুরাতন মোটরসাইকেল বিক্রির প্রতিষ্ঠান বাইক হ্যাভেন মোটরসের কর্মচারী। আমাদের কম্পানির গ্রাহকদের গাড়ির মালিকানা পরিবর্তন করে দিচ্ছি।’ এ কথা বলেই তিনি সেই কক্ষ থেকে বের হয়ে যান। তবে অফিস সহকারী ফায়জুল বলেন, ‘এরা গ্রাহকদের ধরে নিয়ে আসে মালিকানা পরিবর্তন ও লাইসেন্স করানোর জন্য। তাদের মাধ্যমেই কাজ করানোর নির্দেশনা রয়েছে আমাদের। এতে দোষের কিছু নেই।’
গত ৭ মে বরিশাল বিআরটিএ কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে দুদক বরিশাল নগরের দপ্তরখানায় সঞ্জীব কুমার দাস নামের দালালকে আটক করে। সঞ্জীব অটোরিকশার মালিকানা পরিবর্তন ও নতুন লাইসেন্সের কাজ করতেন। অটোরিকশা বিক্রিকারী তালহা মোটরস, ইফাদ মোটরস ও রাতুল মোটরসের হয়ে কাজ করতেন সঞ্জীব। লাইসেন্স করতেই তিনি নিতেন ২০ হাজার টাকা। অথচ সরকারি খরচ আরো কম। অটোরিকশার মালিকানা পরিবর্তনে নিতেন আট হাজার ৫০০ টাকা; যেখানে সরকারি খরচ তিন হাজার ৮৫ টাকা।
বাড়তি টাকা দালাল সঞ্জীব এবং অফিসের একাধিক কর্মকর্তা নিতেন। বরিশালে নতুন মোটরসাইকেল বিক্রির প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হচ্ছে সুজুকি মোটরস, এ ওয়ান মোটরস, আল বারাকা মোটরস, হিরো হোন্ডা মোটরস, ম্যাক্স মোটরস, পার্ক বাংলা মোটরস, উত্তরা মোটরস, লায়লা মোটরস, ইনপ্যাক্স মোটরস, গৌরনদী বাইক, আলো মোটরস। আর পুরনো মোটরসাইকেল বিক্রির প্রতিষ্ঠান হলো বাইক হ্যাভেন মোটরস। এই প্রতিটি মোটরসাইকেল বিক্রির প্রতিষ্ঠানের দু-তিনজন করে নিজস্ব লোক থাকে দিনভর বরিশাল বিআরটিএ অফিসে। নতুন মোটরসাইকেল নিবন্ধন ও মালিকানা পরিবর্তনের কাজ করেন তাঁরা। বিআরটিএর সহকারী পরিচালক খালিদ মাহমুদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দালালদের বিরুদ্ধে আমরা সব সময়ই অবস্থান নিই। তবে দালালরা অফিসের বাইরে বসেই কাজ করছে।’ দালালরা তাঁর অফিসের অভ্যন্তরে বসে লেনদেন করেন এবং স্টাফদের সঙ্গে বেশ সখ্য রয়েছে, এটা জানেন কি না—এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘একটু বেকায়দায় তো রয়েছিই।’