
কুমিল্লা মহানগরীর জাঙ্গালিয়া বাস টার্মিনাল। শহরের বেশির ভাগ বাস দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছেড়ে যায় এখান থেকেই। আট মাস আগেও এই বাস টার্মিনাল থেকে কোটি টাকা চাঁদা আদায় করতেন সাবেক স্থানীয় সংসদ সদস্য ও ‘কুমিল্লার ত্রাসখ্যাত’ আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের ঘনিষ্ঠরা। কুমিল্লা শহরে বাহার অধ্যায়ের অবসান ঘটেছে। এখন তিনি বা তার পরিবারের কেউ নেই। নেই দলীয় কোনো নেতাও। একচেটিয়া শাসন করা বাহারের কুমিল্লায় এখনো চাঁদাবাজি থেমে নেই। তবে সরবে নয়। নীরবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সেনাবাহিনীর তৎপরতায় ৫ই আগস্ট রাজনীতির প্রেক্ষাপট বদলে অনেকটা স্বস্তি নেমে আসে। ‘ভাই’ এর নাম করে আদায় হয় চাঁদা। ১০০ থেকে ১ হাজার অঙ্কের চাঁদা দিতে হয় বাসচালক ও সহকারীদের। না দিলেই বিপত্তি। কারা নেয়? কেন নেয়? জানতে চাইলে কেউই বলতে পারে না নাম।
সম্প্রতি কুমিল্লা মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে সরজমিন ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে। স্থানীয় বাসিন্দা, বাসচালক ও পরিবহন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আট মাস আগেও আওয়ামী লীগের নেতারা নানা ব্যক্তির নামে চাঁদা আদায় করতো। কিন্তু সরকার পতনের পর সে চিত্র বদলায়নি। বরং এখন অন্য পক্ষ এসে চাঁদা আদায় করছে। কেউ কেউ দাবি করেছেন, স্থানীয় বিএনপি নেতাদের নামেও অনেকে টাকা চায়। যদিও বিএনপি’র শীর্ষ নেতারা এ বিষয়ে কঠোর ও অবিচল। তারা বলছেন, দলের বা দলীয় কোনো নেতার নামে চাঁদা আদায় করলে কঠিন শাস্তির মুখে পড়তে হবে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে কোথাও কোনো চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটলে বহিষ্কারের মতো বড় সিদ্ধান্তও নেয়া হবে। সেইসঙ্গে চাঁদাবাজিতে জড়িত ব্যক্তিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হবে।
কুমিল্লার জাঙ্গালিয়া বাস টার্মিনাল এলাকায় গত বুধবার গিয়ে জানা যায়, সেখানে কাজল নামের এক ব্যক্তি বাস প্রতি ৩০ টাকা করে আদায় করেন। কিন্তু কারও নাম জিজ্ঞেস করলে বলেন, ভাই দিতে বলেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাত হলে এই অর্থের পরিমাণ বাড়ে। বিশেষ করে টার্মিনাল নির্ধারিত বাসের বাইরে অন্য কোনো বাস হলেই কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৩শ’ কিংবা ৫শ’ টাকাও আদায় করা হয়। অবশ্য সেক্ষেত্রে কাজল ছাড়াও অন্য ব্যক্তিরা এই টাকা আদায় করেন।
বাস টার্মিনালের ভেতরে মো. রতন নামের এক বাসচালক বলেন, আগে এক পক্ষ নিতো। এখন আরেক পক্ষ নেয়। কিন্তু এখন যারা নেয়, তারা কার লোক সেটা বলে না। আগে তো জানতাম আওয়ামী লীগের নেতাদের চাঁদা দিতে হতো। এখন কারও নাম বলে না। শুধু ‘ভাই’- এর নাম করে নিয়ে যায়। দিনের বেলায় ৩০/৪০ টাকা দিতে হয়। রাতে অন্য বাস নিয়ে এলে দিতে হয় ৩০০ বা ৫০০ টাকা।
সিদ্দিক নামের এক বাসচালকের সহকারী বলেন, একেক সময় একেকজন টাকা নেয়। আমরা গরিব মানুষ। কারও নাম জানতে চাই না। টাকা দিলে বাস ঠিকমতো থাকে, না দিলে যদি ভাইঙা দেয় এই ভয়ে দিয়া দেই। ফারুক হোসেন নামের আরেক সহকারী বলেন, সপ্তাহে ২শ’ টাকা করে দিতে হয়। এখানে টার্মিনালের উল্টো পাশে রাতে বাস রাখলেই এই টাকা দিতে হবে। কাকে দিতে হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার নাম তো জানি না। তবে মানুষের কাছে শুনছি নেতা। এখন কোন দলের সেটাও জানি না।
নির্মাণসামগ্রী বিক্রির নামেও চাঁদাবাজি:
ওদিকে, কুমিল্লা শহরে অভিনব পদ্ধতিতে চলছে চাঁদাবাজি। ভবন নির্মাণসামগ্রী বিক্রির নামে টাকা নিচ্ছেন স্থানীয় কিছু ব্যক্তি। বিএনপি’র নাম করে এই টাকা আদায় করলেও দলটির নেতারা বলছেন, এ ধরনের কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে দল জড়িত নয়। বরং এ ধরনের অভিযোগও আসেনি তাদের কাছে। কেউ অভিযোগ করলে তাৎক্ষণিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভবন নির্মাণ খাতে অভিনব কায়দায় চলে চাঁদাবাজি। এ খাতকে ঘিরে ওয়ার্ড পর্যায়ে গড়ে উঠেছে পৃথক চাঁদাবাজ চক্র। এসব চাঁদাবাজ নিজ নিজ এলাকার ভবন নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ করছে। নতুন ভবন নির্মাণ করার জন্য চাঁদাবাজ চক্রের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় নির্মাণ পণ্য কিনতে হয়। অর্থাৎ ইট, বালু, সিমেন্ট, পাইলিং, থাই গ্লাস, রাজমিস্ত্রি, রংমিস্ত্রি, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, টাইলস মিস্ত্রিসহ সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ চাঁদাবাজদের হাতে। ভবন নির্মাণসামগ্রী এবং সব কাজের মিস্ত্রি সরবরাহ করছে সিন্ডিকেট সদস্যরা। আর এসব খাত থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করছেন তারা। নির্মাণসামগ্রী সরবরাহ ছাড়াও প্রতিটি এলাকায় রয়েছে একাধিক ছিঁচকে চাঁদাবাজ। তাদেরকেও পিকনিক, বিভিন্ন দিবস, খেলাধুলা, গান-বাজনা, মিষ্টি এবং চা-নাস্তার নামে নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়। গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এমন চাঁদাবাজির সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। ৫ই আগস্টের পর ফ্যাসিবাদ বিদায় নিলে চাঁদাবাজির এসব সেক্টরে হাতবদল হয়েছে। এক চাঁদাবাজের বিট আরেক চাঁদাবাজ চক্র দখলে নিয়েছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ ফ্যাসিবাদ বিদায়ের পর চাঁদা বন্ধ হওয়ার পরিবর্তে আরও বেড়েছে।
নগরীর বিষ্ণুপুর এলাকার বাসিন্দা কামাল হোসেন বলেন, কয়দিন আগে আমার বাড়ি করার জন্য নির্মাণসামগ্রী কিনতে হয়েছে। এসব জিনিসপত্রের জন্য কিছু ছেলেপেলে এসে বললো, সব ওদের পরিচিত দোকান থেকে নিতে। আর বাড়ি করার আগে চা-নাস্তা বাবদ ২০ হাজার টাকা নিয়ে গেছে কয়েকজন। এরা সবাই বাইরে থেকে আসছে। এলাকার ছেলে হলে আমার চেনার কথা। আমি ১৪ বছর বিদেশ করলেও লোকাল মানুষ দেখলে চিনতে পারি। কান্দিরপাড় এলাকার বাসিন্দা মাহবুব উদ্দিন বলেন, নিজের টাকায় বাড়ি করেছি। বাড়ি করতে চলে গেছে ৩০ লাখ টাকা। এটা হয়তো যেতো না। ঘাটে ঘাটে পয়সা। বাড়ি করার নাম নিলেই পোলাপাইন এসে হাজির হয়। আমি যখন বাড়ি করছি ওসব ছেলেদের দেখানো দোকান থেকে ইট বালি সিমেন্ট কিনতে হইছে। পরে শুনি ওসব দোকান থেকে ওরা কমিশন নেয়।
চাঁদাবাজির বিষয়ে কুমিল্লা মহানগর বিএনপি’র সভাপতি উদবাতুল বারী আবু মানবজমিনকে বলেন, এসব যারা করছে আপনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন সবাই নেশাখোর, টোকাই। দলের কেউ নয়। দলের কারও বিরুদ্ধে স্পেসিফিক অভিযোগও নেই। আমরা দলীয় প্রধানের নির্দেশে জিরো টলারেন্স অবস্থানে আছি। দলের কাউকে যদি চাঁদাবাজির সঙ্গে সম্পৃক্ততা পাওয়া যায় সাংগঠনিকভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
স্বস্তিতে অটোরিকশা চালকরা: কুমিল্লা শহরের চাঁদাবাজির সবচেয়ে বড় খাত ছিল সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ব্যাটারিচালিত অটো রিকশা। প্রায় অর্ধ লাখ সংখ্যক এই যান থেকে দিনে ১০ টাকা করে মাসে তিনশ’ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করতেন আওয়ামী লীগের নেতারা। অভিযোগ ছিল, সাবেক এমপি বাহারের ঘনিষ্ঠ নেতারা সিএনজি থেকে দিনে ১২০ টাকা আর ব্যাটারিচালিত রিকশা থেকে ১০ টাকা করে চাঁদা আদায় করতো। এ ছাড়া মাসে তিনশ’ টাকা করে টোকেন নবায়ন বাবদ আদায় করতো। কিন্তু ৫ই আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে এই অটোরিকশাচালকরা বেশ স্বস্তিতে রয়েছেন। এই খাতে কোনো ধরনের চাঁদা আদায় করতে আসেন না কেউই। ইতিমধ্যে চাঁদাদাবির অভিযোগে কয়েকজনকে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তারও করেছে।
কুমিল্লা নগরীর কান্দিরপাড় এলাকার সিএনজিস্ট্যান্ডে গিয়ে কথা হয় চালক আরিফুল হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, এই কান্দিরপাড় সিএনজিস্ট্যান্ডে হাবীব নামের একজন প্রতিদিন ১০ থেকে ২০ টাকা করে প্রতিটি অটোরিকশা থেকে চাঁদা তুলতেন। এই টাকা যেতো আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতার কাছে।
নগরীর ঈদগাহ্ এলাকার সিএনজি অটোরিকশাচালক কিরণ হোসেন জানান, ঈদগাহ্ থেকে সিএনজি ছাড়লে ৫০ টাকা, ফকিরবাজার গেলে ২০ টাকা, শংকুচাইল ছিল ২০ টাকা এবং বাগড়া সিএনজিস্ট্যান্ডে দিতে হতো ৫০ টাকা। প্রতিদিন গড়ে দেড়শ’ টাকা চাঁদা দিতে হতো। ৫ তারিখের পর থেকে আর কেউ চাঁদা নিতে আসে না। খুব ভালো লাগছে।
নগরীর জাঙ্গালিয়া বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা যায়, স্বস্তিতে যাত্রী আনা-নেয়া করছেন অটোরিকশাচালকরা। ইদ্রিস হোসেন নামে এক চালক বলেন, সিএনজিস্ট্যান্ডে আগে কতো রকমের নেতা দেখতাম। ৫ তারিখের পর সব ভাইগ্গা গেছে।
পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড এলাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে চাঁদা আদায় হচ্ছে না দাবি করে আবদুর রশীদ নামের এক সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক বলেন, ‘তারা (চাঁদাবাজরা) আমরার হকের টাকা মাইরা খাইতো। আল্লায় বিচার করছে। এডি এহন ঘরে নাই।