Image description

কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে নরসিংদী কারাগার ও ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে পালিয়ে যান ২২শ আসামি। এর মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গিও ছিলেন। একই সময় কোনো কোনো কারাগারে আগুন দিয়ে লুট করা হয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ।

কারা সূত্রে জানা যায়, সরকার পতনের পর সারাদেশের আটটি কারাগারে কয়েদি ও হাজতিরা বিদ্রোহ করেন। তখন বিভিন্ন কারাগার থেকে পালিয়ে যান ২২শ আসামি। এর মধ্যে গ্রেফতার ও আত্মসমর্পণ করেন ১৫শ জন। এখনো পলাতক ৭শ আসামি। পলাতকদের মধ্যে আছেন ৮৪ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি এবং ৯ জন জঙ্গি।

৫ আগস্টের পর এই কারাগার থেকে মোট ৮৭ জন আসামি পালিয়ে যান। এদের মধ্যে পরবর্তীসময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ৪১ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এখনো ৪৬ জন পলাতক। পলাতকদের মধ্যে দুজন রয়েছেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।- সাতক্ষীরা জেলা কারাগারের জেল সুপার মোহাম্মদ এনায়েত উল্যা

সূত্র জানায়, জঙ্গি আসামিদের মধ্যে কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার থেকে শতাধিক আসামি পালিয়ে যান। এর মধ্যে এখনো ৯ জন আসামির খোঁজ মেলেনি। গত ৬ আগস্ট সকালে কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে কয়েদিরা বিদ্রোহ করেন। তারা কারা অভ্যন্তরে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়ে ২০২ জন পালিয়ে যান। এর মধ্যে ৮৮ জন ছিলেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, কারাগার থেকে বন্দিদের পালানোর সময় অস্ত্র লুটের ঘটনাও ঘটেছিল। সেসব অস্ত্র এখনো পুরোপুরি উদ্ধার করা যায়নি। দ্রুত এবং অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে অস্ত্র উদ্ধারের ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে এসব অস্ত্র অপরাধী চক্রের সদস্যদের হাতে পড়তে পারে।

 

কারাগারগুলো থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত, যাবজ্জীবন ও বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত বন্দিসহ বিচারাধীন মামলার দুই হাজার ২শ বন্দি পালিয়ে যায়, যার মধ্যে এক হাজার ৫শ জনকে গ্রেফতারের পর ফের কারাবন্দি করা হলেও এখনো ৭শ বন্দি পলাতক।-কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন

যেসব কারাগার থেকে বন্দিরা পালান

সূত্র জানায়, কোটা আন্দোলন চলাকালে ১৯ জুলাই বিক্ষোভকারীরা নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা চালান। সেদিন কারাগারের মূল গেট ভেঙে ১০ থেকে ১২ হাজার লোক ভেতরে ঢুকে পড়ে। ওই কারাগারে যারা কয়েদখানার লকার ভাঙেন, তারা ১০-১২ জনের একেকটি গ্রুপে বিভক্ত ছিলেন। এরা কয়েদিদের মুক্ত করার পাশাপাশি ৯ জঙ্গিকে ছাড়িয়ে আনেন। এসময় কারাগারে থাকা ৮২৬ বন্দির সবাই পালান। এরপর অস্ত্রাগারে থাকা ৮৫টি অস্ত্র ও ৮ হাজার ১৫০টি গুলি লুট হয়। কয়েদখানা, রক্ষীদের ব্যারাক এবং কারা হাসপাতালে আগুন ধরিয়ে দেন বিক্ষুব্ধরা। পুড়ে যায় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন নথিপত্র।

কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মোহাম্মদ আবদুল্লাহ-আল-মামুন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই কারাগার থেকে বিদ্রোহ করে পালিয়েছিলেন ২০২ জন বন্দি। তাদের মধ্য থেকে ৫৭ জনকে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে। এখনো ১৪৫ জন পলাতক।’

নরসিংদী জেলা কারাগারের জেল সুপার শামীম ইকবাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘নরসিংদী জেলা কারাগারে বিদ্রোহের পর সব আসামি অর্থাৎ, ৮২৬ জনই পালিয়ে যান। পরবর্তীসময়ে আত্মসমর্পণ করেন ৬৪৬ জন, গ্রেফতার করা হয় ৩৫ জনকে। এখনো ১৪৫ জন পলাতক।’

 

সাতক্ষীরা জেলা কারাগারের জেল সুপার মোহাম্মদ এনায়েত উল্যা জাগো নিউজকে বলেন, ‘৫ আগস্টের পর এই কারাগার থেকে মোট ৮৭ জন আসামি পালিয়ে যান। এদের মধ্যে পরবর্তীসময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ৪১ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এখনো ৪৬ জন পলাতক। পলাতকদের মধ্যে দুজন রয়েছেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।’

কুষ্টিয়া জেলা কারাগার সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ৭ আগস্ট কুষ্টিয়া কারাগার থেকে মোট ৯৮ জন বন্দি পালান। এখন পর্যন্ত সাজাপ্রাপ্ত ২৪ জন কয়েদি অধরা।

শেরপুর জেলা কারাগারের জেলার (ভারপ্রাপ্ত) সেলিনা আক্তার রেখা জাগো নিউজকে বলেন, ‘৫ আগস্ট বিকেলে শেরপুর জেলা কারাগারে প্রধান ফটক ভেঙে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে দুর্বৃত্তরা। এ সুযোগে ৫১৮ বন্দিই পালিয়ে যান। পরে কিছু আসামি আত্মসমর্পণ করেন। তাদের জামালপুর জেলা কারাগারে রাখা হয়। ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত জামালপুর কারাগারে থাকার পর ১২ ডিসেম্বর শেরপুর জেলা কারাগার পুনরায় চালু হলে তাদের এখানে আনা হয়। এখনো ২৮০ জন পলাতক।’

এদিকে কারা সূত্র জানায়, ৫ আগস্টের পর সারাদেশের আটটি কারাগার বিদ্রোহীদের হাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কাশিপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার, নরসিংদী জেলা কারাগার, কুষ্টিয়া জেলা কারাগার, সাতক্ষীরা জেলা কারাগার ও শেরপুর জেলা কারাগার।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে পলাতক যারা

আল-আমিন (২৮), মুনতাসির আল জেমি (২৬), হুমায়ন কবির মোল্লা (৪৩), মো. বাহার (৪৩), শরীফুল ইসলাম নাঈম (২৬), শাহাদাত হোসেন (৪০), রাজু (৩২), রুবেল (৩৩), সবুজ মিয়া (৩৮), সবুজ মল্লিক (২৬), আবুল (৫১), ইদ্রিস মিয়া (৪০), মোয়াজ্জেম হোসেন (৩০), সোহাগ (৩০), মো. জাহাঙ্গীর হোসেন (৩৮), মো. আব্দুল মজিদ (৩৪), সাগর আহম্মে (৩১), মো. নাইম ওরফে মহিউদ্দিন নাইম (৩০), নাজমুল (৩২), মো. রুবেল মিয়া (৩৪), আসলাম বাবু (২৮), আব্দুল লতিফ (২৭), আবু মোকারম (৪৪), মো. তোফায়েল আহম্মেদ (৪০), মো. আমান উল্লাহ (২৫), মো. নজরুল ইসলাম (৪৮), মো. সাইফুল ইসলাম (৪০), তোফা মোল্লা (৩৬), ছোয়াব মিয়া (৪০), আব্দুল মালেক (৩২), আবদুল মতিন (২৯), আজিজুর রহমান পলাশ (৩৪), আমির হোসেন (৩০), নুরে আলম (৩০), মো. নাছির (৩৮), এমদাদুল হক ওরফে গন্ডার (৩০), জাহাঙ্গীর শওকত জুয়েল (৪৭), রিপন ঘোষ (৪৬), আব্দুল্লাহ শিকদার (২২), মফিজুর রহমান ওরফে মাহফুজ ওরফে মফিজ হাওলাদার (৩৭), রুবেল মন্ডল (২৭), মো. শামীম খান (২৭), মো. লিটন (৪৬), ওমর ফারুক (৩৬), মো. জানে আলম (৩৩), মো. সাইদুল ইসলাম (৩৪), মো. সবুজ (৩৪), আবুল হোসেন (৩৭), সোহাগ হাওলাদার (৩৩), মো. মনিরুল ইসলাম ওরফে রুবেল (২৮), মো. রাসেল মিয়া (২৭), মো. গোলাম নবী ওরফে আবু ওরফে রবি (২৬), মো. রুবেল (৩২), আনিসুর রহমান (৩৩), মো. সায়েদ ফকির ওরফে সায়েদ ওরফে সাইফুল (২৭), বাদল মিয়া (৩০), মো. এবাদুর রহমান ওরফে পুতুল (৪৪), হৃদয় ওরফে মানিক (২৮), ইসলাম মীর (৪৩), মো. সোহেল রানা (৩২), রিপন (৩৬), মো. ফিরোজ হোসেন (২৩), মো. নুর আলম মিয়া (২৭), ভাংগন মন্ডল (৩০), মো. শাহ আলম (৪০), মো. বাহাদুর মিয়া (৩৫), আমিনুল হক (৩৯), এছাহাক ওরফে সুমন হাওলাদার (৪২), মো. রাব্বী হোসেন ওরফে মনা (৩০), সোহেল (২৮), মো. সুমন জোমাদ্দার (২৭), লুকিমুদ্দিন ওরফে লোকমান (৫৪), শাহিন মল্লিক (৩৩), সাকিব ওরফে বাবু (২২), বিডিআর সদস্য সিপাহী মো. আমিনুল ইসলাম (৪০), বিডিআর সদস্য সিপাহী মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম (৩৬), বিডিআর সদস্য সিপাহী মো. ইব্রাহিম (৪১), বিডিআর সদস্য সিগন্যালম্যান মো. মনির হোসেন (৪২) এবং মজনু (৩৪)।

পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে পলাতক ৭শ বন্দির তালিকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরের ইমিগ্রেশন শাখায় দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশ, র‍্যাব ও বিজিবির কাছেও তালিকা রয়েছে। তারা গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালাচ্ছে।

সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (উন্নয়ন ও মিডিয়া) মো. জান্নাত উল ফরহাদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ইতোমধ্যে ১৫শ বন্দিকে গ্রেফতার করে কারাগারে আনা হয়েছে। বাকি আসামিদের গ্রেফতারে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালাচ্ছে।’

কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন্স) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘কারাগারগুলো থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত, যাবজ্জীবন ও বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত বন্দিসহ বিচারাধীন মামলার দুই হাজার ২শ বন্দি পালিয়ে যায়, যার মধ্যে এক হাজার ৫শ জনকে গ্রেফতারের পর ফের কারাবন্দি করা হলেও এখনো ৭শ বন্দি পলাতক। ওই সময়ে আটটি কারাগার থেকে অস্ত্র লুট হয়েছিল ৯৪টি। এর মধ্যে ৬৫টি উদ্ধার করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের ৬৯টি কারাগারের মধ্যে ১৭টি কারাগার অনেক পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘জেল থেকে পালানো ৭শ বন্দিকে এতদিনেও গ্রেফতার করা যায়নি, তার অর্থ হচ্ছে তাদের শক্তিকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। শীর্ষ পর্যায়ের আসামিরা পলাতক থাকা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা প্রশ্নে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।’

 

তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হলে কারাগারে বন্দি রাখা কঠিন হবে। অথবা যে কোনো সময় বিদ্রোহ করে কারাগার ভেঙে পালিয়ে যাওয়ার উদাহরণ তৈরি হতে পারে। এ ধরনের উদাহরণ সমাজে তৈরি হলে ভবিষ্যতে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।’