
বাকির সাজ্জাদ
এক দিনেরও কম সময়ের মধ্যে এক ভোরবেলায় নয়াদিল্লি পাকিস্তানের ছয়টি টার্গেটে হামলা করে। ইসলামাবাদও একই সময়ের মধ্যে পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান অবলীলায় উড়িয়ে দিয়ে নিজেদের শক্তির জানান দিল। এ ঘটনার পর পারমাণবিক অস্ত্রধারী এই প্রতিবেশী দেশ দুটি পরমাণু যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে।
গত ২২ এপ্রিল পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন মারা যান। ভারতের দাবি, তারা শুধু এই হামলায় জড়িত সন্ত্রাসীদের ওপরই হামলা করেছে। কিন্তু এই খোঁড়া যুক্তির পেছনে নয়াদিল্লির দুরভিসন্ধি একদম পানির মতো পরিষ্কার। নিজেকে আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে পাকিস্তানকেই সবচেয়ে বড় বাধা মনে করে নয়াদিল্লি। এ ছাড়া চলমান এই হামলার মাধ্যমে ভারত এ অঞ্চলে তার শক্তির জানান দেওয়ার পাশাপাশি এখন থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের প্রকৃতি কেমন হবে, সে সম্পর্কেও একটি বার্তা দিতে চায়।
এই হামলার পেছনে পাকিস্তানের হাত রয়েছে বলে দাবি করেছে দিল্লি। কিন্তু জনপরিসরে এই দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণই উপস্থাপন করতে পারেনি। এদিকে উত্তেজনা না বাড়াতে আন্তর্জাতিক মহলের কোনো অনুরোধেও কর্ণপাত করেনি ভারত। বরং খুব ভেবেচিন্তে সুপরিকল্পিতভাবে একটি হামলা করে। ভারতের নেতারা পাকিস্তানের সঙ্গে এখন এমন সম্পর্কই চাচ্ছেন। তারা চান ভারত যেন স্রেফ পূর্বানুমানের ভিত্তিতে বিনা উসকানিতেই পাকিস্তানের ওপর হামলা করতে ও পাকিস্তানের নাগরিকদের শাস্তি দিতে পারে। এই ব্যাপারটিকে তারা এখন নৈমিত্তিক স্বাভাবিক ঘটনা বা নিউ নর্মাল বিষয়ে পরিণত করতে চাইছেন।
চলমান হামলার বৈধতা দিতে ভারতের মিডিয়া সরকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জোরেশোরে প্রচার করতে থাকে—পাকিস্তানের ভাওয়ালপুরে ভারতের হামলায় যাদের টার্গেট করা হয়েছে তারা মাসুদ আজহারের নেতৃত্বাধীন জইশ-এ-মোহাম্মাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ভারতের মিডিয়া এটা প্রতিষ্ঠা করতে চায়—ভারত শুধু সন্ত্রাসীদেরই টার্গেট করছে।
সিঙ্গাপুরের গবেষণা প্রতিষ্ঠান এস রাজারাত্নাম স্কুলের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর পলিটিক্যাল ভায়োলেন্স অ্যান্ড টেরোরিজম রিসার্চের গবেষক আব্দুল বাসিত বলেছেন, ‘কোনো নির্ভরযোগ্য গণমাধ্যমই এখন পর্যন্ত মাসুদ আজহারের বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেনি।’
এদিকে ভারত যতটা ক্ষিপ্রতার সঙ্গে আক্রমণ করেছে, ততোধিক ক্ষিপ্রতার সঙ্গে পাকিস্তান তার জবাবও দিয়েছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যুদ্ধবিমান রাফালসহ পাঁচটি জেট বিমান পাকিস্তান যেভাবে ভূপাতিত করেছে, তা প্রতিরক্ষা যুদ্ধের একটি আদর্শ উদাহরণ হয়ে থাকবে। এর মাধ্যমে পাকিস্তান ভারতকে খুব স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে—‘তোমার প্রযুক্তি যতই শক্তিশালী হোক না কেন, কোনোটাই পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আওতার বাইরে নয়।’
দেশ দুটি যতই অস্ত্রের মহড়া দিক, তারা খুব ভালোভাবেই জানে, এ সংঘাত স্রেফ অস্ত্রের মহড়াই নয়, এ সংঘাতের মূল কারণ হচ্ছে—ভারত চায় পাকিস্তানকে দমিয়ে রাখতে, আর পাকিস্তান মোটেও ভারতের আধিপত্যকে স্বীকার করে নিতে রাজি নয়।
উভয় দেশই যতটা সম্ভব নিজ নিজ ক্ষমতার জানান দিয়েছে; কিন্তু তারা এটাও জানে, পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে উভয়কে ধ্বংসাত্মক পরিণতি বরণ করতে হবে।
দেশ দুটি যতটুকু সংযম এখন দেখাচ্ছে, তা মূলত পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়েই। পারমাণবিক অস্ত্র এক্ষেত্রে গ্রিক মিথলজির সেই ডামোক্লিজের তরবারির ভূমিকা পালন করছে।
পাকিস্তানের সাবেক প্রতিরক্ষা সচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসিফ ইয়াসিন মালিককে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, বর্তমান অবস্থায় উভয় দেশের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে? তিনি বলেছেন, যুদ্ধ যাতে পারমাণবিক অস্ত্র পর্যন্ত না গড়ায় সেজন্য কোনো পক্ষই রেডলাইন অতিক্রম করে এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না। অর্থাৎ দুপক্ষই স্থলপথে সামরিক অভিযান চালানো বা সংবেদনশীল স্থাপনাগুলোয় হামলা করা থেকে বিরত থাকবে।
সেক্ষেত্রে তারা কেবল আকাশপথ ও ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে বলে অনুমান এই ব্রিগেডিয়ারের। এখন পর্যন্ত পারমাণবিক অস্ত্রের জোরেই যুদ্ধটা কিছুটা সংযত অবস্থায় আছে। তবে এই সংযম ক্ষণস্থায়ী হতে পারে।
পাকিস্তানের স্ট্র্যাটেজিক ভিশন ইনস্টিটিউটের প্রধান ব্রিগেডিয়ার নাইম সালিক হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ভারতের হামলার প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের হামলার পর ভারত যদি আবার হামলা চালায় তা হলে পরিস্থিতি আরো বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।
তিনি বলেছেন, সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যাপার হবে যদি হামলা-পাল্টা হামলার এই প্রক্রিয়ায় ভুলবশত কোনো সংবেদনশীল টার্গেটে কেউ হামলা করে বসে। পাকিস্তান এ ভুলটি এখনো করেনি। তবে যদি সংযমের বাধ ভেঙে যায় তাহলে এর সম্পূর্ণ দায়ভার বর্তাবে ভারতের ওপর।
রাফাল যুদ্ধবিমানের ব্যর্থতা শুধু ভারতের মর্যাদাহানির ঘটনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এই ব্যর্থতা ভারতের যুদ্ধকামী একটা অংশকে আরো বেশি প্রতিশোধপরায়ণ করে তুলেছে। কিন্তু প্রতিশোধ নিতে গিয়ে আরো আক্রমণ করার অর্থ হচ্ছে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আরো বেশি প্রতিরোধের শিকার হওয়ার ঝুঁকি নেওয়া। আক্রমণ-প্রতি আক্রমণের এই ধারাটি একবার মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে জনমানসে তা পারমাণবিক যুদ্ধের আতঙ্ক ছড়িয়ে দেবে। যুদ্ধক্ষেত্রে ছোট ছোট বিজয়গুলোর একটা নেতিবাচক দিকও আছে। প্রতিটা ছোট বিজয় দুই পক্ষকে সর্বাত্মক যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
অবশ্য পর্দার পেছনে চলছে কূটনৈতিক তৎপরতা। ওয়াশিংটন, বেইজিং এমনকি কাতার ও অন্য কয়েকটি পারস্য উপসাগরীয় দেশও দফায় দফায় ভারত-পাকিস্তানে সফর করছেন, যাতে কোনোক্রমেই যুদ্ধ আর না বাড়ে। কিন্তু দেশ দুটির যে পারস্পরিক অবিশ্বাস, তা শুধু একটি ফোন কল কিংবা গোপন কূটনৈতিক তৎপরতা দিয়েই সমাধান করা সম্ভব নয়।
আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীরা সবসময়ই মঞ্চে অবতীর্ণ হন ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে। তারা এত বেশি হিসাবনিকাশ করে পদক্ষেপ নেন যে বাস্তবে এর কোনো প্রভাব প্রায় থাকে না। দিনশেষে ক্ষমতার ভারসাম্য পরিপূর্ণভাবে দিল্লি ও ইসলামাবাদের ওপরই নির্ভর করে। উভয় পক্ষের নীতি হচ্ছে, প্রথমে শক্তির মহড়া দেখাও, তারপর সাবধানে থাকো।
পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব সোহাইল মাহমুদ বলেছেন, পরিস্থিতির এতটাই অবনতি ঘটেছে যে এখান থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত কঠিন কাজ হবে। তিনি মনে করেন, বিশ্বশক্তিগুলোর উচিত আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসা। বৃহৎ শক্তিগুলো শুধু সংকটের আপাত সমাধান করলেই হবে না, সমস্যাটি কীভাবে স্থায়ীভাবে সমাধান করা যায় তারও উদ্যোগ নিতে হবে।
ভারত-পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। তারা উভয়ে শক্তি প্রদর্শন করছে, কিন্তু চূড়ান্ত সংঘাতে জড়াচ্ছে না। দুই পক্ষই চায় সুযোগমতো উপযুক্ত মুহূর্তে সম্মানজনকভাবে পিছে হটতে। তবে ইতিহাস আমাদের বলে, এরকম সুযোগের ওপর খুব বেশি ভরসা করা চলে না। হামলা-পাল্টা হামলার কোনো এক পর্যায়ে সামান্য ভুলও বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
সামনের দিনগুলোয় হয় সামরিক উত্তেজনা থেকে সরে এসে সংযমের পথ বেছে নিতে হবে, অথবা অবস্থার এত দ্রুত অবনতি ঘটবে যে তখন আর কূটনৈতিক তৎপরতা দিয়ে কোনো সমাধান করা যাবে না। একটাই পথ খোলা থাকে, আর তা হচ্ছে সংযম।
যাহোক, পাঁচটি রাফাল বিমানের ধ্বংস হওয়া ভারতের সম্মানহানির কারণ হলো; কিন্তু এই ঘটনা পশ্চিমকেও নতুন করে ভাবাবে। আমেরিকা ও তার মিত্ররা মিলে চীনের মোকাবিলায় যে একটি নিশ্ছিদ্র প্রতিরক্ষা বলয় সৃষ্টি করতে চেয়েছিল, তা এখন প্রশ্নের মুখে পড়বে।
ভারত এক দিনেই পাঁচটা বিমান হারাল। তাও আবার সরাসরি যুদ্ধে নয়, বরং নিরাপদ দূরত্বে থেকে চালানো হামলায়। সর্বাধুনিক পশ্চিমা প্রযুক্তি ব্যবহার করেও ভারত আসলে কী অর্জন করল সে বিষয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
ফ্রান্সের রাফাল বিমান অকৃতকার্য হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়তো এখন এই আশায় বুক বেঁধে আছে—এই যুদ্ধের পর ভারত যেন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া আর কোনো রাষ্ট্রের অস্ত্রের ওপর ভরসা না করে।
ওয়াশিংটনের স্টিমসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া প্রোগ্রামের অনাবাসিক ফেলো ক্রিস্টোফার ক্ল্যারি মনে করেন, এই সংঘাতে চীনের তৈরি আকাশ-থেকে-আকাশ বা ভূমি-থেকে-আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রগুলো কতটা কার্যকর, তার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখছে যুক্তরাষ্ট্র।
লেখক : পাকিস্তানের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা-বিষয়ক বিশ্লেষক
ডন থেকে ভাষান্তর করেছেন নাজমুল হাসান