Image description

রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হিসেবে কর্মরত আছেন আব্দুল আলিম। অল্প সময়ে অনেক সম্পদের মালিক এখন তিনি। ঘুসের প্রশ্নে কাউকে তিনি ছাড় দেন না। কোনো কোনো সময় ‘চেইন অব কমান্ড’ও ভঙ্গ করেন। তাকে নিয়ে রীতিমতো বিব্রত পুলিশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা। গুলশানের ডায়মন্ড ব্যবসায়ী দীলিপ আগারওয়াল ও গাড়ি আমদানিকারক আসলাম সেরনিয়াবাতকে রিমান্ডে বিশেষ সুবিধা দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন প্রাইভেট কার, ১২টি ডায়মন্ডের চেইন ও ১৭ লাখ টাকা। 

শুধু ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় নয়, তার ‘ঘুস কর্মকাণ্ড’ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানেও বিস্তৃত। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তিনি থাকছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। পুলিশের একটি বিশেষ তদন্তে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।

জানতে চাইলে পুলিশের গুলশান জোনের ডিসি তারেক মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, ইন্সপেক্টরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেবেন ডিএমপি কমিশনার স্যার। আমার এখানে কিছুই করার নেই। তার বিরুদ্ধে তদন্ত করেছে পুলিশের অন্য আরেকটি ইউনিট। ডিএমপি কমিশনার এসএম সাজ্জাত আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। পরে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অ্যাডমিন) ফারুক আহমদ যুগান্তরকে বলেন, ‘পুলিশ সপ্তাহের কারণে এ বিষয়ে কিছু করতে পারছি না। পুলিশ সপ্তাহ শেষ হলে কমিশনার স্যারের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শনিবার টেলিফোনে আব্দুল আলিম যুগান্তরকে বলেন, ‘যেসব অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে সেগুলো সঠিক নয়। এছাড়া বাড্ডা থানার মামলায় আলোচ্য ব্যক্তিদের রিমান্ডে এনে ক্যান্টনমেন্ট থানায় রাখা হয়েছিল-এটা ঠিক। তবে আমি কারও কাছ থেকে ডায়মন্ড, গাড়ি ও টাকা নেইনি। এটা ষড়যন্ত্র।’

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, আব্দুল আলিমের বাড়ি বগুড়ায়। এই পরিচয়ে পুলিশে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন তিনি। পুলিশের চেইন অব কমান্ড ভেঙে নিজের মতো চলতে শুরু করেছেন। আওয়ামী লীগ আমলে ইন্সপেক্টর পদে পদোন্নতি হলেও বৈষম্যের শিকার দাবি করে ৩০ আগস্ট ওসি হয়েছেন ক্যান্টনমেন্ট থানায়। এরপর থেকে একের পর এক অঘটন ঘটিয়েই যাচ্ছেন। ক্যান্টনমেন্ট থানার ওসি হওয়ার পর থেকে তার ধারাবাহিক ঘটনার কিছু বর্ণনা যুগান্তরের হাতে এসেছে। পুলিশের ভাষায় এসব ঘটনাকে বেআইনি কার্যক্রম হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।

আব্দুল আলিমকে নিয়ে পুলিশের বিশেষ গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রথমে কনস্টেবল পদে ভর্তি হয়ে চাকরি শুরু করে ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আউটসাইড ক্যাডেট এসআই পদে নিয়োগ লাভ করেন। তার জন্মস্থান বগুড়া জেলা হওয়ায় তিনি বিগত সরকারের সময় বৈষম্যের শিকার হয়েছেন বলে দাবি করেন। এখন তিনি নিজেকে বিএনপির লোক হিসাবে পরিচয় দিয়ে আসছেন। ক্যান্টনমেন্ট থানার ওসি হওয়ার পর থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করতে শুরু করেন। সন্ধ্যার পর তিনি প্রায়ই ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকার বাইরে থাকেন। আড্ডা দেন গুলশান বাঘা ক্লাবসহ অভিজাত হোটেলে। ইতঃপূর্বে তিনি গুলশানের ডিপ্লোম্যাটিক সিকিউরিটি বিভাগে রিজার্ভ অফিসার (আরও) ছিলেন। ওই সময় থেকে আব্দুল আলিম একটি বলয় তৈরি করেন। ক্যান্টনমেন্ট থানায় কর্মরত অফিসার ও ফোর্সদের সঙ্গে তার আচরণ পেশাদার নয়।

যেভাবে ডায়মন্ড ও গাড়ি : বিশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গুলশানের ডায়মন্ড ব্যবসায়ী দীলিপ আগারওয়াল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ও নৃশংসতায় ইন্ধন দেওয়ার অভিযোগে বাড্ডা থানায় করা একটি মামলার আসামি। বাড্ডা থানার মামলা নম্বর ০৩(১০)২৪। মামলার তদন্তকারী অফিসার এসআই সাদেক আদালতের মাধ্যমে তাকে ৩ দিনের রিমান্ডে আনেন। জুলাই অভ্যুত্থানে বাড্ডা থানা বিধ্বস্ত হওয়ায় পুলিশের গুলশান জোনের ডিসির নির্দেশনায় দীলিপ আগারওয়ালকে ক্যান্টনমেন্ট থানা হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করতে বলেন। সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তা ক্যান্টনমেন্ট থানায় আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গেলে ওসি আব্দুল আলিম বিভিন্ন কৌশলে আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। জিজ্ঞাসাবাদে বাধা দিয়ে দীলিপ আগারওয়ালের ম্যানেজার বিপ্লব সরকারের কাছ থেকে ১৭ লাখ টাকা, ১২টি ডায়মন্ডের নেকলেস, একটি ডিভান আদায় করেন। একই ভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রগতি সরণি রোডের কার সিলেকশনের মালিক আসলাম সেরনিয়াবাতকে ভয়ভীতি দেখিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন একটি প্রাইভেট কার। আসলাম সেরনিয়াবাতও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর বাড্ডা থানার দায়েরকৃত ৮(৮)২৪ মামলার আসামি। এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বাড্ডা থানার সৌমিত্র সাহা আসলাম সেরনিয়াবাতকে ৩ দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেননি। সেখানেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন ওসি আব্দুল আলিম। আদালতের মাধ্যমে ৩ দিনের রিমান্ডে আনেন এবং ক্যান্টনমেন্ট থানায় রাখেন। এভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে কৌশলে একটি রিকন্ডিশন প্রাইভেট কার হাতিয়ে নেন। (যার নম্বর ঢাকা মেট্রো-গ-১৭-৩৮৬৬)। বিষয়টি পুলিশের গোপন তদন্তের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের কাছে স্বীকার করেছেন আসলাম সেরনিয়াবাতের ভাই হাফিজ আল আসাদ। তিনি সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কাছে জানিয়েছেন ওসি আব্দুল আলিমের ব্যবহার জঘন্য এবং অপেশাদার।

ফ্ল্যাট দখলে সহযোগিতা : ক্যান্টনমেন্ট থানাধীন ইসিবি চত্বরে এ বেলাল রোডের বাসার (নং-৫৫৫/৫৫৬) একটি ফ্ল্যাট নিয়ে নিঃসন্তান এক মহিলার ভাইয়ের স্ত্রীর সঙ্গে মামলা-মোকদ্দমা চলছে। ওসি আব্দুল আলিম ক্যান্টনমেন্ট থানায় যোগ দিয়েই আদালতের আদেশ উপেক্ষা করেন। তিনি ৫ লাখ টাকা ঘুস নিয়ে জনৈক শাকিল নামের ব্যক্তিকে ওই ফ্ল্যাট দখল করে দিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আদালত ওই মহিলার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ফ্ল্যাটটি স্থিতাবস্থার আদেশ দিয়েছিলেন। এ আদেশ অমান্য করে ওসি আব্দুল আলিম বহিরাগতকে উঠিয়ে দেন। পরিবারটি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত হওয়ায় ওই মহিলার পরিবারকে ভীতির মধ্যে রেখেছেন ওসি। এমনকি ওসির বডিগার্ড কনস্টেবল সাইফুল তার স্বামী বেলালের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা এনে ওসিকে দিয়েছেন, যাতে তাদের হয়রানি করা না হয়। টাকা দেওয়ার পর পুলিশি ঝামেলা কমেছে। এর আগে কয়েকদিন পরপর ওই বাড়িতে ওসি পুলিশ পাঠাতেন। আওয়ামী লীগের লোকজনের নামে মামলা থাকলেও গ্রেফতার এড়াতে ওসি আলিমকে টাকা দিতে হয়। টাকা না দিলে অজ্ঞাতনামা মামলায় ঢুকিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করেন তিনি।

গোপন প্রতিবেদনের এক স্থানে আলিমের আচার-ব্যবহার প্রসঙ্গে বলা হয়, ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে ওসি আব্দুল আলিমের সম্পর্ক ভালো নয়। থানা এলাকায় তার উপস্থিতিও কম। এ কারণে সেবাগ্রহীতারা প্রায় সময়ই ফেরত যান। এ বিষয়ে মো. রাকিব হোসেন পুলিশ কমিশনার বরাবর একটি অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগটি এডিসি মুঈদ মোহাম্মদ রুবেল তদন্ত করেন। তদন্তে ওসি আব্দুল আলিমের বিরুদ্ধে দাখিল করা সব অভিযোগের অধিকাংশ বিষয়ে সত্যতা পাওয়া যায়।