
রাজধানীর বহুতল ভবনে থাকা রেস্টুরেন্টগুলোতে অগ্নিদুর্ঘটনা ব্যবসায়ী ও দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর কাছে এখন অনেকটাই ‘ডাল-ভাত’-এর মতো ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। একের পর এক রেস্টুরেন্ট ভবনগুলোতে দুর্ঘটনা ঘটলেও এগুলোর সংস্কার এবং অতি ঝুঁকিপূর্ণ রেস্টুরেন্ট চিহ্নিত করে তা বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশে মোট রেস্টুরেন্টের ১০ থেকে ১৫ শতাংশই অতিঝুঁকিপূর্ণ। আর ভয়াবহ দুর্ঘটনা এড়াতে এ রেস্টুরেন্টগুলো অতি দ্রুত চিহ্নিত করে বন্ধ করে দিতে হবে।
রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ রেস্টুরেন্টে গত বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনায় ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। এর ঠিক ১৪ মাসের মাথায় আবার সেই বেইলি রোডেই গত ৫ মে বহুতল ভবন ক্যাপিটাল সিরাজ সেন্টারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এবার কেউ প্রাণ না হারালেও ভিতরে আটকে পড়া ১৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। এবার বহুতল ভবনটির ভূ-গর্ভস্থ জেনারেটর রাখার কক্ষ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। আগুনে ভবনটির নিচ তলায় থাকা কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর আগে গত বছরের ২০ ডিসেম্বর উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরের লাভলীন নামের একটি রেস্টুরেন্টে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগরীর ৯৯ শতাংশ রেস্টুরেন্ট ভবনেই কোনো অগ্নি নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই। এ রেস্টুরেন্টগুলো এখন একেকটি মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ঢাকায় রেস্টুরেন্ট বিল্ডিং করা এখন ট্রেন্ড। কিন্তু এসব রেস্টুরেন্ট বেশির ভাগ যে ভবনে অবস্থিত সেখানে একমাত্র যে সিঁড়িটি থাকে সেটিও ফায়ার গ্রেডের নয়। যে ভবনগুলো অগ্নিকাণ্ডে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে সেগুলো ২০০৮ এর নীতিমালার আগে তৈরি হয়েছে। এজন্য পুরোনো ভবনগুলোকে ফায়ার স্ট্যান্ডার্ডে নিয়ে আসতে হবে। এসব রেস্টুরেন্টে নেই বিকল্প বহির্গমন পথ। যে লিফট আছে তা ছোট এবং সিঁড়িগুলোও বেশ সংকুচিত।
বেইলি রোডের ক্যাপিটাল সিরাজ সেন্টারের ১৭ তলা ভবনটিও ব্যবসায়িক ও আবাসিক কাজে ব্যবহার করা হয়। এর নিচ তলা থেকে সাত তলা পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাকি তলাগুলো আবাসিক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। একই অবস্থা নগরীর অন্য সুউচ্চ ভবনের রেস্টুরেন্টগুলোর। কিছু রেস্টুরেন্ট ভবনে আবাসিক, বাণিজ্যিক, ব্যাংকের মতো স্থাপনাও আছে। আবার কিছু ভবন পুরোটাই গড়ে উঠেছে রেস্টুরেন্ট দিয়ে। এমনই এক স্থাপনা মিরপুর ১২ নম্বরের সাফুরা টাওয়ার। উঁচু এ ভবনটিতে ডোমিনোজ, খানাস, বার্গার কিং, কেএফসি, ক্রিমসন কাপ কফি, বিগ স্মোক, পস লাউঞ্জ ও বিএফসিসহ আছে অসংখ্য রেস্টুরেন্ট।
এ রেস্টুরেন্ট ভবনটি গত বছর বেইলি রোডে আগুন লাগার পর অভিযানের কারণে কিছুদিন বন্ধ রাখা হলেও পরে আবার খুলে দেওয়া হয়। সরেজমিন গতকাল দেখা যায়, সুউচ্চ ভবনটির ওপরে যাওয়ার জন্য খুবই ছোট লিফট ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে লিফটে উঠতে মানুষকে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়। নেই জরুরি বহির্গমনের পথ। একটি সিঁড়ি ব্যবহার করা হলেও তা এতই সরু যে সেই সিঁড়ি দিয়ে কেউ নামলে আর ওপরে যাওয়ার জায়গা থাকে না। ভবনটিতে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাও চোখে পড়েনি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) সভাপতি ড. আদিল মুহাম্মদ খান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঢাকায় নিরাপদে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা চালানোর জন্য প্রয়োজন মেগা ব্যবস্থাপনা। কিন্তু এই ব্যবস্থাপনা ও এ-সংক্রান্ত জনবলের জায়গায় আমরা বেশ দুর্বল। আমাদের সেবা সংস্থাগুলোর এই মেগা ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন করার কথা। কিন্তু এই সেবা সংস্থায় জড়িতরা ভীষণভাবে ‘কম্প্রোমাইজড’। যারা হোটেল ব্যবসায়ী তারাও বিভিন্ন স্থানে ‘ম্যানেজ’ করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এসব অব্যবস্থাপনা নজরদারির জন্য দায়ী সংস্থাগুলো নিজেদের কাজ যথাযথভাবে পালন করছে না। অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে অনেক সংস্থার কর্মকর্তা আগে থেকেই ‘ম্যানেজ’ হয়ে যাচ্ছেন। যতক্ষণ পর্যন্ত না অবৈধ এসব কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে ততক্ষণ অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না। এর আগে অগ্নিদুর্ঘটনার পর সরকারের পক্ষ থেকে নিরাপত্তার জন্য বেশ কিছু গাইডলাইন মেনে চলার জন্য বলা হয়। কিন্তু ব্যবসায়ীরা সচরাচর সেগুলো মানেন না। অতি ঝুঁকিপূর্ণ রেস্টুরেন্ট ভবনগুলো চিহ্নিত করে তা বন্ধ করে দিতে হবে। আর মাঝারি ও অল্প ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো সময় দিয়ে তাদের অব্যবস্থাপনা ঠিক করার সুযোগ দিতে হবে।