
চার মাসের চিকিৎসা শেষে অনেকটা সুস্থ হয়ে দেশে ফিরেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তার এই ফিরে আসার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি নতুন এক বাঁক বদলের ইঙ্গিত দিচ্ছে। খালেদা জিয়ার সুস্থতার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে বাংলাদেশের রাজনীতির সুস্থতা।
প্রায় ৯ মাস আগে ৫ আগস্ট জনতার তাড়া খেয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে শেখ হাসিনা যখন ভারতে পালিয়ে যান, সেই মুহূর্তে খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় গৃহবন্দী ছিলেন। চিকিৎসার জন্য বারংবার বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করেও সরকারের রোষানলে পড়ে যেতে পারেননি।
আশির দশকের শুরুতে দক্ষিণ এশিয়ার এই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই দুই নারীর অভিষেক ঘটে। একজন পিতার রক্ত আরেকজনের স্বামীর রক্তের ওপর ভর করে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। উত্তরাধিকার সূত্রে তারা যখন রাজনীতিতে আসেন তখন বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১২ কোটি। ২০২৫ সালে জনসংখ্যা বেড়ে যখন প্রায় ২০ কোটির কাছাকাছি তখনো এই দুই নারী এ দেশের রাজনীতিতে সমান প্রাসঙ্গিক। খালেদা জিয়া যার প্রতিহিংসার শিকার হয়ে কারারুদ্ধ অবস্থায় মৃত্যু পথযাত্রী হয়েছিলেন, সেই শেখ হাসিনা এখন ভারতে পলাতক। বিপরীতে খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজের অবস্থান শুধু সুসংহতই করেননি। নিজেকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।
অথচ একই অবস্থান হতে পারতো শেখ হাসিনারও। যদি নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়াটা ঠিকভাবে করতে পারতেন। যদি গণতন্ত্রের চর্চাটা অব্যাহত রাখতে পারতেন। যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু রাখতেন।
গত প্রায় চল্লিশ বছরে দুই মেরুর দুই নারীর অর্জন
দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর ধরে একটানা শাসন করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এতগুলি বছর ধরেই তার রাজনৈতিক ‘প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও দক্ষতা’ নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। ইতিবাচক আলোচনা করেছেন তার পক্ষের লেখক, বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকসহ সব শ্রেণির আওয়ামী রাজনীতির অনুসারী ব্যক্তি। তারা কেউ তখন হাসিনার গণতন্ত্রের পথ থেকে চ্যুত হওয়া, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের বিরুদ্ধে একটিবারও কথা বলেননি। বরং প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া কী কী ভুল করেছেন তা নিয়ে বিস্তর আলাপ করেছেন। খালেদা জিয়ার ‘ভুলেই’ শেখ হাসিনার মসনদে থাকা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছিল—এমন আলোচনা বেশি করেছেন আওয়ামী সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা। কেউ কেউ এক কাঠি সরেস হয়ে মুখের কথায় খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত আক্রমণ পর্যন্ত করেছেন।
তবে শেখ হাসিনার শাসনকালের নেতিবাচক দিক নিয়ে আলোচনা করে আসছিল বিরোধীপক্ষ। যাদের কণ্ঠ একে একে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। মূলধারার গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান যেমন বন্ধ হয়েছিল, তেমনি ব্যক্তিপর্যায়ে শেখ হাসিনা বা সরকারবিরোধী লেখককে কারাবন্দী বা দেশছাড়া করা হয়।
যা বলছিলাম। শেখ হাসিনা কী কী ভুল করেছিলেন বা আদৌও কি কোনো ভুল করেছিলেন? সাদা চোখে অনেকেই বলছেন শেখ হাসিনার ভুলের শুরু চব্বিশের ১৪ জুলাই থেকে। সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা যখন ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে শিক্ষার্থীদের গালি দিয়েছেন, তখনই জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের সূচনা। এরপর থেকে তার নেওয়া প্রতিটি পদক্ষেপই ছিল ভুলে ভরা। পরিণতিতে ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালাতে হয় তাকে। এ সময়ে তার হুকুমে হাজার হাজার শিক্ষার্থী, শিশু, নারী পুরুষের ওপর গুলি চালানো হয়। ঝরে যায় অসংখ্য তাজা প্রাণ। পুলিশসহ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীও নিহত হন। এই পলায়নের মধ্যে দিয়ে তিনি নিজের সব ‘অর্জনকে’ বিসর্জন দিলেন। নিজের দলের নেতা-কর্মীদের আজীবনের জন্য ‘পলায়নকারী নেত্রীর কর্মী’ তকমা এঁটে দিয়ে গেলেন। ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে দেশত্যাগী হলেন।
অনেকেই তার এই ভুলগুলোকে জুলাই-আগস্ট ‘বিপ্লবকালীন ভুল’ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। কিন্তু এই ভুলের শুরুটা আসলে ২০০৮ সাল থেকে।
(বাঁয়ের ছবিতে) চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে খালেদা জিয়া পেয়েছেন ফুলেল অভ্যর্থনা, জনরোষের মুখে উড়োজাহাজযোগে ভারতে পালাতে হয় শেখ হাসিনাকে
হাসিনার ভুলের হিসাবে যাওয়ার আগে আসুন খালেদা জিয়ার কী কী ‘ভুল’ এতো দিন আলোচিত হয়েছে সেটা একটু দেখি। এবং সেগুলো ‘ভুল’ ছিল নাকি সময়ের বিচারে ‘সঠিক’ বলে প্রমাণিত হয়েছে সেটাও আলোচনা করবো।
প্রথমত, যে বিষয়টি প্রধান আলোচনায় রয়েছে, তা হলো তিনি তার আপসহীন ইমেজের কাছে আটকে গিয়েছিলেন। সে কারণে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে জেনারেল মঈন ইউ আহমেদের পক্ষ থেকে যখন তাকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় এবং বিনিময়ে তাদের (ফখরুদ্দিন–মঈন উদ্দীন) ক্ষমা করে দিতে হবে বলে দাবি করা হয়, খালেদা জিয়া তখন এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। প্রথমত তিনি এটাকে অপরাধ বলে মনে করেছেন। দেশের মানুষের কাছে দেওয়া গণতন্ত্র রক্ষার প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বেঈমানী হিসেবে দেখেছেন। খালেদা জিয়া তিন তিনবার এ প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন বলে সে সময় কানাঘুষা ছিল। এ তথ্য অবশ্য নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে ঢাকার রাজনৈতিক অঙ্গনে এটা বহুল আলোচিত।
খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় ভুল ২০০৮ সালে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশ নেওয়া। তৃতীয় ভুল ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নেওয়া। চতুর্থ ভুল ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেওয়া। পঞ্চম ভুল ২০২৪ সালের ভোটে অংশ না নেওয়া। এভাবে খালেদা জিয়ার নানা ‘ভুল’ নিয়ে আলোচনা হয়েছে গেল ১৬ বছর ধরে।
তবে তারও আগে নিজের শাসন আমলে খালেদার দুটি ভুল নিয়েও রাজনীতিতে জোর সমালোচনা আছে। ১৯৯১ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বেশ ভালোভাবেই দেশ চালিয়ে আসছিলেন। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিতে ’৯৪ সাল থেকে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর যৌথ আন্দোলনের গতিপথ ও তীব্রতা বুঝতে ব্যর্থ হন তিনি। ফলে আন্দোলনের মুখে ১৯৯৬ সালে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি বিতর্কিত নির্বাচন করতে বাধ্য হন।
সেই পার্লামেন্টে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল উপস্থাপন করে তা আইনে রূপ দেন। অথচ এই দাবি আগেই মেনে নিলে বিতর্কিত ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন করতে হতো না।
ঠিক একই ধরনের ভুল করেন ২০০৬ সালে। এ সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন তা নিয়ে আওয়ামী লীগের তীব্র আন্দোলনের মুখে পড়েন। পরিস্থিতির অবনতি হলে বিচারপতি কে এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হতে অস্বীকৃতি জানান। অথচ তাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বানানোর উদ্দেশ্যে বিচারপতিদের চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো হয়। এসময় আরেক বিচারপতি এম এ আজিজকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার চেষ্টা করা হয়। আন্দোলনের মুখে সে চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে তত্ত্বাবধায়ক প্রধানের দায়িত্ব নিতে হয়। আর তখনই ওয়ান-ইলেভেনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। ক্ষমতায় আসে সেনাশাসিত মঈন উদ্দীন-ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এই দুইবারই মাঠের পরিস্থিতি বুঝতে না পারা ছিল খালেদা জিয়ার তথ্যের ঘাটতি, যা তাকে ভুল পথে পরিচালিত করেছিল। শেষবারের ভুলের খেসারত হিসেবে খালেদা জিয়ার হাত থেকে ফসকে যায় ক্ষমতা। দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগ বাংলাদেশের মসনদ থেকে দূরে চলে যান তিনি। জেল খাটতে খাটতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসংখ্য নেতা-কর্মীর জীবনের নেমে আসে অন্ধকারের অমানিশা। গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ে। বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় হাসিনার হাত ধরে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের কাছে।
বিপরীতে হাসিনার কী কী ভুল ছিল সেটা দেখা যাক। তবে তার আগে এটা বলা প্রয়োজন, সব ভুল মানুষ ধরতে পারে না। ধরতে পারলেও শুধরে নিতে চান না। শেখ হাসিনা হয়তো নিজের ভুল ধরতে পারেননি। ধরতে পারলেও শোধরাতে চাননি। হয়তো ভেতরের স্বৈরাচারী চরিত্র তাকে গ্রাস করে ফেলেছিল। সহযোগী ও অনুগত বুদ্ধিজীবীরা শেখ হাসিনার সব ধরনের ভুলগুলোকে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড হিসেবে বৈধতা দিয়েছিলেন বলেই হয়তো ভুলের পাহাড় উঁচু হতে থাকে। ভুল আর ভুল থাকে না। অপরাধে পর্যবসিত হয়ে যায়।
বিতর্কিত ওয়ান-ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ভোটের মাধ্যমে ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় বসেন শেখ হাসিনা। তখন থেকেই নব্বইয়ের গণআন্দোলনের মাধ্যমে ফিরে আসা গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে শুরু করেন তিনি। প্রথমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করেন। পরে ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ২০১৪ সালে ক্ষমতায় টিকে থাকেন। এরপর আর ভোটের প্রয়োজন হয়নি তার। জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে গিয়ে বিচারব্যবস্থা ধ্বংস করেছেন। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করেছেন। পুলিশকে দলীয় বাহিনীতে রূপান্তর করেছেন।
দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের আড়ালে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন। বিদেশে টাকা পাচারের সহায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে দেশ-বিদেশে পরিচিতি পেয়েছেন। বিরোধী রাজনীতিকে দমন করতে গিয়ে হাজার হাজার বিরোধী নেতা-কর্মীকে গুম ও খুন করেছেন। ‘আয়নাঘরে’ প্রতিপক্ষকে বিনা বিচারে বছরের পর বছর আটকে রেখেছেন। নিজের দলের রাজনীতিকে ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিয়েছেন। দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের মূল্যহীন বানিয়ে রেখেছেন। কিছু লুটেরাকে টাকা পয়সা বানিয়ে দিতে সহযোগিতা করেছেন। নিজেও টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করেছেন।
এভাবে তার ভুলগুলো অপরাধে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে কেউ প্রশ্ন করেনি, করতে পারেনি। যারা প্রশ্ন করেছেন তাদের জেলে পুরেছেন না হলে দেশ ছাড়া করেছেন, নইলে গুম করেছেন। এসব অপরাধকে আড়াল করতে শেখ হাসিনার স্তাবকেরা তাকে ‘আয়রন লেডি’ বা ‘লৌহমানবী’ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ম্যাকিয়াভেলির শাসকের কৌশল ‘শিয়ালের মতো ধূর্ত ও সিংহের মতো সাহসী’ হিসেবে হাসিনাকে তুলে ধরেছেন। উন্নয়নের আড়ালে দুর্নীতিকে বৈধ করার কৌশলকে হাসিনাপন্থী বুদ্ধিজীবীরা সমর্থন করে গেছেন। বিপরীতে বিরোধীদের মত ‘যেকোনো উপায়ে’ দমন করাকে জায়েজ করেছেন। এ সময়ে শেখ হাসিনা কী কী অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড বা অপরাধ করেছেন তা নিয়ে কোনো সমালোচনা তারা করেননি। কিন্তু সেই অনুগতদের কেউ কেউ ক্ষমতাচ্যুতির ১০ দিনের মাথায় তাকে বখতিয়ার খিলজির অগ্রাভিযানে সেনবংশের নৃপতি লক্ষণ সেনের পলায়নের সঙ্গে তুলনা করেন; এই কৌশলকে শুধু ভুল নয় অপরাধ হিসেবে দেখছেন।
আমার মতে শেখ হাসিনার একটাই ভুল। তিনি বিরোধী মত সহ্য করতে পারতেন না। অবশ্য এটা ভুল নাকি তার ‘স্বভাব’ বলা সঠিক হবে তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। দলের সব পর্যায়ের নেতা-কর্মী-সমর্থক ও বুদ্ধিজীবী এই স্বভাবে আক্রান্ত। এই স্বভাবে আক্রান্ত হাসিনা নিজের ভুল জানার পথ বন্ধ করে দিয়ে পতনের পথ তৈরি করেছেন। হাসিনার আমলে সঠিক তথ্য পাওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। গণমাধ্যমের ওপর আস্থা হারানো মানুষ বেছে নেয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। গুজব আর সঠিক তথ্যে একাকার হয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। ভোটারবিহীন নির্বাচনের এক বিরল পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তাতে নিজের মতো আসন বণ্টনের মাধ্যমে ক্ষমতা ভোগ করার চেষ্টার করেন। এসব নির্বাচনে অংশ নেওয়া বা না নেওয়ার বিষয়ে বিএনপির সিদ্ধান্তগুলো ভুল বা সঠিক ছিল কি না তা নিয়ে পণ্ডিতবর্গ আলোচনায় মেতে উঠতে থাকেন। সেসব আলোচনার ফাঁদে পড়ে বিএনপির নেতা-কর্মী ও সমর্থক নেতা-কর্মীরাও খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্তের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠতেন। মিডিয়াগুলো শুধু বিএনপির আন্দোলনের ব্যর্থতার বয়ান তুলে ধরেছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যে ভাষায় বিএনপির আন্দোলন নিয়ে উপহাস করতেন, সেভাবেই মিডিয়াগুলো ন্যারেটিভ তৈরি করতো। তারা বিএনপির ওপর ১৬ বছর ধরে চলতে থাকা নির্যাতন, গুম, খুন, মামলা-হামলা সব কিছুকে অবজ্ঞা করে গেছে নির্লিপ্তভাবে।
ভারতের সাংবাদিক সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “এখন মোটামুটি সবাই বুঝতে পেরেছে শেখ হাসিনাকে কেন এভাবে সব ছেড়েছুড়ে দেশত্যাগী হতে হলো। কী-কী অপরাধ তিনি করেছেন যার দরুন তাকে এই শাস্তি পেতে হলো। এক-দুই করে তা লিখতে গেলে, প্রথম কারণ হবে– চূড়ান্ত ঔদ্ধত্য। অনেক দিন ধরেই কারও কোনো পরামর্শ তিনি শুনতেন না। নিজের ইচ্ছামতো চলতেন। দ্বিতীয় কারণ, নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করে গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেকগুলো গেঁথে দেওয়া, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে অন্ধ অনুগত আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত করা। তৃতীয়, বিচারবিভাগকে নিজের ও দলের সুবিধামতো চালনা করা। চতুর্থ, আইনের শাসনের অবলুপ্তি ঘটানো। পঞ্চম, দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি রোধে চরম ব্যর্থতা, যার দরুণ সর্বত্র হাহাকার সৃষ্টি হওয়া। আর ষষ্ঠতম কারণ হলো–দুর্নীতি।
শেষের এই কারণ, মানে, দুর্নীতির বহর বাংলাদেশে ভয়ঙ্কর। মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো। ছোটবেলায় ‘পুকুর চুরি’র অর্থ জেনেছিলাম। ১২ বছর ধরে বাংলাদেশে যাওয়ার সুবাদে দেখছি, পুকুর চুরি করা সে-দেশে কোনো অপরাধই নয়। তা ছিঁচকে চোরের কাজ। সমাজের মাথা যারা, সেসব রাঘব বোয়াল খালবিল, নদী, সাগর, পাহাড়, জঙ্গল সব হাপিশ করে দিচ্ছে! এক-একজনের চুরির বহর হাজার-হাজার কোটি টাকা। চুরির টাকার বেশিটাই বিদেশে পাচার হয়ে গিয়েছে। ” (সূত্র: সংবাদ প্রতিদিন)।
১৪ জুলাইয়ের ওই সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তার অফিসের পিওনও ৪০০ কোটি টাকার মালিক। মূলত এই কথা থেকেই বোধ হয় সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় তথ্য-প্রমাণ খুঁজে পেয়েছেন।
ইতিহাসে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ভুলগুলো নিয়েই শুধু আলোচনা হবে না, আলোচনা হবে তার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ে। তার প্রতিহিংসার রাজনীতি, গণতন্ত্রকে হত্যা, মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়া, একটি স্বাধীন দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে নিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা-আলোচনায় এগুলো সামনে আসবে।
যেভাবে গণতন্ত্রের ঢাল হলেন খালেদা জিয়া
ওয়ান-ইলেভেনের সময় ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা বাস্তবায়নের উদ্যোগ ভেস্তে দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। তাকে জোর করে দেশ ছাড়া করতে ব্যর্থ হয়েছিলে মঈন উদ্দীন-ফখরুদ্দিনের সরকার। তাই নিজের রাজনীতি বাঁচাতে সে সময় শেখ হাসিনাও দেশে ফিরে এসেছিলেন। খালেদা জিয়া দেশে ছিলেন বলেই গণতন্ত্র ফিরে এসেছিল। ভোট দিয়ে ওয়ান ইলেভেন সরকার সরে যায়। কিন্তু ওয়ান ইলেভেনের সুফলভোগী হাসিনা ক্ষমতায় বসেই প্রথমের নিজেদের আন্দোলনের ফসল নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেন। এরপর গত ১৬ বছর ধরে খালেদা জিয়া, বিএনপি ও পরিবারের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হন শেখ হাসিনা। হাসিনার দেওয়া কারাভোগ, বিনা চিকিৎসায় মেরে ফেলার চেষ্টার কাছেও হার মানেননি তিনি। বিদেশে চিকিৎসা সুবিধা দেওয়ার নানা শর্তের কাছে নতি শিকার করেননি বলেই তাকে দীর্ঘদিনের শারীরিক অসুস্থতা ভোগ করতে হয়েছে।
শেখ হাসিনার এত নির্যাতনের পরও বিএনপিকে ভেঙে ফেলার পরিকল্পনা সফল হয়নি। প্রায় দেড় যুগ ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির নেতা-কর্মীরা এখন হয়তো বুঝতে পারছেন খালেদা জিয়ার সেসব পদক্ষেপ ‘ভুল’ ছিল না। তিনি গণতন্ত্রের মোড়কে জেঁকে বসা এক ভয়াবহ স্বৈরশাসকের কবল থেকে দলকে রক্ষা করতে জীবনযুদ্ধ চালিয়ে গেছেন। এসময় হারিয়েছেন প্রিয় কনিষ্ঠ পুত্র আরাফাত রহমান কোকোকে। জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমানের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত থেকেছেন বছরের পর বছর। সঠিক চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত খালেদা জিয়া জীবনের শেষ সময়েও গণতন্ত্র আর সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে জেগে ছিলেন এবং আছেন। এবার যখন কিছুটা সুস্থ হয়ে ফিরে এলেন তখন তার কাছে বাংলাদেশের মানুষের ভরসা ও প্রত্যাশা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। আবারও যেন ভোট নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র না হয় সেদিকে নজর রাখার দাবি খালেদা জিয়ার কাছে এ দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের।
বিপরীতে হাসিনাও কোনো ‘ভুল’ করেননি। তিনি স্বজ্ঞানে অপরাধ করে গেছেন। তিনি দেশের গণতন্ত্র ধ্বংস করেছেন। ক্ষমতায় টিকে থাকতে সার্বভৌমত্বও বিকিয়ে দিয়েছিলেন। আর স্বজ্ঞানে ১৬ বছরে ২৮ লাখ টাকা লুট করে বিদেশ পাচার করে দিয়েছেন।
কে হারলেন কে জিতলেন?
একজন শেখ হাসিনা, দলের নেতা-কর্মীদের বিপদে ফেলে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। ম্যাকিয়াভেলির বর্ণিত শঠতা, ধূর্ততা আর মিথ্যাচার ছিল যার রাজনীতির প্রধান অস্ত্র।
আরেকজন খালেদা জিয়া, সময়ের বিচারে যার ‘ভুলগুলোই’ শুদ্ধতায় পরিণত হয়েছে। রাজনীতির খেলার মাঠে সততা সাহস প্রজ্ঞা আর ধৈর্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আবার ফিরে এসেছেন লড়াইয়ে। তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে না দেওয়া প্রতিহিংসাপরায়ণ হাসিনাকে জনরোষের মুখে পালিয়ে যেতে হয়েছে বিদেশে, আর বিদেশে থেকে চিকিৎসা নিয়ে অনেকটা সুস্থ হয়ে মাতৃভূমিতে ফিরে খালেদা জিয়া পেয়েছেন সাধারণ মানুষের অভ্যর্থনা-ভালোবাসা। এভাবেই গণতন্ত্রের মানসকন্যা, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক খালেদা জিয়ার কাছে শোচনীয়ভাবে হেরে যেতে হয়েছে ‘স্বৈরাচারী’ তকমা পাওয়া শেখ হাসিনাকে।