Image description
বিমানবন্দর থেকে গুলশানে জনস্রোত : হাস্যোজ্জ্বল চেহারা ও হাঁটতে দেখে উচ্ছ¡সিত-উজ্জীবিত নেতাকর্মীরা

যুক্তরাজ্যে লন্ডনে উন্নত চিকিৎসা শেষে চার মাস পর দেশে ফিরেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। চার মাস আগে যখন তিনি চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা গুঞ্জন ও গুজব ছড়িয়েছিল, জুজুর ভয় দেখানো হয়েছিল সেই পুরনো মাইনাস ফর্মূলার। অথচ সব কিছুকে উড়িয়ে দিয়ে বরং রাজসিক প্রত্যাবর্তন করলেন বেগম জিয়া। একই সঙ্গে তার প্রত্যাবর্তনকেও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, সা¤প্রতিক সময়ে নতুন সরকারের নির্বাচনের প্রতিশ্রæতি নিয়ে কিছুটা সন্দেহ ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলেছে, বিভিন্ন খাতে সংস্কারের অগ্রগতির ওপর নির্ভর করে নির্বাচন হয় ডিসেম্বরেই, না হলে আগামী বছরের জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। এই পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার দেশে ফেরাকে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। এছাড়া বেগম জিয়াকে অভ্যর্থনা জানাতে বিমানবন্দর থেকে গুলশানের বাসভবন ফিরোজা পর্যন্ত লাখ লাখ মানুষের ¯্রােত, দীর্ঘ ১৪ ঘণ্টার যাত্রার পরও ক্লানিহীন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর হাস্যজ্বোল চেহারা এবং ফিরোজাতে পৌঁছানোর পর হেঁটে প্রবেশ করাকে খালেদা জিয়ার প্রচÐ মানসিক শক্তি, আত্মবিশ্বাসী এবং বিশেষ বার্তা বলেও মনে করছেন রাজনীতি সচেতন মহল। তারা বলছেন, বেগম জিয়ার এই রাজসিক প্রত্যাবর্তন দেশের গণতন্ত্র, রাজনীতি ও নির্বাচন ইস্যুতে ভিন্ন মাত্রা যোগ করবে।

এর আগে কাতারের আমিরের পাঠানো রাজকীয় এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে লন্ডন থেকে যাত্রা করে গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌঁছান বেগম খালেদা জিয়া। এসময় তার সঙ্গে ছিলেন দুই পুত্রবধূ- বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সহধর্মিনী ডা. জুবাইদা রহমান, মরহুম আরাফাত রহমান কোকোর সহধর্মিনী সৈয়দা শার্মিলা রহমান, মেডিকেল বোর্ডের প্রধান শাহাবুদ্দিন তালুকদার, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য প্রফেসর ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ড. এনামুল হক চৌধুরী, লন্ডন বিএনপির সভাপতি এম এ মালেক, সাধারণ সম্পাদক কয়ছর এম আহমেদসহ কয়েকজন।

এয়ার অ্যাম্বুলেন্স থেকে হুইল চেয়ারে করে বেগম জিয়াকে আনা হয়। বের হওয়ার পথে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলীয় প্রধানকে ভুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। এসময় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, প্রফেসর ড. মোর্শেদ হাসান খান, মীর সরফত আলী সপু, নজরুল ইসলাম আজাদ, যুবদল সভাপতি মোনায়েম মুন্না, সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন, ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছিরসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। বেগম জিয়াকে নেতৃবৃন্দ সালাম বিনিময় করেন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী নেতৃবৃন্দের সাথে কুশল বিনিময় করেন। এসময় বিএনপি প্রধান ছিলেন হাস্যজ্বোল। বেলা ১১টা ২০ মিনিটে তিনি বিমানবন্দর থেকে গুলশানের বাসভবন ফিরোজার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।

বিমানবন্দর-গুলশান সড়কে জন¯্রােত: বেগম খালেদা জিয়াকে বহনকারী এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটি সকাল সাড়ে ১০টায় অবতরণের কথা থাকলেও দলটির নেতাকর্মী, সমর্থক ও সাধারণ মানুষ সকাল থেকেই বিমানবন্দর থেকে গুলশানের বাসভবন ফিরোজা পর্যন্ত সড়কে জড়ো হতে থাকেন। দলীয় নির্দেশনা অনুযায়ী নেতাকর্মীরা মূল সড়ক ছেড়ে ফুটপাথের উপর দাঁড়িয়ে ¯েøাগান দিতে থাকেন। প্রচÐ রোদ ও গরমেও নেতাকর্মীরা ছিলেন উচ্ছ¡সিত ও উজ্জীবিত। বেলা সোয়া ১১টায় খালেদা জিয়াকে বহনকারী সাদা রঙের পাজেরো জিপটি যখন বিমানবন্দর থেকে বের হয় তখন পুরো সড়ক জুড়েই ছিল লোকে লোকারণ্য। তাদের হাতে ছিল জাতীয় ও দলীয় পতাকা, কণ্ঠে ছিল গগণবিদারী আওয়াজ- ‘খালেদা জিয়ার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’, ‘খালেদা, জিয়া’, ‘তারেক, রহমান’, ‘খালেদা জিয়া ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’ইত্যাদি ¯েøাগান। লাখ লাখ মানুষের এই জন¯্রােতের কারণে গাড়িবহর ধীরে ধীরে এগোতে থাকে। তাকে বহনকারী গাড়ি খিলক্ষেত, কুর্মিটোলা, নৌসদর দপ্তর হয়ে ফিরোজায় পৌঁছায় দুপুর ১টা ২৫ মিনিটে। প্রায় দশ কিলোমিটার পথে দেখা গেছে খালেদা জিয়ার হাস্যোজ্বল চেহারা। নেতাকর্মীদের অভ্যর্থনার জবাব গাড়ী থেকে হাত নেড়ে নেড়ে দেন বিএনপি নেত্রী। বিএনপি নেত্রী সাধারণত গাড়ির সামনে না বসলেও এদিন তাকে সেখানে আসন নিতে দেখা গেছে। পেছনের আসনে বসেন তার দুই পুত্রবধূ ডা. জুবাইদা রহমান ও সৈয়দা শার্মিলা রহমান সিঁথি। পথে বিভিন্ন স্থানে নেতাকর্মীরা তাদের বহনকারী গাড়ীতে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে স্বাগত জানান। দলীয় নেতাকর্মী ও উৎসুক জনতার উপচেপড়া ভিড়ে রাজধানী পরিণত হয় উৎসবের নগরীতে। লাখ লাখ মানুষের ভীড় ও গাড়ীর গতি কম থাকায় বনানীতে পূর্ব নির্ধারিত রুট পরিবর্তন করে বিকল্প সড়কে গুলশানে পৌঁছান খালেদা জিয়া।

বাসভবন ফিরোজায় খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানান তার মেজ বোন সেলিমা ইসলাম, ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার, শামীমের স্ত্রী কানিজ ফাতেমা, জুবাইদা রহমানের বড় বোন শাহীনা জামান বিন্দু এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা। এছাড়া বিএনপি নেত্রীর মেডিকেল বোর্ডের সদস্য এফএম সিদ্দিক, বিএনপি নেতা লুৎফুজ্জামান বাবর, মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাস, সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদ ছিলেন সেখানে। খালেদা জিয়ার জন্য গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কে ‘ফিরোজা’আগেই পুরোপুরি প্রস্তুত করার কথা জানিয়েছে বিএনপি। গতকাল বিমানবন্দর থেকে গুলশান সড়কের পুরোটা জুড়েই সকাল থেকেই বিপুল সংখ্যক সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যকে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়। এছাড়া ফিরোজায় ও তার সামনের সড়কে সেনাবাহিনী, বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশ সদস্যদের কড়া নিরাপত্তা দেখা গেছে।

হেঁটে ফিরোজায় প্রবেশ: খালেদা জিয়ার গাড়ী বাসভবনের ভেতরে প্রবেশ করার পর তিনি গাড়ী থেকে নেমে হেঁটে বাসায় প্রবেশ করেন। দীর্ঘদিন পর দলীয় প্রধানকে হাঁটতে দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন নেতাকর্মীরা। দীর্ঘদিন ধরে নানান শারীরিক জটিলতায় ভুগতে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে জনসমক্ষে সাধারণত হুইলচেয়ারে দেখা গেলেও মঙ্গলবার ছিল এক ভিন্ন চিত্র। মুহূর্তটি বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে আবেগের সৃষ্টি করে। অনেকেই বলছেন, খালেদা জিয়ার পায়ে হেঁটে বাসায় প্রবেশ শুধু তার শারীরিক উন্নতির প্রতীক নয়, বরং একটি আত্মবিশ্বাসী প্রত্যাবর্তনের বার্তাও হতে পারে। বিএনপির একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা বলেন, ‘ম্যাডাম আজ নিজে হেঁটে ফিরোজায় ঢুকেছেন, এটাই আমাদের কাছে অনেক বড় প্রেরণা। তিনি লড়াকু ছিলেন, আছেন, থাকবেন।’

৭৯ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন থেকে লিভার সিরোসিস, কিডনি, হার্ট, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিসসহ নানা শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছেন। তিনি উন্নত চিকিৎসার জন্য কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির পাঠানো রাজকীয় বহরের বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্স করে গত ৭ জানুয়ারি লন্ডনের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়েন। ৮ জানুয়ারি লন্ডন ক্লিনিকের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক প্যাট্রিক কেনেডি ও অধ্যাপক জেনিফার ক্রসের তত্ত¡াবধানে চিকিৎসাধীন ছিলেন খালেদা জিয়া। টানা ১৭ দিন ক্লিনিকে চিকিৎসা নিয়ে ২৫ জানুয়ারি থেকে বড় ছেলে তারেক রহমানের বাসায় ওঠেন তিনি। চিকিৎসকের পরামর্শে দেশে ফেরার শেষ সময় পর্যন্ত তিনি ছেলের বাসায়ই ছিলেন। শারীরিকভাবে সুস্থতা বোধ করায় চার মাস পর চিকিৎসকের পরামর্শে দেশের ফেরার সিদ্ধান্ত নেন বিএনপির চেয়ারপারসন। কাতারের আমিরের পাঠানো এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে স্থানীয় সময় সোমবার বিকাল ৪টা ২০ মিনিটে রওয়ানা হন খালেদা জিয়া। সেখানে ছেলে তারেক রহমান ও নাতনি জায়মা রহমান আবেগঘন পরিবেশে তাকে বিদায় জানান। ২০০৮ সালে জরুরি অবস্থার সময়ে দেশ ছাড়ার পর থেকে লন্ডনেই আছেন তারেক রহমান এবং তার স্ত্রী জুবাইদা রহমান। ১৭ বছর পর শাশুড়ির সঙ্গে দেশে ফিরলেন জুবাইদা; তবে তারেক রহমান কবে ফিরবেন- তা এখনো নিশ্চিত নয়। ছেলেকে দেখিয়ে বিমানবন্দরে উপস্থিত বিএনপি কর্মীদের উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেন, ‘ভাইয়াকে দেখে রেখো।’
বিশেষত, খালেদা জিয়ার পুত্রবধূ দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমানের দীর্ঘ ১৭ বছর পর দেশে ফেরার খবর ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। জুবাইদার এ প্রত্যাবর্তনে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে অন্যরকম চাঙাভাব বিরাজ করছে।