
আওয়ামী সরকারের পতনের পর বিদেশে পাচার বিপুল সম্পদ দেশে ফেরাতে তৎপর হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এজন্য টাস্কফোর্স গঠনের পর মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। বিদেশে কার কত অবৈধ সম্পদ রয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত, হস্তান্তর রোধের পাশাপাশি এসব সম্পদ দেশে করা হচ্ছে অবরুদ্ধ (ফ্রিজ)।
এরই মধ্যে দুদকের আবেদনে সাবেক মন্ত্রী-এমপি, সুবিধাভোগী আমলা ও ব্যবসায়ীদের সম্পদ ফ্রিজের আদেশ দিয়েছেন ঢাকার বিচারিক আদালত। জব্দের আদেশ নিয়ে অভিযুক্তদের সজাগ করতে বাইরের বিভিন্ন দেশে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) চিঠি দিয়েছে সরকার। জবাব মিলেছে অনেক দেশ থেকেও। তবে দেশে সম্পদ জব্দের আদেশ হলেও তা কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। বিদেশে কারও কোনো সম্পদ জব্দ বা অবরুদ্ধের ঘটনা ঘটেনি। অভিযুক্তরা সেই সম্পদ ব্যবহার ও স্থানান্তর অব্যাহত রেখেছেন বলেও জানা গেছে।
গত বছরের ডিসেম্বরে অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র কমিটি তাদের যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে বলা হয়েছে—গত সাড়ে ১৫ বছরে শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশ থেকে ২৮ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। গত ১১ এপ্রিল চট্টগ্রামে বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানান, গত সরকারের ১৫ বছরে দেশে কয়েকটি পরিবার ও গোষ্ঠী আড়াই থেকে ৩ লাখ কোটি টাকা পাচার করেছে। সম্প্রতি দুদকের অনুসন্ধানেও উঠে এসেছে দেশের বাইরে বিপুল পরিমাণ সম্পদ পাচারের তথ্য।
সম্পদ পাচারের এই তালিকায় রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, বোন শেখ রেহানা, কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, ভাগনে রাদওয়ান মুজিব ববি, ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিক, আজমিনা সিদ্দিকসহ আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় শতাধিক মন্ত্রী-এমপি-আমলা ও ব্যবসায়ী গ্রুপ।
এদিকে শিগগির ১০-১২টি দেশের সঙ্গে চুক্তি হচ্ছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারা বলছে, চুক্তি হয়ে গেলে চলতি বছরের ডিসেম্বরেই পাচার কিছু সম্পদ দেশে ফেরানো সম্ভব হবে। আর দুদক মহাপরিচালক বলেছেন, ‘বিদেশের সম্পদ জব্দের আদেশ বাস্তবায়নে একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।’ আর দেশের আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশের আদালতে সম্পদ জব্দের আদেশ হলেই বিদেশে জব্দ করা যায় না। কারণ, বিদেশেও মামলা জিততে হবে। তারপর সম্পদ জব্দ বা দেশে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
গত বছরের ১৭ অক্টোবর দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার স্ত্রী রুকমিলা জামানের নামে বিদেশে থাকা ৫৮০টি সম্পদ জব্দের আদেশ দেন ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ জাকির হোসেন গালিবের আদালত। দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে সাইফুজ্জামানের জব্দ এসব সম্পদের মধ্যে যুক্তরাজ্যে ৩৪৩টি, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২২৮টি এবং যুক্তরাষ্ট্রে ৯টি বাড়ি রয়েছে। এসব সম্পদের মূল্য কয়েক হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া সাবেক প্রভাবশালী এ মন্ত্রীর নামে সংযুক্ত আরব আমিরাতে দুটি ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হয়েছে। বিদেশের এসব সম্পদ জব্দের জন্য যুক্তরাজ্যের এইচএম ল্যান্ড রেজিস্ট্রি, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই ল্যান্ড ডিপার্টমেন্ট ও যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট রেজিস্ট্রার এবং ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের ক্ষেত্রে দুবাই ইসলামিক ব্যাংক, ফার্স্ট আবুধাবি ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছেন আদালত।
এ ছাড়া গত ১০ মার্চ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা এবং বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানের পরিবারের নামে বিদেশে থাকা সম্পদ চিহ্নিত করে আদালতে জব্দের আবেদন করে দুদক। এর মধ্যে সালমানের ছেলে আহমেদ সায়ান ফজলুর রহমানের লন্ডনে থাকা দুটি বাড়ি ও তার ভাতিজা আহমেদ শাহরিয়ার রহমানের নামে দুবাইয়ের দুটি ব্যাংক হিসাব এবং আরআর ট্রেডিং কোম্পানির শেয়ার অবরুদ্ধের আদেশ দেন আদালত। দুদকের উপপরিচালক মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন এসব সম্পদ জব্দের আবেদনসহ দেশে ফেরানোর জন্য কাজ করছেন।
গত ৩ ডিসেম্বর একই আদালত দেশের একটি শিল্প গ্রুপের পরিবারের ৮ সদস্যের নামে সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত, স্লোভাকিয়া, সাইপ্রাস, সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে থাকা অর্থ-সম্পদ অবরুদ্ধ ও ক্রোকের আদেশ দেন। গত ২২ জানুয়ারি আরেক আদেশে পদ্মা ব্যাংকের (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) সাবেক চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফতের নামে দুবাইয়ে একাধিক ফ্ল্যাট ও ভিলা ক্রোকের আদেশ দেন একই আদালত। এ ছাড়া দেশের একটি বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর বিদেশে থাকা বিপুল সম্পদ অবরুদ্ধ করা হয়েছে। দুদক সূত্রে জানা গেছে, সরকার পতনের পর থেকে গত মার্চ পর্যন্ত বিদেশে থাকা অন্তত ১৬৫ কোটি ৬১ লাখ ৬৫ হাজার ৪৯৭ টাকার সম্পদ অবরুদ্ধের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
গত রোববার দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. জাকির হোসেন গালিব লুক্সেমবার্গে সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজিজ খান ও তার পরিবারের অন্য সদস্যদের নামে থাকা কোম্পানিতে শেয়ার অবরুদ্ধের আদেশ দিয়েছেন আদালত। বিদেশে এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা সম্পদের মূল্য ৪১ লাখ ১৫ হাজার ৪১২ ইউরো, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫৬ কোটি ৬৫ লাখ ৬৮ হাজার টাকা।
পাচার সম্পদ যেভাবে ফিরবে দেশে
২০১২ সালে প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি টাকা পাচার সম্পদ সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত আনে দুদক। আদালতের আদেশের পর বিদেশে মামলা শেষে পাচার করা অর্থ দুদকের মাধ্যমে ফেরত আনা এটিই দেশের প্রথম ঘটনা। ওই ঘটনার মতোই দেশে ফেরানো হবে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিসহ ব্যবসায়ীদের অবৈধ সম্পদ, বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে, দুদক সূত্র জানায়, গত ১ অক্টোবর পর্যন্ত বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে ৭১টি দেশে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠিয়েছে দুদক। এর মধ্যে ২৭টি দেশ থেকে এমএলএআর জবাব পেয়েছে সংস্থাটি। এ ছাড়া চলতি বছর বিদেশের অনেকের সম্পদ দেশে ফিরিয়ে আনতে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর বলেন, ‘বিদেশের সম্পদ দেশে ফেরানো এটি একটি দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া। কাজটি করা হয়ে থাকে এমএলএআরের মাধ্যমে। আদালত থেকে সম্পদ জব্দের আদেশ নিয়ে এমএলএআর চিঠির জন্য আমাদের দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো হয়। সেখান থেকে অ্যাটর্নি জেনারেলের মতামত হয়ে যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এরপর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে চুক্তিভুক্ত যে দেশে অপরাধীদের সম্পদ আছে, দূতাবাসের মাধ্যমে সেই দেশের দায়িত্বশীল আইনি সংস্থার কাছে এমএলএআর চিঠি পাঠাই। মূলত দেশের জব্দের আদেশ নিয়ে বিদেশে অপরাধীদের বিষয়ে সজাগ করতেই এ চিঠি দেওয়া হয়। এরপর আমাদের দেশে মামলার রায়ে দুর্নীতির প্রমাণ হলে অপরাধীদের বিষয়ে বিদেশে পাঠানো হয়। পরে বিদেশের আদালতে মামলা জিতে সম্পদ বিক্রি করে হোক বা ক্রোক করে হোক, ওই দেশের আইনানুসারে সম্পদ দেশে ফেরানো হবে। সরাসরি ওই দেশের দায়িত্বশীল সংস্থা সম্পদ ফ্রিজ এবং সেগুলো বিক্রি করে দেশে ফেরত পাঠানোর কাজ করে।’
এ বিষয়ে দুদক মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন গণমাধ্যমকে জানান, বিদেশে থাকা অর্থ-সম্পদ অবরুদ্ধ ও জব্দের আদেশ বাস্তবায়নে একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। অবরুদ্ধ ও জব্দের আদেশ দুদকে এলে দুদকের অনুসন্ধানকারী বা তদন্তকারী কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট দেশে এমএলএআর পাঠান। এমএলএআর একটি রাষ্ট্রের কাছে আরেকটি রাষ্ট্রের আইনি সহায়তা চাওয়ার প্রক্রিয়া। এ ক্ষেত্রে এটি প্রথমে আমাদের দেশের এমএলএআরের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়। এই কর্তৃপক্ষ বর্তমানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আগে ছিল অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়। তবে বর্তমানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এমএলএআরটির বিষয়ে মতামত চেয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে পাঠায়। অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় এমএলএআরের যৌক্তিকতা বিবেচনার পক্ষে মতামত দিলে সেটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এমএলএআরটি সংশ্লিষ্ট দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসে পাঠায়। দূতাবাস সেটি সংশ্লিষ্ট দেশের এমএলএআরের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠায়। পরে সংশ্লিষ্ট দেশের আইন বিভাগের মাধ্যমে বিষয়টি সেই দেশের উপযুক্ত আদালতে উপস্থাপন করা হয়। সেই আদালত সে দেশের আইন ও বিধিবিধান অনুসারে সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন। সবকিছু ইতিবাচক থাকলে সংশ্লিষ্ট দেশের আদালতের মাধ্যমে বিদেশে থাকা বাংলাদেশের দুর্নীতি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অর্থ-সম্পদ অবরুদ্ধ হবে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেছেন, ‘বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরাতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তির জন্য আলোচনা চলমান রয়েছে। শিগগির ১০-১২টি দেশের সঙ্গে চুক্তি হবে। চুক্তি হয়ে গেলে সংশ্লিষ্ট দেশের আইনানুসারে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে পাচারের কিছু অংশ দেশে ফিরবে বলে আমরা আশাবাদী।’
পাচারের অর্থ ফেরাতে টাস্কফোর্স পুনর্গঠন
বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ দেশে ফেরত আনা এবং ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্স নতুন করে সাজানো হয়েছে। এতদিন টাস্কফোর্সের আহ্বায়ক ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল। তবে প্রথমবারের মতো এ টাস্কফোর্সের সভাপতি করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে। পুনর্গঠিত টাস্কফোর্সে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, আইন ও বিচার বিভাগ, দুদক, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে একজন করে প্রতিনিধি রয়েছেন।
এ টাস্কফোর্সের কাজগুলো হলো—বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ বা সম্পদ চিহ্নিত করা; পাচার করা সম্পদ উদ্ধারে হওয়া মামলাগুলোর কার্যক্রম দ্রুত নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করা এবং তা দূর করার উদ্যোগ নেওয়া; বিদেশে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া; জব্দ বা উদ্ধার সম্পদের ব্যবস্থাপনার জন্য উদ্যোগ নেওয়া; এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশি বিদেশি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ ও তথ্য আহরণ এবং পাচার করা সম্পদ উদ্ধারে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ সমন্বয় সাধন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর জাকির হোসেন চৌধুরী টাস্কফোর্সের কাজ সমন্বয় করবেন। আর টাস্কফোর্সকে সাচিবিক সহায়তা দেবে বিএফআইইউ।