Image description
সুস্থ হয়ে ঢাকায় খালেদা জিয়া

লন্ডনে উন্নত চিকিৎসা শেষে চার মাস পর গতকাল মঙ্গলবার দেশে ফিরেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। লিভার সিরোসিস, কিডনি, হৃদরোগসহ নানা জটিলতায় আক্রান্ত সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী শারীরিকভাবে মোটামুটি স্থিতিশীল হওয়ায় দেশে ফিরেছেন। আগামীতে রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন কি না, সেটা নিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গনেও এক ধরনের কৌতূহল রয়েছে। বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, দেশে ফিরলেও খালেদা জিয়া দলীয় রাজনীতিতে সরাসরি সক্রিয় হবেন না। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে তারেক রহমানই আগের মতো দল পরিচালনা করবেন। বয়স ও স্বাস্থ্যগত কারণে রাজপথে না থাকলেও দলের প্রয়োজনে ভূমিকা রাখবেন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

বিএনপি নেতারা বলছেন, খালেদা জিয়া বর্তমানে দলের চেয়ারপারসন। সুতরাং তিনি দেশে থাকা মানেই রাজনীতিতে থাকা। তিনি এখন বিএনপির রাজনীতির অভিভাবক। নেতাকর্মীদের প্রত্যাশা, বেগম জিয়ার সুস্থতা অব্যাহত থাকবে এবং তিনি আবার গণতন্ত্র ও রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেবেন।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যান। তবে বিএনপির দাবি, মিথ্যা মামলায় অন্যায়ভাবে তাকে সাজা দেওয়া হয়েছে। তিনি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর ওইদিনই দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন তারেক রহমান।

করোনা মহামারির সময় পরিবারের আবেদনে তৎকালীন আওয়ামী সরকার নির্বাহী আদেশে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ শর্তসাপেক্ষে খালেদা জিয়াকে সাময়িক মুক্তি দেয়। কারামুক্তির পর গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় ওঠেন তিনি। তবে দীর্ঘ অসুস্থতা এবং আইনি বাধ্যবাধকতায় তখন থেকেই রাজনীতিতে আর সেভাবে সক্রিয় নন বেগম জিয়া। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কিছুদিন পরপর ফিরোজায় গিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেও অন্য নেতাদের সে সুযোগ ছিল সীমিত। স্থায়ী কমিটির সদস্যরা মূলত দুই ঈদে ফিরোজায় গিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন। তখন ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়ের পাশাপাশি তাদের মধ্যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনাও হতো। অবশ্য ওই সময় রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকলেও কোনো পরামর্শ বা নির্দেশনা থাকলে, মহাসচিবকে ডেকে তা বলতেন।

গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রপতির এক আদেশে মুক্তি পান খালেদা জিয়া। পরবর্তী সময়ে দুর্নীতির যে দুটি মামলায় তিনি কারাবন্দি ছিলেন, সেগুলোর রায় বাতিল করেন আদালত।

মুক্তির পর খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রক্রিয়া নতুন করে শুরু হয়। গত ৮ জানুয়ারি কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির পাঠানো বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে লন্ডন যান তিনি। হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে সরাসরি দ্য লন্ডন ক্লিনিকে ভর্তি হন। টানা ১৭ দিন লন্ডন ক্লিনিকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. প্যাট্রিক কেনেডি ও অধ্যাপক ডা. জেনিফার ক্রসের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। পরে ২৫ জানুয়ারি থেকে খালেদা জিয়া তার বড় ছেলে তারেক রহমানের বাসায় থেকে চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নেন। শারীরিকভাবে স্থিতিশীল হওয়ায় চিকিৎসকরা তাকে দেশে ফেরার অনুমতি দেন। পরে কাতার আমিরের পাঠানো সেই বিশেষ বিমানেই গতকাল দুপুরে দেশে ফেরেন খালেদা জিয়া।

বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থা প্রসঙ্গে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ম্যাডাম অনেকটা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে লন্ডন থেকে ফেরত এসেছেন। চিকিৎসা-পরবর্তী সময়ে উনার শারীরিক অবস্থা আলহামদুলিল্লাহ, অনেকটুকু উনি সুস্থ আছেন। মানসিকভাবেও উনি স্ট্যাবেল (স্থিতিশীল) আছেন।

বিএনপির নেতাকর্মীদের প্রত্যাশা, রাজনীতিতে খালেদা জিয়া আবার সক্রিয় হবেন। দেশে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে তিনি তার ভূমিকা রাখবেন। রাজপথে থেকে না হলেও নিকট অতীতের মতো আগামীতেও দলকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ বা নির্দেশনা দেবেন। দলটির একাধিক দায়িত্বশীল নেতা জানান, শারীরিকভাবে সুস্থ থাকলে আগামী দিনে প্রয়োজনে দলীয় গুরুত্বপূর্ণ কিছু কর্মসূচিতে খালেদা জিয়ার উপস্থিতি দেখা যেতে পারে। সরাসরি না হলেও সেখানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হতে পারেন। এ প্রসঙ্গে বিএনপি নেতারা বলছেন, গত ৭ আগস্ট নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশে এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন। দীর্ঘদিন পর দলের চেয়ারপারসনকে পেয়ে নেতাকর্মীরা ব্যাপকভাবে চাঙ্গা হয়ে ওঠেন।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আবদুস সালাম আজাদ কালবেলাকে বলেন, আমরা আশা করতে পারি, আল্লাহ যদি নেত্রীর স্বাস্থ্য ভালো রাখেন, তিনি গণতন্ত্র ও রাজনীতিতে আবারও নেতৃত্ব দেবেন।

দলের গণশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ও মিডিয়া সেলের সদস্য অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান কালবেলাকে বলেন, খালেদা জিয়ার ফেরায় দলীয় নেতাকর্মী এবং সাধারণ মানুষ খুবই আনন্দিত। আমরা মনে করি, খালেদা জিয়া দেশে ফেরায় গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা আর কেউ রুদ্ধ করতে পারবে না। স্বাভাবিকভাবেই দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা যে, খালেদা জিয়া রাজনীতিতে আবারও সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব দেবেন।

যা বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা:

বিদেশে চিকিৎসা শেষে খালেদা জিয়ার আগমনে দেশের গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ আরও সুগম হবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, নির্বাচন ছাড়া তো গণতন্ত্র হয় না। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা, জটিলতা তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার উপস্থিতি সংকট উত্তরণে সহায়ক হবে। কারণ, তিনি একজন মোটামুটি সর্বজনগ্রহণযোগ্য ও শ্রদ্ধেয় নেত্রী এবং গণতন্ত্রের জন্য তার দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম রয়েছে। সুতরাং তার আগমনের ফলে জাতীয় নির্বাচনের দাবিটা আরও জোরালো হবে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যুতে সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কয়েক মাস ধরে এক ধরনের মতবিরোধ, জটিলতা তৈরি হয়েছে। নির্বাচনও একটু বিলম্বিত হচ্ছে এবং নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও এক ধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। আমরা মনে করি, এমন পরিস্থিতিতে জটিলতা নিরসন এবং বাংলাদেশকে ঐক্যবদ্ধ করতে তার মতো একজন অভিজ্ঞ নেত্রীর দেশে উপস্থিতিটাই অনেক বেশি ভূমিকা রাখতে পারবে। সব মিলিয়ে এ সময় দেশে তার আগমনটা প্রয়োজন ছিল। তিনি সেই প্রয়োজনটা বুঝতে পেরেছেন এবং স্বাস্থ্যগত অনেক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও তিনি দেশে এসেছেন।

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সাহাবুল হক বলেন, খালেদা জিয়ার দেশব্যাপী একটা গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। তা ছাড়া এ দেশে গণতন্ত্রের জন্য তার দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম ও ভূমিকা রয়েছে। তাই উনি শুধু বিএনপি নয়, অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষের কাছে একজন গ্রহণযোগ্য ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি।