
পুরান ঢাকার নিমতলী থেকে বেইলি রোড। বারবার ট্র্যাজেডি আসে। মৃত্যু আর আহাজারিতে ভারি হয় বাতাস। অগ্নিদুর্ঘটনার পর সরকারি সংস্থাগুলো কিছুটা নড়েচড়ে বসলেও টনক নড়েনি রেস্টুরেন্ট মালিকদের। রাজধানীর রেস্টুরেন্টগুলো এখনো অগ্নিঝুঁকিমুক্ত হয়নি। এর সবশেষ প্রমাণ গত সোমবার বেইলি রোডে ক্যাপিটাল সিরাজ সেন্টার শপিংমলে অগ্নিকাণ্ড। অল্পের জন্য বেঁচে গেছে বহু প্রাণ। ফায়ার সার্ভিসের সবশেষ হিসাব বলছে, রাজধানীর ৭০ শতাংশ রেস্টুরেন্ট অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। অধিকাংশ ভবনে নেই জরুরি নির্গমন পথ। রাজউকের দুর্বল নজরদারির সুযোগ নিয়ে ঝুঁকি উপেক্ষা করেই এসব রেস্টুরেন্ট চলছে।
গত বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজ নামের ভবনে ভয়াবহ আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। যাদের মধ্যে বেশিরভাগই ওই ভবনে থাকা বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলেন। ভবনটিতে আটটি রেস্টুরেন্ট ছিল, তবে সেখানে রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠার কোনো অনুমোদনই ছিল না।
গ্রিন কোজি কটেজের সেই ভবনে সেদিন আটকা পড়েছিলেন স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার। তিনি বলেন, নকশাবহির্ভূত রেস্তোরাঁ আর রুপটপের রেস্টুরেন্ট একেকটি মৃত্যুফাঁদ। ভবন করার সময় এসব রেস্তোরাঁর নকশা করা হয়নি। নেই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। একটি ভবনে আগুন লাগলে ভবনের ছাদ দিয়ে পাশের ভবনে যাওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু রুপটপ রেস্টুরেন্ট করে সেই সুযোগ বন্ধ করে উল্টো ঝুঁকি সৃষ্টি করা হচ্ছে।
গত কয়েক বছরে অভিজাত বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের পাশাপাশি ঢাকার প্রতিটি এলাকায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য রেস্টুরেন্ট। ভোজন রসিকদের রসনাবিলাসের পাশাপাশি পরিবার ও বন্ধুদের নিয়ে সময় কাটানোর অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে রেস্টুরেন্টগুলো। তবে বিভিন্ন সময়ে অনেক রেস্টুরেন্টের খাবারের মান ও নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ হোটেল ও রেস্তোরাঁ আইন অনুযায়ী, ৩০ জন বা এর চেয়ে বেশি মানুষ যেখানে বসে মানসম্মত খাবার টাকার বিনিময়ে খেতে পারবেন, সেটিকে রেস্টুরেন্ট বলা হয়। রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করতে চাইলে একজন বিনিয়োগকারীকে সরকারের সাতটি সংস্থার অনুমোদন ও ছাড়পত্র নিতে হয়। প্রথমে নিবন্ধন ও পরে লাইসেন্স নিতে হয় সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে। ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সরকারের সব সংস্থার প্রয়োজনীয় অনুমোদন ও ছাড়পত্র নিয়ে ঢাকায় রেস্তোরাঁ ব্যবসা করছে মাত্র ১৩৪টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় রয়েছে ১২৮টি রেস্তোরাঁ। এ ছাড়া শুধু সাভারে ছয়টি রেস্তোরাঁর লাইসেন্স রয়েছে।
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি বলছে, ঢাকায় এখন ২৭ হাজারের মতো রেস্টুরেন্ট। তবে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কর্মকর্তারা মনে করেন, রাজধানীতে রেস্টুরেন্টের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার।
ব্যবসায়ীদের দাবি, লাইসেন্স প্রক্রিয়া সহজ হলে অনুমোদন নিয়ে ব্যবসা করতে তাদের কোনো আপত্তি নেই। লাইসেন্স পেতে কিছু কাগজপত্র জমা দিতে হয়, যেগুলো জোগাড় করতে করতেই মাসের পর মাস চলে যায়। অনেকে এই ব্যবসা করার ধৈর্য ও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
গত ২৮ এপ্রিল গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে নকশাবহির্ভূত রেস্তোরাঁর ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এতে বলা হয়, কিছু আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনের অভ্যন্তরে রাজউক অনুমোদিত নকশায় না থাকলেও বিধিবহির্ভূতভাবে রেস্টুরেন্ট পরিচালনা করা হচ্ছে এবং ভবনের ছাদে অবৈধভাবে রুফটপ রেস্তোরাঁ পরিচালিত হচ্ছে, যা জনজীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। সম্পদ ও জানমালের ঝুঁকি এড়াতে নকশাবহির্ভূত সব রেস্তোরাঁ এবং ভবনের ছাদে স্থাপিত রুফটপ রেস্তোরাঁর ট্রেড লাইসেন্স বাতিল ঘোষণা করা হলো।
রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীদের আর কত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে সরকার? অনুমোদন প্রক্রিয়া সহজ করে ব্যবসায়ীদের শৃঙ্খলার আওতায় আনতে সঠিক পরিকল্পনা করা দরকার। অভিযানের নামে ব্যবসায়ীদের হয়রানি বন্ধ করা দরকার।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বাণিজ্যিক ভবনকে রেস্তোরাঁ ভবনে রূপান্তরিত করাটা অবৈধ এবং এটা হতে দেওয়াই উচিত নয়। বিধিমালা অনুযায়ী অনেক ভবনের দুটি করে সিঁড়ি রয়েছে; কিন্তু অনেক ভবনেই ফায়ার এক্সিট সিঁড়ি মালপত্র রাখার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে কর্তৃপক্ষের উচিত হবে, বিষয়টিকে নিরুৎসাহিত করা।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশনস অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ঢাকার প্রায় ৭০ শতাংশ রেস্টুরেন্টই ঝুঁকিপূর্ণ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আবাসিক ভবনের অনুমতি নিয়ে গড়ে তোলা হয় বাণিজ্যিক ভবন। এতে চাইলেও অগ্নিঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হয় না।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, প্রায়ই রেস্টুরেন্টগুলোতে দুর্ঘটনা ঘটছে। সেজন্য আমরা আন্তঃসংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করেছি। আগামী ৮ মে ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন, বিদ্যুৎ বিভাগসহ অন্য সবাইকে নিয়ে বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করা হবে। সবাইকে অনুরোধ করা হয়েছে রাজউকে যেসব অনুমোদন থাকে এটার বাইরে যেন বিদ্যুৎ সংযোগ না দেওয়া হয়, বিশেষ করে আবাসিক এলাকায় বাড়িতে। আর রুফটপ রেস্টুরেন্টের বিষয় যেহেতু সিটি করপোরেশন লাইসেন্স বাতিল করেছে, আমরা সার্বিকভাবে আলোচনা করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে শিগগির ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেব।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া কালবেলাকে বলেন, ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া যে রেস্টুরেন্টগুলো ব্যবসা করছে সেগুলো অবৈধ। এর মধ্যে কিছু রেস্টুরেন্টের ট্রেড লাইসেন্স থাকলেও তা যথাযথ প্রশাসনিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে দেওয়া হয়নি। সেগুলো আমরা পুরোপুরি বন্ধ করে দেব। অবৈধ রেস্টুরেন্টগুলোর বিরুদ্ধে শিগগির অভিযান শুরু হবে।