
মেক্সিকোতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুশফিকুল ফজল আনসারী বলেছেন, ভোটের পর নির্বাচিত সরকারে ড. মুহাম্মদ ইউনুসের মতো বিশ^ বরেণ্য ব্যক্তিত্বকে দেশের স্বার্থে কাজে লাগানো উচিত। তিনি উল্লেখ করেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশের মানুষের আস্থা ও অকুণ্ঠ সমর্থনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জনগণের ব্যালটের ম্যান্ডেট প্রতিষ্ঠা করা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটা মুখ্য অগ্রাধিকার।
জনাব আনসারী দৈনিক নয়া দিগন্তকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন। মেক্সিকোতে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব গ্রহণের পর ছুটি কাটাতে তিনি এসেছিলেন জন্মভূমি সিলেটে। এ সময় মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দৈনিক নয়া দিগন্তের সিলেট ব্যুরো প্রধান আবদুল কাদের তাপাদার।
মুশফিকুল ফজল আনসারী সিনিয়র সচিব পদ মর্যাদায় মেক্সিকোতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত আছেন। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। শেখ হাসিনা সরকারের ফ্যাসিবাদের প্রতিবাদ করায় নিপীড়নের শিকার হয়ে একযুগ যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত জীবন কাটান। ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক সাংবাদিক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের প্রেস ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নির্যাতন, নিপীড়ন ও অবৈধ নির্বাচন প্রসঙ্গসহ বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদ নিয়ে ধারাবাহিক প্রশ্ন করার জন্য বিশেষভাবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি ওয়াশিংটনভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক ম্যাগাজিন সাউথ এশিয়া পার্সপেকটিভসের নির্বাহী সম্পাদক। তিনি রাইট টু ফ্রিডমের নির্বাহী পরিচালক, যা ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। তিনি জাতিসঙ্ঘের স্থায়ী সংবাদদাতা হিসেবেও সুনাম অর্জন করেন। মুশফিক আনসারী এনটিভিতে হ্যালো এক্সেলেন্সি শিরোনামের জনপ্রিয় টিভি শো হোস্ট করেন, যেখানে প্রায় ষাটজন রাষ্ট্রদূত ও বিদেশী কূটনীতিক অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় প্রেস ক্লাব, জাতিসঙ্ঘ করেসপন্ডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন, হোয়াইট হাউজ করেসপন্ডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশের জাতীয় প্রেস ক্লাব এবং ফরেন প্রেস করেসপন্ডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হিসেবেও কাজ করেছেন।
সাক্ষাৎকারে আনসারী চব্বিশের গণ-আন্দোলন, গণ-আন্দোলন পরবর্তী বাংলাদেশ, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও নির্বাচন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সাথে সম্পর্ক, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পণ্যের চাহিদা, আগামীর বাংলাদেশ এবং সিলেট এমএজি ওসমানী বিমানবন্দরের আধুনিকায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন। নিচে তার সাক্ষাৎকারের পূর্ণ বিবরণ-
নয়া দিগন্ত : চব্বিশের রক্তাক্ত গণ-অভ্যুত্থানের পর বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিছুটা সঙ্কট ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করছে। আপনি প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মুশফিকুল ফজল আনসারী : বাংলাদেশের মানুষের আকাক্সক্ষা ছিল শেখ হাসিনা মতো স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদী সরকারের যাতে পতন ঘটে। এ লক্ষ্যে ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করছিল। আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতনের একদফা দাবিতে যখন সবাই সোচ্চার হয় তখন একমাত্রই সমাধান হিসেবে সামনে আসে তার পদত্যাগ। চূড়ান্ত আন্দোলনের সময় শেখ হাসিনার পেটুয়াবাহিনী পুলিশ ও ছাত্রলীগের গুণ্ডাদের হাতে শত শত আন্দোলনকারী নিহত হন। হাজার হাজার মানুষ গুলিবিদ্ধ ও পঙ্গু হয়। রক্তক্ষয়ী তুমুল আন্দোলনে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এ সময় প্রস্তুতি ছিল না শেখ হাসিনার বিদায়ের পর কী ধরনের সরকার গঠিত হবে, কারা সরকারে থাকবেন। বিষয়গুলো খুব ত্বরিত ও তাৎক্ষণিকভাবে হয়েছে। তবে একটি বিষয়ে বাংলাদেশের সবাই একমত হন যে, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে একজন অভিভাবক প্রয়োজন। সেই অভিভাবকত্ব গ্রহণের জন্য সবার তরফে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে আহ্বান করা হয়। বিশেষ করে আন্দোলনের সমন্বয়কারীরা মনে করেছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস সর্বজনের কাছে গ্রহণযোগ্য দেশে-বিদেশে প্রশংসিত সমাদৃত ব্যক্তিত্ব। তিনি তখন প্যারিসে অবস্থান করছিলেন, তার একটি ছোট সার্জারি হচ্ছিল হসপিটালে। আমরা সবাই মিলে তাকে বুঝাবার চেষ্টা করলাম। আপনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে বাংলাদেশ। এভাবেই বাংলাদেশে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। সেখানে সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। শেখ হাসিনা চেয়েছিল বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর ওপর ভর করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী তাতে সম্মত হয়নি। সেনাপ্রধান সেসময় একমত পোষণ করেন যে, সেনাবাহিনী ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে যাবে না, গুলি চালাবে না। সুতরাং কোনো উপায় না দেখে শেখ হাসিনা পালানোর সিদ্ধান্ত নেন এবং তার যেখানে যাওয়ার কথা সেখানেই তিনি চলে যান। এভাবে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন একটি সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশের মানুষের আস্থা ও অকুণ্ঠ সমর্থনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হয়তো ভোটের ম্যান্ডেট নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে এই সরকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।
নয়া দিগন্ত : দেশে একটা কাক্সিক্ষত সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ক্ষমতায় থাকার একটা প্রচ্ছন্ন দাবি উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে সম্প্রতি আলজাজিরার সাথে সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা ‘এই সরকার চলে যাক জনগণ এমন বলছে না’ মর্মে কথা বলেছেন। অপর দিকে দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল এখনই নির্বাচন চাচ্ছেন। আপনি কোনটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?
মুশফিকুল ফজল আনসারী : আলজাজিরার সাথে সাক্ষাৎকারের পুরো বক্তব্য হয়তো আপনি শুনেননি। উনি বলেছেন যে, বাংলাদেশের মানুষ এই অবস্থায় আমাদেরকে চাচ্ছে। ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার দিকে আমাদের যেতে হবে, অলরেডি একটি সময়সীমার কথাও বলেছেন তিনি। জনগণের ব্যালটের ম্যান্ডেট প্রতিষ্ঠা করা এই সরকারের একটা মুখ্য অগ্রাধিকার। বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থা ও বর্তমানের আন্তর্জাতিক অবস্থান দীর্ঘকাল বাংলাদেশে ভোটবিহীনভাবে শাসন করার অভিপ্রায় প্রফেসর ইউনূসের নেই সেটা আমি হলফ করে বলতে পারি। বিষয়টি হলো তার মতো একজন বরেণ্য ও উঁচুমাপের ব্যক্তিকে আমরা কতটুকু কাজে লাগাতে পারি এটাই চিন্তাভাবনার বিষয়। এই সুযোগটা বাংলাদেশে আর আসবে না। আমাদের প্রয়োজনে, দেশের প্রয়োজনে জাতির প্রয়োজনে ভোট হয়ে গেলেও কিন্তু উনার দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে না। ধরেন একটি ভোট হয়ে গেলো, একটি নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হলো। আমি মনে করি নির্বাচিত সেই সরকারেও প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো ব্যক্তিকে দেশের জন্য প্রয়োজন। দেশের প্রয়োজনে বৃহত্তর স্বার্থে তাকে কাজে লাগানো উচিত। উনি না চাইলেও তাকে কাজে লাগানো উচিত।
নয়া দিগন্ত : আগস্ট বিপ্লবের পরও প্রশাসনের ফ্যাসিবাদের দাপট আমরা লক্ষ্য করছি। অনেকেই মনে করছেন এখনো আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদ প্রশাসনে কাজ করছে। আপনি এ ব্যাপারে সরকারকে কী পরামর্শ দেবেন?
মুশফিকুল ফজল আনসারী : ফ্যাসিবাদের ছায়া রয়ে গেছে। বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী দোসররা ঘাঁপটি মেরে বসে আছে। যার কারণে দেখছি অনেকেরই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেক ভালো ভালো কাজ করতে খুব বেগ পেতে হচ্ছে। আপনাকে বুঝতে হবে দেশে দীর্ঘকাল থেকে একটি স্বৈরতান্ত্রিক, অনিয়মতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম ছিল। ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার বহুস্তরে বসানো সেটআপ হঠাৎ ভেঙে ফেলা সম্ভব হচ্ছে না। প্রশাসনে যাদের সাথে আমার কথা হয়, আমি সেটা বলার চেষ্টার করি যে, অতীতের ফ্যাসিবাদী সরকারে যারা ফ্রন্ট লাইনে ছিল তারা যাতে এখন সরকারের ফ্রন্ট লাইনে না থাকে। অন্তত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যাতে তারা অন্তর্ভুক্ত না থাকে। অন্তত তাদেরকে যাতে চিহ্নিত করা যায় এমন দৃষ্টিভঙ্গি থাকা উচিত। বিগত সরকারের সাথে অনেকে কিন্তু উপযাজক হয়ে কাজ করেছে। বুলেট চালানোর ক্ষেত্রে, গুলি করার ক্ষেত্রে যে বা যারা সরকারের তল্পিবাহক হিসেবে কাজ করেছে তারা নিজেরা গুরুতর অপরাধ করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের নির্দেশনা ছিল। কিন্তু এদের অনেকেই সরকারের উপযাজক হিসেবে কাজ করেছে, সরকারকে খুশি করার জন্য, নিজের সুবিধার নেয়ার জন্য। এই সমস্ত লোকদের আইডেন্টিফাই করা উচিত। এরা যাতে সম্মুখ স্থানে, পলিসি মেকিংয়ে না থাকে। দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনব্যবস্থার মধ্যে প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঘাঁপটি মারার লোক আছে। অনেকে আবার বাধ্য হয়ে অনেক কাজ করেছে। তাদেরকে সংশোধনের সুযোগ দিতে হবে। অনেকে আবার অনিচ্ছায় করেছে, চাপের কারণে করেছে। কিন্তু কেউ কেউ ইচ্ছায় করেছে। সুতরাং কারা ইচ্ছায় করেছে, কারা অনিচ্ছায় করেছে তার পার্থক্য নির্ণয় করা উচিত। আমি মনে করি সরকারের শুরুতে এ কাজ করতে বেগ পেতে হয়েছে। সময়ের ব্যবধানে এখন আইডেন্টিফাই খুবই সহজ হয়েছে। সোস্যাল মিডিয়ার যুগে এখন অনেকটাই বুঝা যায় কে কি? আরেকটা প্রবণতা লক্ষ্য করছি, কে কাকে স্বৈরাচারের দোসর বলবে এটার এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। একজন নেতার সাথে একাধিক ব্যক্তির আলাদা ছবি প্রচার করা হচ্ছে। সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ছবি প্রচার করে একজন আরেকজনকে ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে চিহ্নিত করছেন। শুধু প্রচার করছে না কেউ কেউ বিভিন্ন দফতরে চিঠি পাঠাচ্ছেন। হয়তো ফ্যাসিবাদের দোসর যিনি, তিনি আবার অন্যকে ফ্যাসিবাদের দোসর বলে নিজেকে আড়াল করতে চাচ্ছেন। এই দোসর এবং ননদোসর নিয়ে ইন্টারনালি তাদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। কাউকে ঠেকানোর জন্য প্রতিপক্ষ এটা করছেন। আপনাকে যদি আমি অপছন্দ করি, ব্যক্তিগত কোনো শত্রুতা থাকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটাও ব্যবহার করা হচ্ছে। আপনাকে আমি একটা ট্যাগ দিয়ে দিচ্ছি। আরেকটা হলো রিয়েল অর্থে অতীতে ট্যাগ দেয়ার একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, যা ছিল খুবই ভয়ঙ্কর। আমার মনে হয় সরকারে যারা দায়িত্বে আছেন তারা বিষয়গুলো দেখে শুনেই কাজ করছেন। সরকারের লোকজন সবক্ষেত্রেই যে শতভাগ সফল হয়েছেন সেটা আমি বলব না।
নয়া দিগন্ত : ভারতের দাসত্ব ও আধিপত্যবাদ থেকে মুক্ত হতে চাচ্ছে বাংলাদেশ। চীন, কাতারসহ অনেক প্রভাবশালী রাষ্ট্র আমাদের সাথে সম্পর্ক গড়ছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কি সঠিক পথে এগোচ্ছে? একজন কূটনীতিক হিসেবে আপনার পরামর্শ ও মূল্যায়ন জানতে চাই।
মুশফিকুল ফজল আনসারী : বাংলাদেশ সবসময় স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতিতে বিশ্বাস করে। অতীতে আমাদের নির্বাচিত সরকার স্বাধীনভাবে সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু যখন সরকার দুর্বল থাকে, সরকারে জনগণের ম্যান্ডেট না থাকে, অন্যের কৃপায় যখন কোনো সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় তখন স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে সেটা জাতীয় বা আন্তর্জাতিক যে পর্যায়ে হোক না কেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা ও অগ্রহণযোগ্যতা বলে একটি ব্যাপার থাকে। আমরা সবাই জানি দেশে দীর্ঘকাল অবৈধভাবে নির্বাচিত সরকার মানুষের ম্যান্ডেট পায়নি। তারা ক্ষমতা আঁকড়ে রেখেছে অন্যের কৃপায়। ফ্যাসিবাদ ও গণতান্ত্রিক সরকারের পার্থক্য অনেক। আপনারা জানেন যুক্তরাষ্ট্রে দুই তিনবার ডেমোক্র্যাসি সামিট হলো। তাতে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ পায়নি। অথচ পৃথিবীর বহুদেশ, কম গণতান্ত্রিক দেশেও আমন্ত্রণ পেয়েছে। যেখানে রাজতান্ত্রিক সরকার সেখানেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কিন্তু আরো অনেক দেশ যারা জোর করে ক্ষমতায় বসেছিল, বিশেষ করে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, সেই সব দেশকে আমন্ত্রণ জানায়নি যুক্তরাষ্ট্র। ফ্যাসিবাদের সময় বাংলাদেশকে অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বিভিন্ন রিসার্চ অর্গানাইজেশন চিহ্নিত করেছে। শেখ হাসিনার সরকারকে ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’ নামে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সংগঠন একটি পরিসংখ্যানে মুক্ত গণমাধ্যমবিরোধী দোসর হিসেবে চিহ্নিত করে। হাসিনা সরকারের ১৫ জন কর্মকর্তাকে ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই অবস্থার মধ্যে বাংলাদেশ ছিল। এখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে নতুনভাবে সরকার এগিয়ে নিচ্ছে। পরাষ্ট্রনীতিতে অর্থনৈতিক লেনদেন ও ব্যবসা বাণিজ্যকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ভারতের সাথে আমাদের পণ্যের, ব্যবসা বাণিজ্যের যে গ্যাপ সেটি পাহাড় সমান। মাত্র কিছু পরিমাণ পণ্য রফতানি করে আমরা অনেক বেশি প্রায় ১৪ গুণ বেশি আমদানি করি। এই ক্ষেত্রে প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের সাথে আমাদের একটা ব্যালেন্স থাকা উচিত। আমাদের একটি ব্যালেন্স ডিপ্লোমেসি থাকবে, ফরেন পলিসি থাকবে। এই ডিপ্লোমেসি হবে, ফরেন পলিসি হবে সমতা ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে। আমি আপনাকে রেসপেক্ট করব, আপনি আমাকে রেসপেক্ট করবেন। সুতরাং কেউ যদি মনে করে আমি বৃহৎ রাষ্ট্র, আমার অধীনে থাকবে ফরেন পলিসি, আমি গাইড করব ছোট দেশকে তা কিন্তু বাংলাদেশে আর হবে না। এটি যে হবে না বাংলাদেশের মানুষ তা জানান দিচ্ছে। আমি মনে করি বাংলাদেশের পণ্যের যে বাজার সেটা প্রশস্ত করার জন্য বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ড একটি ঐতিহাসিক কাজ সম্পন্ন করেছে। এ যাবৎকালে সবচেয়ে বড় ইনভেস্টমেন্ট সামিট তারা সাফল্যের সাথে শেষ করেছে। বড় বড় কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে ইনভেস্টমেন্টের জন্য আসছে। আমাদের পণ্যের বাজার দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে। আমাদের গার্মেন্টের প্রতি প্রায়োরটি ছিল। সেটার বাজার বাড়ছে। জেনেটিক মেডিসিন, পশু মেডিসিনের একটি বিশাল বাজার রয়েছে। সিরামিক, লেজার পাউডার, টুথ পাউডার প্রোডাক্টের ক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমাদের যোগাযোগ বেড়েছে। অনেকেই জানতো বাংলাদেশে প্রডাক্ট আছে, কিন্তু সেটা বাজারজাত হচ্ছিল না। বাংলাদেশে আমরা এক্সপো করার চেষ্টা করছি। আমরা বিশ্বাস করি বাংলাদেশের পণ্যের বাজারে সারা বিশ্বেজুড়ে ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করছে। আমাদের বিশাল সম্ভাবনা আছে সেই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে।
নয়া দিগন্ত : আমেরিকা ও চীনের সাথে আমাদের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
মুশফিকুল ফজল আনসারী : আমাদের বড় একটি বাজার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের অথনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সহযোগিতার সম্পর্ক অনেক বেশি। আপনি দেখবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প আসার পরে সবধরনের সাহায্য সহযোগিতা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ইউএসএইডের ফান্ড বন্ধ হয়নি। যা ভারত, পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশে বন্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশের যে ট্যারিফ নির্ধারণ করা হয়েছিল সেটি স্থগিত করেছে। আমাদেরকে এই তিন মাসের জন্য স্থগিতের সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। তারা চাচ্ছে ব্যালেন্স করতে। আমরাও যাতে তাদের পণ্য নেই। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের চেয়ে অনেকগুণ বেশি পণ্য কিনছে। আমরা তাদের কাছ থেকে নামমাত্র পণ্য কিনি। আমাদের বেলায় ভারতের ক্ষেত্রে যেটা ঘটছে যুক্তরাজ্যের বেলায় সেটা ঠিক উল্টো। নামমাত্র পণ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসে। হিউজ পরিমাণ প্রডাক্ট আমরা সেল করি। রেডিমেইড গার্মেন্টের সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। সুতরাং তারাও চাইছে তাদের পণ্য বাংলাদেশে আসুক। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের সম্পর্ক বহুমাত্রিক। চীন আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। তাদের সাথে বাংলাদেশের যোগাযোগ বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি আমি সম্প্রতি রাষ্ট্রদূত হওয়ার পর দেখেছি ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতেও আমাদের পণ্যের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। আমাদের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি চীন সফর করেছেন। চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। সমমর্যাদা, সমতা ও জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সবধরনের কূটনৈতিক তৎপরতা ও বাণিজ্য বৃদ্ধিতে এই সরকার বদ্ধপরিকর।
নয়া দিগন্ত : বাংলাদেশ কোনদিকে যাচ্ছে, আগামীর বাংলাদেশের গন্তব্য কোথায়?
মুশফিকুল ফজল আনসারী : বাংলাদেশ কোনদিকে যাচ্ছে এ বিষয় নিয়েই এতক্ষণ কথা হলো। চব্বিশের রক্তাক্ত গণবিপ্লবের পর বাংলাদেশের জাগতে শিখেছে। অনেকে বলেছিলেন বাংলাদেশে শেখ হাসিনা যেভাবে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করেছিলেন আর তাকে সরানো যাবে না। আমার পরিচিত সাংবাদিক, রাজনৈতিক প্রতিনিধি অনেকেই বলতেন, আর কখনো দেশ বদলাবে না, শেখ হাসিনাই থাকবে। আমাদেরকে গুম করে ফেলবে, আমাদের মেরে ফেলবে। সেই অবস্থান থেকে বাংলাদেশ মানুষ কিন্তু জেগে উঠেছে। বুলেটকে আলিঙ্গন করে রক্ত রাঙ্গানো পথ মাড়িয়ে নতুন এক বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। অবিশ্বাস্য রকমভাবে সেটা ঘটেছে। ফ্যাসিবাদের পেছনে ছিল একটি বড় শক্তি, সেটিকে পরাজিত করে বাংলাদেশ নতুন করে তার ভিত্তি রচনা করতে সক্ষম হয়েছে। আমি মনে করি সামনে অপার সম্ভাবনা। যে সম্ভাবনার সুযোগ তৈরি হয়েছে সেটাকে কাজে লাগাতে হবে। সেই সুযোগকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের সম্ভাবনা অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে। আমাদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। আমাদের যে ক্ষুদ্রস্বার্থ আছে, আমি কি পেলাম আমার কি হলো, সেটা ভুলে যেতে হবে। রাষ্ট্র বিনির্মাণে আমরা সবাই যদি এক্যবদ্ধ হতে পারি, গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে পারি, অর্থনীতি ও রাজনীতির সমন্বয় ঘটাতে পারি তাহলে একটি আকাক্সিক্ষত বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।
নয়া দিগন্ত : সিলেট এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এখনো পরিপূর্ণতা পায়নি। এখানে রানওয়ে সঙ্কটের কারণে বিদেশী বিমান উঠানামা করতে পারছে না। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক কার্গো ফ্লাইট চালু হওয়ায় আশার আলো দেখছেন সিলেটবাসী। এই বিমানবন্দরের আধুনিকায়নে বিভিন্ন প্রকল্পের সাথে আপনার ভূমিকা রয়েছে। পরিপূর্ণ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে কবে সেজে উঠবে এই বিমানবন্দর?
মুশফিকুল ফজল আনসারী : এখানে যেটা হয়েছে রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পে বিশাল পরিমাণ গাফিলতি ধরা পড়েছে। বিদেশী ইন্ডাস্ট্রিকে কাজ দিয়েছে যে কাজটা বাংলাদেশের মানুষ করতে পারে। রাষ্ট্রের এসব বিষয়ে মারাত্মক অপচয় ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। যদি আমরা আইনের আশ্রয় নিতে পারি তাহলে হয়তো জরিমানা আদায় করা যাবে। আমি ভালোভাবে দেখেছি, বুঝেছি কী পরিমাণ লুটপাট ও অপচয় হয়েছে। উপদেষ্টা বশির ভাইয়ের সাথে আমরা ব্রিফ নিয়েছি। বাকি কাজগুলো করতে কী পরিমাণ টাকা লাগবে, সেটা এখন দেখতে হবে। আমার কাছে মনে হচ্ছে, তারা এগুলোকে খুব বড় আকারে প্রজেক্ট তৈরি করেছে। শুধু এই প্রজক্ট নয় সব প্রজক্টই এভাবে করেছে। প্রজেক্ট থেকে কত টাকা লুটপাট করতে পারি সেটাই তাদের উদ্দেশ্য। এই ব্যাপারে আপাতত নতুনভাবে সবকিছু দেখা হচ্ছে। সিভিল অ্যাভিয়েশন একটি রিভিউ করছে। এখানে কি ধরনের অসঙ্গতি আছে এটি তারা দেখছেন। এ বিষয়ে সেদিন উপদেষ্টা বলেছিলেন আমাদের এখানে কোরিয়ান ও চাইনিজরা কেন কাজ করবে ও কেন বিল নেবে? এই টাকাটা তো বাইরে চলে যাচ্ছে। এই কাজ বাংলাদেশের লোকজন করতে পারে। এই বিমানবন্দর প্রশস্তকরণে ক্যাপাসিটি অনেক বাড়বে। ফলে ঢাকা এয়ারপোর্টের প্রতি চাপ কমবে। ঢাকায় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দেখবেন যে, রানওয়েতে প্লেন উঠানামা করার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়। একটি বিমান উঠলে আরেকটি বিমান অপেক্ষায় থাকতে হয়। সেখানে রানওয়ে সম্প্রসারণের সুযোগ নেই। সে জন্য সিলেট এয়ারপোর্টের রানওয়েতে সম্প্রসারণ করতে হবে। সে জন্য আরো এয়ারপোর্টের দরকার আছে। সিলেটে প্রাইভেট বিমানের চাহিদা বেড়েছে। তাদের ক্যারিয়ার জোরালো হচ্ছে। প্রাইভেট ক্যারিয়ারে কী পরিমাণ প্যাসেঞ্জারের চাপ আছে সেটা দেখে বেসরকারি বিমানগুলো সিলেটমুখী হতে পারে।